বাঁচতে চাইলে প্রকৃতি বাঁচান– হাতে আর সময় নেই বন্ধু।

সন্তোষ সেন
প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদত ও সহযোগিতায় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো পাহাড়প্রমাণ লাভের কড়ি সচল রাখতে প্রকৃতি-পরিবেশকে করছে বিধ্বস্ত। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে যে, বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সমীক্ষা ও গবেষণার সূত্র ধরে জানাচ্ছেন– অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীটাই মানুষ সহ সকল জীবজন্তুর বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change) ‘র ষষ্ঠ রিপোর্টে সারা বিশ্বের সাথে ভারতবর্ষের জন্যও ভয়ঙ্কর বিপদবার্তা জারি করা হয়েছে। রিপোর্টের ছত্রে ছত্রে বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ স্পষ্ট– ভূউষ্ণায়ন, বরফের অতি দ্রুত গলন এবং সমুদ্রের জলস্তরের ফুলে-ফেঁপে ওঠার কারণে খুব বেশি হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের কম করে ৪০০ টি উপকূলবর্তী শহর জলের তলায় তলিয়ে যাবে। এই তালিকায় কলকাতা সহ ভারতের ১২ টি শহরও বিপর্যয়ের প্রহর গুনছে। কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি, নয়ডার মতো মেট্রো শহরগুলিকে বলা হচ্ছে ‘ আরবান হিট আইল্যান্ড’। শহর ও শহরতলীর জলাশয়-জলাভূমি উন্নয়নের করাল গ্রাসে চাপা পড়ে যাচ্ছে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। চার লেন-ছয় লেনের রাস্তার জন্য নির্বিচারে কাটা পড়ছে সুবৃহৎ সবুজ বনানী। গাছপালা অত্যন্ত কমে যাওয়ায় ও শহরে কৃষিকাজ না থাকায় এবং কংক্রিটের জঙ্গল আরো বিস্তৃত হওয়ায় শহরগুলোতে রোদের তাপ প্রচুর পরিমাণে ঢুকলেও তা আর বিকিরিত হয়ে ফিরে যেতে পারছে না। ফলে শহরগুলি এক একটি তপ্ত কড়াইয়ের ওপর অবস্থান করছে।
এইসব সতর্কবার্তা আজ কেবল কথার কথা বা ভয় দেখানোর বিষয় নয়। চলতি বছরের (২০২২) এপ্রিল মাস থেকে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, তাপপ্রবাহ, বাতাসে অত্যধিক আদ্রতা আর দূষিত আবহাওয়ার হাত ধরে হাঁসফাঁস করা শহরবাসী ও শহরে কাজ করতে আসা মানুষজন তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে চলেছেন প্রতিনিয়ত। প্রতিবছর এই ধরণের অস্বাভাবিক জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা বিশ্ববাসীর কাছে আরো ভয়ানক ও ভয়াবহ আকারে হাজির হবে বলেই বিজ্ঞানী ও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্কবাণী দিয়ে যাচ্ছেন কিন্তু রাষ্ট্রনায়কদের কর্ণকুহরে তা পৌঁছাচ্ছে না একেবারেই।
IPCC’ র রিপোর্ট ও বিজ্ঞানীদের চেতাবনি ছত্রে ছত্রে মিলে যাচ্ছে বিগত কয়েক বছর ধরেই। এই প্রসঙ্গে অতি সাম্প্রতিক দুটি ভয়াবহ ঘটনাকে সামনে আনব।
ঘটনা এক: ৭ই মে, ২০২২ চীন-পাকিস্তান সংযোগকারী একটি ঐতিহাসিক ব্রিজ সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ল, তলিয়ে গেল জলের তলায়। পাকিস্তানের কারাকোরাম হাইওয়ের সন্নিকটে চীনের সাথে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক ‘হাসানাবাদ সেতু’ র ভেঙ্গে পড়ার কারণ সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে তা হলো– এপ্রিল মাস জুড়ে পাকিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ওখানকার গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রার থেকে আট থেকে দশ ডিগ্রি বেশি। অত্যধিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং তাপপ্রবাহের কারণে একটি বিশাল আকারের বরফের পাহাড় (Shisper glacier) সম্পূর্ণরূপে গলে যায়, যার ফলে নদীতে প্রবল জলস্ফীতি ভাসিয়ে নিয়ে গেল এই ব্রীজকে। প্রবল জলস্রোতের কারণে সেতুর সাথে সাথে দুটি জল-বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্রচুর বাড়ি, আবাসন, প্রশাসনিক ভবনও জলের তলায় তলিয়ে গেছে। বাজারি সংবাদপত্রে এইসব খবর সামনে না এলেও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদসংস্থা থেকে এই ভয়াবহতার খবর শুনে প্রকৃতি প্রেমিক মানুষজন আতঙ্কে শিউরে উঠছেন।
