মে দিবসের আজকের প্রাসঙ্গিকতা

শেখর দত্ত
১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিক শ্রেণীর আট ঘণ্টার কাজের সময়ের দাবিতে যে লড়াই শুরু হয়েছিল,আজ ১৩৬ বছর পর , ২০২২ সালে , এই কম্পিউটারাইজড , গ্লোবালাইজড , ডিজিটাল যুগে, তার কতটা প্রাসঙ্গিকতা আজও আছে, সে বিশ্লেষণ দরকার।
ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীর পর, ১৮৯০ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে শ্রমিক শ্রেণীর দাবী ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের লক্ষ্যে মে দিবস পালন শুরু হয়।
১৯০৪ সালে আর্মস্টারডামে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনের গৃহীত প্রস্তাব অনুযায়ী বিশ্বজুড়েই মে দিবস পালনের আহ্বান জানানো হয়।
ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে, বর্তমান চেন্নাই শহরে । তার অল্প আগেই ভ্রুনাকারে তৈরি হয়েছে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি।
গোটা ঊনবিংশ শতাব্দী ও বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ ছাড়িয়ে, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধত্তর ইউরোপ, আমেরিকা , এশিয়ার চীন, জাপান কোরিয়া ইত্যাদি জুড়ে শুরু হয় ব্যাপক ভারী ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর শিল্পায়ন। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্ব জুড়েই ক্রমশঃ তৈরি হতে থাকে এক বিশাল শ্রমিক শ্রেণী। ভারতের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোতেও তার প্রভাব পড়ে ভারতেও আধুনিক শিল্পায়ন শুরু হয়ে যায়। পণ্য বাজারের বিশ্ব বানিজ্যে গতি আসে বিরাট ভাবে। ইতিমধ্যে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে সোভিয়েত রাশিয়া ও চীনে। তারই প্রভাবে এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও ইউরোপ জুড়েই শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতার সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের আকাঙখা জাগরিত হতে থাকে। এই পটভূমিকায় এই সব দেশে মে দিবসের তাৎপর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পায় । এক দিকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, পাশাপাশি সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে একের পর এক কৃষক বিদ্রোহ এবং জাগরিত শ্রমিক শ্রেণীর চেতনায় অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন – এই সব দেশগুলিতে বিদ্রোহ বিপ্লবের সূচনা করে। মে দিবস হয়ে ওঠে এই সব সংগ্রামের এক বলিষ্ঠ হাতিয়ার।
গোটা সত্তর দশক জুড়ে ফ্রান্স, ইতালি, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা,ভিয়েতনাম, ভারত সহ বিভিন্ন দেশে ছাত্র শ্রমিক ও কৃষক জনগণের বিদ্রোহ বিপ্লবী সংগ্রাম, চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি তীব্র অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। খোদ মার্কিন দেশেও ছাত্ররা, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীরা আমেরিকায় শ্রমিক ছাঁটাই , তৃতীয় বিশ্বের জনগণের উপর আমেরিকান শোষণ নিপীড়ন, বিশেষত ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানাতে আমেরিকার শহরে শহরে বড় বড় মিছিলে সামিল হয়।
আশি-নব্বই এর দশক থেকে ক্রমশঃ পাল্টাতে থাকে পরিস্থিতি। এর আগেই ষাটের দশকেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক কাঠামো পাল্টে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তৈরি হয়। চীনেও ১৯৭৬ সালে মাওসেতুং এর প্রয়াণের পর ঘটে পটপরিবর্তন। ক্রমে ক্রমে চিনেও দেং শিয়াও পিং এর ক্ষমতা করায়ত্বে তৈরি হয় কঠোর কঠিন আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় পুঁজির শাসন।
