• March 24, 2023

বিটলদের “ইন্ডিয়া”

 বিটলদের “ইন্ডিয়া”

দ্বিজিতা, ছাত্রী

১৯৬৭ সাল, সংগীত জগতে রক অ্যান্ড রোলের নতুন ঢেউ এসেছে জন লেনন, পল ম্যাকার্টনে, জর্জ হ্যারিসন ও রিঙ্গো স্টারের হাত ধরে। সার্জেন্ট পেপার লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড। এই অ্যালবামের বিশেষত্ব? অ্যালবামের একটি গানও সিঙ্গেল হিসাবে প্রকাশিত হবে না এই সিদ্ধান্ত বিটলসের। ২৬শে মে ১৯৬৭ প্রকাশিত হলো অ্যালবাম আর প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে হট কেকের মতো অ্যালবামের কপি বিক্রি শুরু। ৩ কোটির উপর কপি বিক্রি হয় এই অ্যালবামের সারা বিশ্বে। অ্যালবামের গান লোকের মুখে মুখে কিন্তু তার চেয়েও বেশি চর্চায় আসে এই অ্যালবামের কভারের ছবি। সেই সময় দাড়িয়ে প্রায় ৩৫০০ পাউন্ড খরচ হয় সেই ডিজাইন বানাতে। কে নেই সেই ছবিতে। বিশ্বের সকল প্রান্তের সর্বকালীন জিনিয়াসরা একই ফ্রেমে।অ্যালবার্ট আইনস্টাইন থেকে মেরিলিন মনরো।
সেই অ্যালবামেরই একটি বহুচর্চিত গান “উইদইন ইউ, উইদাউট ইউ”।বানানো হয় হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের আদলে। যা ছিল তৎকালীন সময়ে আন্তর্জাতিক স্তরে তৈরি সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বাণিজ্যিক ভাবে সফল হিন্দুস্তানী ফিউসন। এই গানটির কম্পোজিশন ছিল সম্পূর্ণ জর্জ হ্যারিসনের মস্তিষ্কপ্রসূত ও এই গানে ৪ জন ভারতীয় শিল্পী কাজ করেন এসরাজে আন্না যোশী ও অমিত গুজ্জার, তানপুরায় বুদ্ধদেব কানসারা ও তবলায় নটবর সিংহ।এছাড়াও “নরওয়েইয়ান উডস” নামক আরেকটি গানে হ্যারিসন নিজেই সেতার বাজান।