ঘটনা দুই: প্রবল বন্যায় বেসামাল আসাম ও অরুনাচলপ্রদেশ। ১৬ মে,২০২২ থেকে লাগাতার ভারী বৃষ্টি ও ভূমিধ্বসে আসামের ২৯টি জেলার আট লক্ষের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। এই বিপর্যয় বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সূচনা। ১৫ মে, ২০২২ আসামে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আসামের ডিমা হাসাও জেলার হাফলং স্টেশন ভারী বৃষ্টি ও কাদা ধ্বসের কারণে সম্পূর্ণভাবে প্লাবিত হয়েছে, প্রায় গোটা জেলা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, বাতিল হলো ১৭ রুটের ট্রেন। উত্তর-পশ্চিম ভারত যখন তীব্র দাবদাহে দগ্ধ হচ্ছে, ঠিক সেই সময়ই আসাম, অরুনাচলপ্রদেশ, মিজোরাম, মেঘালয়, মনিপুর সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বড় অংশ ভয়াবহ বন্যায় বিধ্বস্ত। একরের পর একর চাষের জমি জলের তলায়, ভেঙে পড়েছে একাধিক সড়ক ও রেল ব্রীজ সহ অসংখ্য বাড়িঘর, প্রায় ৫০ হাজার মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়ে কোনরকমে দিন গুজরান করছেন।
অন্যদিকে ২০২১ সালের জুন-জুলাই মাসে গ্রীস, তুরস্ক, ব্রিটিশ কলম্বিয়া, কানাডা ও আমেরিকার কিছু কিছু অঞ্চলে তাপমাত্রা ছিল ৫০ ডিগ্রির আশেপাশে। ঐসব অঞ্চলে তীব্র তাপপ্রবাহ, শয়ে শয়ে দাবানল একদিকে যেমন মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে ছাড়ল, পাশাপাশি হেক্টরের পর হেক্টর বনাঞ্চল ও প্রচুর বন্যপ্রাণ দাবানলের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল। একই সময়ে গ্লোবের অন্য প্রান্তে চীন ও জাপান প্রবল বন্যায় নাস্তানাবুদ। আমাদের দেশেও মুম্বাই, চেন্নাই, দিল্লি, কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ন অঞ্চল প্রবল বৃষ্টিপাতে জলমগ্ন হচ্ছে বারবার, চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ব্যাপকভাবে, সর্বস্বান্ত হচ্ছেন কৃষক বন্ধুরা। গত বছর শীতকালে বারেবারে অসময়ের ভারী বৃষ্টিপাতে একরের পর একর কৃষিজমি জলের তলায় চলে যাওয়ায় কৃষিশস্য নষ্ট হলো, চাষীদের দুর্ভোগ বাড়ল, শাক সবজির দাম লাগামছাড়া হলো। এসবই আজ যেন নিউ নর্ম্যাল হয়ে গেছে।
অন্যদিকে দানবীয় ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েছে অনেক বেশি করে। ২০২২ সালে ১৮০ টির মতো ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বভাস দিয়েছে আবহাওয়া দপ্তর। তার মধ্যে ‘অশনির’ অশনি সংকেত কান ঘেঁষে বেরিয়ে গেছে।
পৃথিবীর গড় উষ্ণতা বেড়েই চলেছে, গলছে মেরুপ্রদেশ ও হিমালয়ের বরফের চাদর, বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর। অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটছে একই সময়ে বিশ্বের নানান প্রান্তে এবং আগামীদিনে এইসব চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে অনেক দ্রুত হারে–এই কথা আইপিসিসি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তাদের ষষ্ঠ রিপোর্টে। এখন আগুন আর শুধু বনে বা প্রতিবেশীর ঘরেই নয়, আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে প্রতিটি পরিবার, প্রতিটি মানুষকে।
বিপর্যয় মোকাবিলায় ভারত ডাহা ফেল:
