“শিক্ষার পায়ে বেড়ি”, ভারতবর্ষ জুড়ে রেলওয়ে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত কেন্দ্র সরকারের

অভিষেক দত্ত রায়
ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়ার পরই সবচেয়ে বেশি পরাধীন ভারতবাসী। একথা বলার বোধ হয় অপেক্ষা রাখে না৷ আর একথাও অতি সত্য যে বৃটিশদের থেকেও ভয়ানক ও ক্ষতিকারক স্বাধীন ভারতের প্রথম থেকে বর্তমান সরকার।
এবার এই দুটি লাইনের ব্যাখ্যায় আসা যাক। বর্তমানে কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের ব্যর্থতায় পেট্রোপণ্য, খাদ্য সুরক্ষার পাশাপাশি শিক্ষার পায়ে বেড়ি পড়েছে।
ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারত শাসনের সংকল্প নেয় তখন এই বিশাল ভূখণ্ডে সবচেয়ে সমস্যার দিক ছিল ভঙ্গুর যোগাযোগ ব্যবস্থার৷ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাতায়াত ও পণ্য আদান-প্রদানের সুব্যবস্থা ভারতে ছিল না৷ এই সংকট মোচনে শুরু হল রেলপথ নির্মাণ৷ তবে এটা মনে রাখতে হবে প্রথম এই রেল পরিষেবা পণ্য বহনের উদ্দেশ্য নিয়েই নির্মাণ শুরু হয়েছিল। যাত্রীবাহীর জন্য নয়৷
ভারতবর্ষে প্রথম রেলপথ স্থাপনের প্রস্তাব উঠেছিল ১৮৩২ সালে।তৎকালীন মাদ্রাজ শহরে। বর্তমানে যার নাম চেন্নাই। প্রস্তাব অনুযায়ী রেল পথ নির্মাণের জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে শুরু হয় বাঁধ নির্মাণ, সেতু নির্মাণ, টার্নেল নির্মাণ প্রভৃতি কাজ। ১৮৪৪ সালে বৃটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড হেনরি হার্ডিং ভারতের একাধিক বেসরকারি সংস্থাকে রেলপথ নির্মাণের অনুমতি দেন৷ পরে সমস্তটাই এক ছাতার তলায় আসে। এসবের পর ১৮৫১ সালের ২২শে ডিসেম্বর ভারতে প্রথম রেল চালু হয়। তবে এটি পণ্য সামগ্রী বহনের জন্য৷ এরপর ১৮৫৩ সালের ১৬ এপ্রিল তৎকালীন বোম্বাই থেকে থানে পর্যন্ত প্রথম যাত্রীবাহী রেল চলে৷ এদিন থেকে ভারতের ইতিহাসে যেন গতি এল। দ্রুত বাড়তে থাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রেলপথ নির্মাণের কাজ। একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা গিয়েছে ১৮৬০ সালে ভারতে রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল ১,৩৪৯ কিলোমিটার। ২০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৮৮০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫,৪৯৫ কিলোমিটারে৷ এর থেকে বোঝা যাচ্ছে কত দ্রুত রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ভারতে৷
এই রেলপথ নির্মাণের সময় দেশের বেশ কিছু ছোট-বড় শহরে গড়ে ওঠে রেল কলোনি। অর্থাৎ, একটি জায়গায় অস্থায়ী বসতি তৈরি করে শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, অফিসারেরা আসেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকায় রেল লাইন বসানো, রেলের কামড়া নির্মাণ সহ বিভিন্ন কাজ করতে শুরু করে৷ কাজে আরও গতি আনার জন্য শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ার, কর্মীদের খাওয়ার ব্যবস্থা, হাসপাতাল, স্কুল নির্মাণ করা হয়েছিল ওই কলোনিগুলিতে। কর্মীদের সন্তানেরা এই রেলের স্কুলেই পড়াশোনা শুরু করে। রেলের হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর ব্যবস্থাও ছিল। তবে, একটি বিষয় উল্লেখ্য, প্রথম রেলের স্কুল নির্মাণ হয়েছিল শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য৷ পরবর্তীতে সেখানে শ্রমিক, কেরানি, অফিসারদের সন্তানদের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা হয়।