ষাটের দশক থেকেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধের পরিস্থিতি শুরু হয়েছিল। ন্যাটো ও ওয়ারশ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মধ্যে জারি হয়ে যায় এই ঠান্ডা যুদ্ধের এক যুদ্ধকালীন অবস্থা। সোভিয়েত দেশে ব্যবস্থাটার সার্বিক সামরিকিকরণের ফলে রাষ্ট্রীয় পুঁজি ব্যবস্থার সংকট দেখা দেয়। অসন্তোষ বিক্ষোভ চূড়ান্ত আকার নেয়। যাকে আর কঠোর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা দিয়ে দমানো অসম্ভব হয়ে পরে। আরেক নীরব দক্ষিণপন্থী বিপ্লবে , বিনা অস্ত্র প্রয়োগে ১৯৯২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। ক্রমে ভেঙ্গে যায় ওয়ারশ জোট। পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও সমাজতন্ত্রের নামাবলী খসে পড়ে। ভেঙ্গে যায় বার্লিন প্রাচীর। সমাজতন্ত্রের খোলস ছেড়ে পুঁজিবাদী দেশ হিসেবেই আত্মপ্রকাশ করে পোল্যান্ড, রোমানিয়া , হাঙ্গেরি। ইস্ট জার্মান যুক্ত হয় পুঁজিবাদী ওয়েস্ট জার্মানের সাথে, পুনরায় গড়ে ওঠে অবিভক্ত জার্মান।
এর পরে পরেই আসে আর্থার ডাংকেলের কুখ্যাত সেই একবিশ্বের ধারণা। গোটা বিশ্বের পুঁজি,মেধা,বুদ্ধি, সম্পদ – সবকিছুই এক বিশ্ব-বাণিজ্যিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। সূচনা হয় এক-বিশ্ব ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ। চীন সহ পৃথিবীর অন্যান্য পূর্বতন রুশপন্থী সংশোধনবাদী কমিউনিস্ট পার্টিগুলিও এই নয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকেই কার্যত স্বাগত জানায়। ভারতের সিপিআই, সিপিআইএমও ঘুরিয়ে নাক দেখিয়ে এই নয়া বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থাকে সমর্থন করে। এবং যে যে অঙ্গ রাজ্যে তারা ক্ষমতায় আছে , সেখানকার অর্থ ব্যবস্থায় গ্যাট চুক্তি প্রয়োগ করে ।
শ্রমিক কৃষক সহ সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত জনগণের উপর এর প্রভাব পড়ে ভয়ানক ভাবে। শ্রমিক শ্রেণী দিশাহারা হয়ে পড়ে। মাথার উপর এমন কোনই দল বা সংগঠন নেই , যারা এর বিপরীতে গ্যাট চুক্তিকে অমান্য করে শ্রমিক – কৃষক রাজের আহ্বান দিতে পারে। মাত্র গুটি কয়েক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নকশালপন্থী সংগঠন ও কিছু উদার গণতান্ত্রিক সামাজিক সংগঠনগুলি নীতিনিষ্ঠ ভাবে এই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরোধিতা করে আজও টিম টিম করে টিকে আছে।
এই নয়া ব্যবস্থায় ক্রমশঃ প্রযুক্তি নির্ভর পুঁজি ঘন শিল্পের বিকাশ ঘটতে শুরু করলো। শ্রমঘন শিল্পের ভরাডুবি ঘটাতে লাগলো সরকার ও কর্পোরেট পুঁজিবাদ। এই বাংলায় বন্ধ হতে শুরু করলো বড় বড় সব কারখানা। আশির দশকেই যার সূচনা হয়েছিল, নব্বই এর দশক থেকে তা গুণিতক হারে বাড়তে লাগলো। চালু কারখানার স্থায়ী শ্রমিক কমিয়ে আনা হলো। বেড়ে গেল ঠিকা শ্রমিক , ক্যাজুয়াল লেবার । দৈনিক নামমাত্র মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ হতে লাগলো পার্টির শ্রমিক নেতার হাত ধরে। সেখানেও মজুরিতে ভাগ। বিশাল ভাবে বেড়ে গেল অসংগঠিত ক্ষেত্র ও অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা। উৎপাদন ব্যাহত হলোনা। কিন্তু শ্রমিকের সংখ্যা ও মজুরি কমে গেলো ভয়ঙ্কর ভাবে।
