রাজনীতিতে ছাত্রদের অবদান

শ্রীরাধা বসাক
নেতৃত্ব গড়ার বাতিঘর হলো ছাত্র রাজনীতি। আজকে ছাত্রসমাজ ভবিষ্যতে জাতির নেতৃত্ব দেবে। বিশ্বের বিখ্যাত নেতাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তারাও একসময় আমাদের মতো ছাত্র ছিল। তাঁরা আমাদের মতো স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করার পর জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছাত্র রাজনীতি অতীতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস ও ঐতিহাসিক অর্জন রয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলন, যেখানে সুভাষচন্দ্র বসু, ভগং সিং, বিনয়,বাদল , দীনেশ প্রভৃতি ছাত্রের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন,১৯৬৭ সালের নকশাল আন্দোলন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্রসমাজ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য।
ছাত্র রাজনীতির নাম শুনলে আমাদের মনে দাবি আদায়ের ঝাণ্ডা বেজে ওঠে।এ আন্দোলন বাঙালি জাতির জীবনে এমনই এক ঘটনা, যেটার রেশ দাবি আদায়ের পরেও থেকে যায়। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার শিক্ষা দেয়, যা থেকে জন্ম নেয় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকার আন্দোলনের পথ।১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ছয় দফা ও এগার দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন ও সর্বশেষ ’৭১-এ বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধেও ছাত্রদের ভূমিকা ও ত্যাগতিতিক্ষা ছিল চিরস্মরণীয়। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা।উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ছাত্র রাজনীতি বাংলার রাজনীতিতে একটি নতুন মাত্রা যোগ করে। বিশ শতকের প্রথম পাদে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করে। তবে এর আগে যে ছাত্র রাজনীতি একেবারেই ছিল না তা বলা যাবে না। পাশ্চাত্য শিক্ষার একটি বৌদ্ধিক প্রতিক্রিয়া হলেও তৎকালীন ইয়ং বেঙ্গল ছিল ছাত্রদেরই একটি আন্দোলন। এটি ছিল মূলত প্রচলিত নিয়মাচারের প্রতি এক ধরনের বিদ্রোহ। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী সামাজিক ও অন্যান্য ব্যাপারেও আগ্রহী ছিল, যেগুলি পরবর্তীকালে রাজনীতির অংশ হয়ে ওঠে। উনিশ শতকের সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা সঞ্চারের লক্ষ্যে একটি ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময়ে আনন্দমোহন বসু ছাত্রদের রাজনীতিতে যোগদানের আহবান জানান এবং ছাত্রদের রাজনীতি বিষয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান শুরু করেন। কিন্তু বিদ্যমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি, বিশেষত স্কুল ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কড়া শাসন ছিল ছাত্রদের রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে ওঠার পথে প্রধান বাধা। এ ছাড়া উনিশ শতকের শেষভাগের পূর্ব পর্যন্ত উপনিবেশিক সরকারের একটি চাকুরির জন্য কিছুটা বিদ্যার্জন ছিল সকল শ্রেণীর ছাত্রের সর্বোচ্চ উচ্চাভিলাষ।
বিশ শতকের গোড়ার দিকে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছাত্রদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণে প্রণোদনা জোগায়। জাতীয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ সত্ত্বেও ১৯২৮ সালে কংগ্রেসের উদ্যোগে নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি গঠিত হওয়ার আগে বাঙালি ছাত্রদের কোনো নিজস্ব সংগঠন ছিল না। এ সংস্থার সভাপতি ও সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে প্রমোদ কুমার ঘোষাল এবং যাদবপুর (জাতীয়) ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্র ও ছাত্র পত্রিকার সম্পাদক বীরেন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পন্ডিত জওহরলাল নেহরু, আর অতিথি বক্তা ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সংস্থার গঠনতন্ত্রের কাঠামো ছিল কংগ্রেসের আদলে তৈরি। একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল ও ১৯ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি নিয়ে সমিতির কাঠামো গঠিত হয়। গঠনতন্ত্রে উল্লিখিত না থাকলেও কার্যত নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি ছিল কংগ্রেসের ছাত্রফ্রন্ট।