প্রসঙ্গত, এই মুহুর্তে ভারতীয় রেল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পরিবহন ব্যবস্থা। সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থানের সংস্থান৷ রেল দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিদিন গড়ে ১ কোটি ৮০ লক্ষের বেশি যাত্রী রেল পরিষেবা ব্যবহার করে থাকেন। ২০ লক্ষ টনের বেশি পণ্য সামগ্রী বহন করা হয়ে থাকে৷ বর্তমানে ৬৭,৪১৫ কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে ভারতবর্ষে।
এবার রেলের স্কুলের বিষয়ে আসা যাক৷ সমগ্র ভারতবর্ষে এই মুহুর্তে ১১৪ টি রেলওয়ে স্কুল রয়েছে৷ যেখানে ৬৮০০ ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা করে থাকে। ১৮৭৩ সাল থেকে শুরু হয় এই স্কুলগুলি। প্রথম দিকে এই স্কুলগুলিতে শুধুমাত্র রেলের কর্মী, আধিকারিকদের সন্তানরা পঠন-পাঠন করলেও, পরবর্তীতে সকলের পঠন-পাঠনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল৷ যদিও, ভারত তথাকথিত বা খাতায় কলমে স্বাধীন হওয়ার বহু পরে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল৷ বর্তমানে রেলের এই স্কুলগুলি বন্ধ করে দিচ্ছে ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকার৷ ২০১৮ সালের ৩০ এপ্রিল প্রথম রেলওয়ে স্কুলগুলি চিরতরে বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় রেল মন্ত্রক৷ সরকারের যুক্তি, ‘ভারতীয় রেল মুনাফা অর্জনের জায়গা। যাত্রী পরিষেবা দেওয়ার জায়গা৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালানো রেল দপ্তরের কাজ নয়৷’ এই যুক্তিতে আজ রেলওয়ে স্কুলগুলিকে বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার৷
সরকারের যুক্তি অনুযায়ী রেল মন্ত্রকের কাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালনা করা নয়৷ তাহলে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি বন্ধ না করে কেন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রকের আওতাধীন করে দেওয়া হচ্ছে না? এর কোন উত্তর কিন্তু নেই৷ কারণ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তাই।কেন সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে দেশের ১১৪ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান? কত পড়ুয়া ও শিক্ষকের ভবিষ্যৎ আজ অতলে। যেমন ভাবে আজ ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক দূরদর্শন কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে৷ ঠিক একই কায়দায় শিক্ষিতের হার কমিয়ে ভোটের মুনাফার লোভে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মুখে ভারতে৷ একদা লুঠ করতে আসা বৃটিশরা নিজ স্বার্থে হলেও রেলওয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল৷ আজ স্বাধীন ভারতের সরকার শিক্ষার পায়ে বেড়ি পরিয়ে চলেছে৷ শত কোটি শ্রমজীবীর বাস্তুভিটে এই ভারতে না আছে দুবেলা ভাতের সঠিক বন্দোবস্ত, না আছে শিক্ষা৷ আছে শুধু সরকার ও তার শোষণ যন্ত্র।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এসব দেখেও দেশজুড়ে নিশ্চুপ শিক্ষিত সমাজ৷ আসলে মানুষ শিক্ষিত হলে ভোট দেবে না। তাই “শিক্ষা বিপ্লব” শব্দটি আজ ম্লান থেকে ম্লানতর৷ কারণ সিলমোহরে আমরা যে স্বাধীন। এ স্বাধীনতার চেয়ে পরাধীনতাই শ্রেয় নয় কি? যেমন ভাবে- ‘ব্যর্থ গণতন্ত্রের চেয়ে রাজতন্ত্র শ্রেয়।’
তাই বলাইবাহুল্য –
“আজও কারাগারে বন্দি স্বাধীনতা।
ছোট ঘুলঘুলির আলোর দিকে উঁকি দেয়,
লোহার কাঁকন, লোহার অলঙ্করণ বেষ্টিত স্বাধীনতা চাই না।
ডানা ঝাপট, ওড়া মানা,
চাই না-
চাই না এই রুদ্ধ স্বাধীনতা।
আজও খাতায় কলমে সন্ধি।
ছোট্ট সিলমোহরের ঝাঁপসা রঙের দিকে ঝুঁকি দেয়,
নথির বোঝায়, কথার ছলে মণ্ডিত স্বাধীনতা চাই না।
চাই না-
চাই না এ নির্লিপ্ত স্বাধীনতা,
আজও সেই অতলে।
হোক মন্থন, উত্তোলিত হোক, হোক মুক্ত।
গড়ল পানে দ্বিধা নেই,
চাই যে প্রকৃত স্বাধীনতা।।”
ফিচার ছবি প্রতিকী