ক্রমশঃ কমতে থাকলো মৌলিক উৎপাদক কৃষকের ফসলের দাম। নয়া বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গজিয়ে উঠলো প্রভূত ক্ষমতাশালী , শাসকদল পরিপুষ্ট ফড়ে দালাল ও মধ্যসত্ত্বভোগীদের দল। এরাই -কি কারখানায়,কি কৃষি ক্ষেত্রে কার্যত নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠতে লাগলো। চালু শিল্পগুলি ক্রমে চলে যেতে শুরু করল প্রভূত অবৈধ টাকার মালিক ও শাসক দল নিয়ন্ত্রিত ফড়ে দালাল চক্রের হাতে। একে একে কারখানা বন্ধ হতে লাগলো। কারখানার জমিতে গড়ে উঠতে লাগলো প্রোমোটারি ইমারতি ব্যবসা। সরকারি মদতপুষ্ট মাস্তান-ক্যাডার বাহিনী, ও পার্টির নেতারাই এসব নিয়ন্ত্রণ করতে লাগলো। এরই ফলে বেকার হয়ে পড়লো লক্ষ কোটি শ্রমিক। বন্ধ হয়ে গেলো কৃষক, নিম্ন মধ্যবিত্ত, কারিগরি শিক্ষাপ্রাপ্ত কর্মপ্রার্থীদের নিয়োগ। এই বিশাল বেকার বাহিনী বাধ্য হয়েই চলে গেলো শাসক পার্টির ছত্রছায়ায়। এরাই ক্রমে হয়ে উঠলো পার্টির পেশীশক্তির ভোট ব্যাংক। মে দিবস রসাতলে চলে গেলো। শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্তের আন্দোলন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো। মদমাংস দিয়ে পয়লা মে পূজা শুরু হলো এই নব্য মাফিয়াদের নিয়ে। বেতন ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে চরম সুবিধাভোগী, গ্রাম থেকে শহরতক সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষককুল হয়ে উঠলো এই ব্যবস্থাটার অন্যতম ধারক বাহক। এদের বেশিরভাগই ক্রমশঃ হয়ে উঠলো আদর্শহীন , স্বার্থপর ,তোষামুদে , দুর্নীতিগ্রস্থ ও উৎকোচভোগি। সরকার এদের মদত দেয়, এদের থেকে মদত নেয়। এরাও পয়লা মে পূজায় থাকলো মদ মাংস সহযোগে।
মে দিবসের শুভেচ্ছা আজ আসে আমেরিকার রাষ্ট্রনায়ক থেকে শুরু করে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী শিল্পপতিদের থেকেও। মোটা অঙ্কের চাঁদাও দেন এরা মে দিবস পালন করতে।
বন্ধ কারখানার শ্রমিক, ইমারতি শিল্প সহ শপিংমল কর্মচারী, সংগঠিত-অ সংগঠিত শিল্পের ঠিকা মজুর, সিকিউরিটি কর্মচারী, সিভিক ভলেন্টিয়ার, কৃষি মজুর, সহ বিশাল সংখ্যক অসংগঠিত মজদুরদের কাছে মে দিবসের বার্তা পৌঁছে দেবার মানুষ বা সংগঠনই আর প্রায় নেই বললেই চলে।
এই সব সত্বেও মেহনতি জনতাকে কোমর বাঁধতেই হবে লাল সূর্যের অপেক্ষায়। এতসব হতাশার মধ্যেও মেহনতি মানুষের জন্য আকাশ লাল হবার অপেক্ষাতেই আছে। সম্প্রতি লাখো লাখো কৃষকের সাথে শ্রমিক মধ্যবিত্তের দীর্ঘ বিক্ষোভ ধর্না দেখলাম আমরা দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব জুড়ে। কৃষকের ও জনতার এই মিছিল ও দীর্ঘ ধর্না দিল্লীর শাসককে মাথা নত করিয়ে, দাবী আদায় করে ছাড়লো।
আমেরিকায় কালো মানুষের উপর সাদা পুলিশের পৈশাচিক বর্বর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোটি জনতার প্রতিবাদ প্রতিরোধ আছড়ে পড়ে আমেরিকার শাসকের প্রাণে ত্রাস ছড়িয়ে দিল মার্কিন প্রতিবাদী চেতনা।
ফ্রান্স, মেক্সিকোর কৃষক লড়ছে কৃষক বিরোধী রাষ্ট্রীয় ও বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
ব্রাজিল,আর্জেন্টিনায় চলছে বিক্ষোভ। শ্রীলঙ্কায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধের লড়াইয়ে শাসকের পালাবদল আসন্ন।
কিন্তু ভারত ও বাংলার রাজনীতিতে এখনো অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে পারছে হিন্দুত্ব। বাংলায় সুদীর্ঘ চৌত্রিশ বছরের “বাম” শাসনের সুবিধাবাদ,দুর্নীতি, মাফিয়া ও এলাকাতন্ত্রের কর্তৃত্ব মানুষকে আন্দোলন বিমুখ করে দিয়েছে।
বাংলার লড়াকু বিবেকী জনতাকে আবার ঘুরে দাঁড়াতেই হবে । মে দিবসের মিছিলে আনতেই হবে বন্ধ কারখানার লাখো শ্রমিককে। মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে এই বাংলার বুকে। তখনই ফিরে আসবে আবার নতুন দিনের স্বপ্ন।
মে দিবসের সংগ্রাম দীর্ঘজীবি হোক।
শেখর দত্ত : প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক কর্মী।