অতি সম্প্রতি (৬ই জুন, ২০২২) প্রকাশিত (hindustantimes.org) একটি খবর এই আলোচনায় আসা উচিত। Environmental Performance Index (EPI-2022), অর্থাৎ পরিবেশগত পদক্ষেপ সূচকে ভারতের স্থান ১৮০ টি দেশের মধ্যে সবার নিচে (শেষের দিক থেকে ফার্স্ট বয়)। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও পরিবেশ-সংস্থা পরিবেশ ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকা নিয়ে এই রিপোর্ট তৈরি করে, যে সমীক্ষায় পরিবেশের স্বাস্থ্যরক্ষা, ইকোসিস্টেম অটুট রাখা এবং জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যার সমাধানে রাষ্ট্রের সদর্থক পদক্ষেপগুলোকে পর্যালোচনা করা হয়। সচ-ভারত, শকত-ভারত, সনাতন-ভারতের মতো একগুচ্ছ প্রকল্পের বাগাড়ম্বর শোনা গেলেও ইপিআই রিপোর্টে ১৮.৯ পয়েন্ট পেয়ে ভারত ডাহা ফেল। বিগত বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনে ‘নেট জিরো কার্বন এমিশন’ এর কথা আমাদের প্রধানমন্ত্রী স্বগর্বে ঘোষণা করলেও বোঝাই যাচ্ছে কাজের কাজ কিছুই হয় নি, প্রধানমন্ত্রীর আর পাঁচটি ঘোষণার মতো এটিও ঠুনকো প্রতিশ্রুতি হিসেবেই হয়ত রয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায়। অথচ ৭৭.৯ স্কোর করে এই পর্যালোচনায় ডেনমার্ক সবার শীর্ষে। এমনকি বাংলাদেশ, পাকিস্থান, মায়ানমার, তুর্কি, সুদানের স্কোর ভারতবর্ষ থেকে অনেক ভালো। ইপিআই রিপোর্টে ভারতের সবার নিচে চলে যাওয়ার পিছনে মূলত দায়ী করা হয়েছে– নির্বিচারে সবুজ বনানী ও বন সংহার, জীবাশ্ম জ্বালানির অপরিমিত ব্যবহার এবং অপরিকল্পিত অবৈজ্ঞানিক উন্নয়নকেই।
সমাধান কোন পথে:
আমাদের ভাবতে হবে নতুন দিশায়, নতুন তরিখায়। মার্কসবাদকে পড়তে হবে নতুন আলোকে, আজকের বাস্তবতায়। মার্ক্স, এঙ্গেলস লিবিগসহ সমাজতাত্ত্বিক দার্শনিকেরা এই পথ বাতলে দিয়েছেন ভাবিকালের বামপন্থীদের জন্য। কিন্তু আমরা এই নিয়ে সেভাবে চর্চা করিনি। বিপর্যস্ত প্রকৃতি-পরিবেশ, মানবসভ্যতা সহ তামাম প্রাণীকুলের অবলুপ্তি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন হলেও আমাদের দৈনন্দিন কাজের পরিসরে এইসবকে সেভাবে ঠাঁই দিই নি।
তবে আশার কথা– পরিবেশ বিপর্যয়, জল-স্থল- বায়ুর দূষণ, ভূউষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র অভিঘাতে বর্তমানে কিছুটা মাত্রায় হলেও মানুষের টনক নড়ছে, মানুষ ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন। বামধারার রাজনৈতিক দলগুলোও পরিবেশ বিপর্যয়কে ভাবনাচিন্তার পরিসরে আনছেন, বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও এগিয়ে আসছেন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো গান-কবিতা- থিয়েটার- ফিল্মকে পরিবেশের আঙ্গিকে সাজিয়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার সমাধানে ও পরিবেশ মেরামতির দাবিতে বিশ্বজুড়েই কচি-কাঁচাদের সোচ্চার বিক্ষোভ প্রতিবাদ জারি আছে বিগত কয়েক বছর ধরে। সংঘঠিত হয়েছে বেশ কয়েকটি ‘আন্তর্জাতিক জলবায়ু ধর্মঘট’। প্রাণ প্রকৃতির বিপর্যয় ক্রমে ক্রমে মানুষের ভাবনাচিন্তার পরিধির মধ্যে স্থান করে নিচ্ছে। এই ভাবনাগুলোকে ছড়িয়ে দিতে হবে শহর থেকে গ্রামে, ক্ষেতে-খামারে, পাড়ায়- মহল্লায়, দৈনন্দিন আড্ডার পরিসরে এমনকি কারখানার প্রতিটি শেডে। নিজেদের ও পরবর্তী প্রজন্মকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সব কাজের অগ্রভাগে নিয়ে আসতে হবে প্রকৃতি মেরামতির দাবিকে। হাতে এখনো যেটুকু সময় আছে, এক্ষুনি সঠিক বৈজ্ঞানিক পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে আমরা নিশ্চিতরূপে পৌঁছে যাব ‘পয়েন্ট অফ নো রিটার্ন ‘ র দেশে।
হাতে আর সময় নেই বন্ধু। আমাদের অতি প্রিয় সন্তান-সন্ততি ও নাতি-পুতিদের জন্য দূষণহীন বাসযোগ্য এক পৃথিবী রেখে যেতে হলে পরিবেশ মেরামতির দাবিতে সকলকে সম্মিলিতভাবে এখনই পথে নামতে হবে, এছাড়া অন্য কোন পথ নেই। মনে রাখতে হবে, এই মহাবিশ্বে আমাদের একটিই বাসযোগ্য ঘর আছে, যা হলো আমাদের অতি প্রিয়– এই নীল গ্রহটি।
সন্তোষ সেন : বিজ্ঞান শিক্ষক, বিজ্ঞান ও পরিবেশ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক।