এছাড়াও স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষে ১৯৬৭ সালের ২৫ মে তারিখে ঘটে নকশাল আন্দোলন। তখন নকশালবাড়ি গ্রামের কৃষকদের উপর স্থানীয় ভূস্বামীরা ভাড়াটে গুন্ডার সাহায্যে অত্যাচার করছিল।এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে ছাত্ররা।এরপর ছাত্র দের সাহায্যে কৃষকরা ঐ ভূস্বামীদের সেখান থেকে উৎখাত করে।৬৭ সালের মে মাসে দার্জিলিং এর নকশালবাড়ি নামের এক গ্রামের জনৈক বিমল কিষান আদালত থেকে তার নিজের জমি চাষ করার অনুমতি পান। কিন্তু স্থানীয় জোতদারদের গুন্ডারা সেই জমি ছিনিয়ে নেয়। চারু মজুমদার এবং কানু স্যান্যালের নেতৃত্বে গ্রামের নিম্নবর্গ মানুষ জোতদারদের আক্রমন করে জমি ফিরিয়ে দেবার দাবি জানায়। এই ঘটনার জের ধরে ২৪শে মে কুখ্যাত পুলিশ ইন্সপেক্টর সোনম ওয়াংগরি বিপ্লবীদের হাতে খুন হয়। আন্দোলন দমানোর জন্য পুলিশ বাহিনী নির্মমভাবে গুলি করে এগারো জনকে হত্যা করে যার মধ্যে আট জন মহিলা ও দুই জন শিশু। দুই মাসের মধ্যেই পুলিশ এই আন্দোলনকে চাপা দিয়ে ফেললেও এর আদর্শ শীঘ্রই পুরো বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে নকশালবাড়ি আন্দোলনের সূচনা করে যা পরবর্তী পাঁচ বছর স্থায়ী হয়। রাতারাতি চারু মজুমদার পশ্চিমবঙ্গই না শুধু, গোটা ভারতের বিশেষ করে তরুণ সমাজের নায়কে পরিণত হন। গ্রামবাংলার খেটে খাওয়া মানুষ এই আন্দোলনকে তাদের দুর্দশাগ্রস্থ জীবন থেকে উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র পথ হিসেবে দেখতে শুরু করে। ভোটের রাজনীতি যেহেতু স্বাধীনতার বিশ বছর পরও তাদের তেমন কোন কাজে আসেনি, তাই এই সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর হয় ভারতের প্রায় অর্ধেকের বেশি জনসাধারণ।বিপ্লবীদের নীতি ছিল জমির মালিকানা তথাকথিত মালিকপক্ষ থেকে কেড়ে নিয়ে সেখানে চাষীদের পূনর্বাসন করা এবং পুলিশ বা প্রশাসন মালিকের পক্ষ নিলে তাদেরকেও সশস্ত্র হামলা করা। বাংলার বেশ কিছু জায়গা নকশালদের পুরোপুরি দখলে চলে যায়। সবচেয়ে বেশি অংশগ্রহন করে উপজাতি সম্প্রদায় বিশেষ করে সাঁওতালরা যারা বছরের পর বছর যাবৎ শুধু নিগৃহিতই হয়েছে। অবিশ্বাস্যভাবে কলকাতার শীর্ষস্থানীয় কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সারির ছাত্রছাত্রীরাও সমাজ বদলের রোমান্টিসিজমে উদ্বুদ্ধ হয়ে বই-খাতা ফেলে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। ষাটের দশকে সারা পৃথিবী জুড়েই তরুণ সমাজের মধ্যে একটা অস্থিরতা চলছিল। নিয়ম রীতিকে ভেঙে চুড়ে নিজের মত করে তৈরী করার একটা প্রবনতা সেসময় ইউরোপ, আমেরিকায় প্রবল জনপ্রিয় হয়েছিল। বাংলার যুবসমাজও এই নিয়ম ভাঙার উচ্চাশায় নকশালবাদী দলে যোগ দেয়। এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল ছাত্রসমাজ। নকশাল আন্দোলনের মূল নীতি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং সাম্যবাদ।
বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিরও রয়েছে অতীত গৌরবময় ইতিহাস। এদেশের যত অর্জন কিংবা সাফল্য তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ছাত্র রাজনীতি। যখনই জনগণের ওপর কোন অন্যায় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, তখনই ছাত্ররা সরব হয়েছে সবার আগে। বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তন হয় ব্রিটিশদের আগমনের প্রায় ১০০ বছর পরে।ব্রিটিশদের অত্যাচার অনাচার থেকে মুক্তির জন্য ছাত্ররা বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। স্বদেশী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলনেও ছাত্ররা জনমত গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। এ দেশের ছাত্র রাজনীতির বর্ণাঢ্য ইতিহাস দখল করে আছে বামপন্থী ছাত্র রাজনীতি।১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ছয় দফা ও এগারো দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন ও সর্বশেষ ’৭১-এ বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রাম স্বাধীনতা যুদ্ধেও ছাত্রদের ভূমিকা ও ত্যাগ ছিল চিরস্মরণীয়। ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা।
বর্তমান সময়ে রাজনীতি বিশ্বের চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের আর্থসামাজিক জীবনে এমনকি শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও রাজনীতি সর্বব্যাপী প্রভাব ফেলেছে। বিশ শতকের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় পৃথিবীজুড়ে সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের ভাবাদর্শগত লড়াই বিশ্বকে আলোড়িত করেছে। পাশাপাশি ঔপনিবেশিক দেশগুলোতে চলেছে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নিপীড়ন। পরাধীনতার হাত থেকে মুক্তির লড়াইও চলেছে সমানতালে। ফলে ঔপনিবেশিক ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সমাজের সচেতন ও সংগ্রামী অংশ হিসেবে ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে।
শ্রীরাধা বসাক
পঠনপাঠন- বাংলা বিভাগ, বিশ্বভারতী। ( স্নাতক ও স্নাতকোত্তর)