১৯৬৬ সালে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে হঠাৎই দা বিটলস এর মনে হয় তারা তাদের বিলাসিতার জীবন থেকে কিছু সময়ের জন্য বেরোবে, বিটলস ছাড়াও তাদের নিজস্ব অস্তিত্বকে নতুন করে আবিষ্কার করবে বলে। মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্যাম উইলস পরিচয়ে হ্যারিসন সস্ত্রীক পদার্পণ করেন বোম্বাইতে, যোগ ও সেতার সাধনার উদ্দ্যেশ্যে। ভারত ভ্রমণ -এ হ্যারিসন পণ্ডিত রবিশঙ্করের থেকে নিয়মিত সেতারের তালিম নিতেন। এই সময় হ্যারিসন ও তার স্ত্রী প্যাটি বেনারস যান। হ্যারিসনের আত্মজীবনীতে তিনি বলেন যে বেনারসের সাধু ও চরোষ তাকে অ্যালেন গিন্সবার্গ-এর কথা মনে করায়। এই অ্যালেন গিন্সবার্গ হলেন ভারতীয় সংগীত ও সংস্কৃতির সঙ্গে পাশ্চাত্য দুনিয়ার অন্যতম যোগসূত্র। তৎকালীন সময়ের বিখ্যাত কবি গিন্সবার্গ ও তার সঙ্গী পিটার ওরোলভস্কী ১৯৬২ সালে ভারতে আসেন তার সূত্র ধরেই বিটলস-এর আগে বব ডিলানও ভারতীয় সংগীত চর্চায় আগ্রহ দেখান।ডিলানের ম্যানেজার আলবার্ট গ্রসমেনের সঙ্গে গিন্সবার্গ ভারতীয় সংগীতের পরিচয় করান।গ্রসমেন সেইখান থেকেই ভারতীয় সংগীতকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশে বাংলার বিখ্যাত দুই শিল্পী লক্ষ্মণদাস ও পূর্ণদাস বাউলকে ম্যানেজ করার সিদ্ধান্ত নেন। ডিলানের অ্যালবাম “জন ওয়েসলি হারডিং”-এর কভারে ১৯৬৭ সালে এই দুই বাঙালি শিল্পীকে আমরা দেখতে পাই আর ঠিক সেই বছরেই সার্জেন্ট পেপার লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ডের কভারে আমরা দেখতে পাই বব ডিলানকে। ডিলানের পাশাপাশি এই অ্যালবামের কভারে আরো কৃতি ব্যক্তিত্বদের মধ্যে দেখা যায় শ্রী যুক্তেশ্বর গিরি, শ্রী মহাবতার বাবাজি, শ্রী লাহিড়ী মহাশয় এবং পরমহংস যোগানন্দ।এদের আধ্যাত্মিক সাধনার প্রতি আগ্রহ হয় জর্জ ও প্যাটির।
সার্জেন্ট পেপার লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ডের প্রকাশের মাত্র দুমাসের মধ্যে আগষ্ট ১৯৬৭তে বিটলস নিজেদের আধ্যাত্মিক যাত্রা শুরু করে মহর্ষি মহেশ যোগীর মার্গদর্শনে বাঙ্গোর, উত্তর ওয়েলস এর ১০দিনের একটি ট্রানসডেন্টাল মেডিটেশন ক্যাম্প থেকে… বিটলস ঘোষণা করে যে তারা মাদকআসক্তি থেকে চিরতরে বেড়িয়ে আসার পন নিয়েছেন, কিন্তু তাদের তৎকালীন ম্যানেজার ব্রায়ান এপস্টিনের মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তারা সেই ক্যাম্প মাঝ পথে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর মহর্ষির আবেদনে ১৯৬৮-তে বিটলস নিজেদের আধ্যাত্মিক যাত্রা সম্পূর্ণ করতে চলে আসে ভারতের ঋষিকেশের চৌরাশি আশ্রমে যা মহর্ষি বানিয়ে ছিলেন তার এক আমেরিকান ব্যবসায়ী শিষ্যের অনুদানে। এই ঘটনা তৎকালীন সরকার বেশ সন্দেহজনক বলে আশঙ্কা করে ও রাশিয়ান ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি কেজিবি তাদের দূত ইউরি বেস্মেনোভকে সেই আশ্রমে পাঠায়। ইউরি অবশ্য এই ঘটনাকে কোনো বিপদ নয় বরঞ্চ তৃতীয় বিশ্ব দেশের সঙ্গে আমেরিকার সুসম্পর্ক স্থাপনের প্রতীক হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। বিটলসের কাছে এই আশ্রমে থাকার অভিজ্ঞতাকে পল ম্যাকার্টনে একটি সামার ক্যাম্পের সঙ্গে তুলনা করেন… হ্যারিসন এখানে এসে সম্পূর্ণ ধ্যানমগ্ন ভাবেই তার দিন যাপন করলেও জন লেনন জীবন দর্শন বিষয়ক তার সকল প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই বেশী আগ্রহী ছিলেন ও এই আগ্রহ থেকেই সে মহর্ষিকে খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করতেন।

এই আশ্রমে দিন কাটানো সময়ে বিটলস মোট ৪২টি গান তৈরি করে যার বেশীর ভাগটাই প্রকাশিত হয় তাদের পরবর্তী “হোয়াইট” অ্যালবামে। এই অ্যালবামের গানগুলিতে হিংস্রতার উল্লেখ নিয়ে মহর্ষির আপত্তি থেকেই বিটলসের সঙ্গে আশ্রমের মনমালিন্যের সূত্রপাত হয় ও পরে বেটেলসের অ্যাসোসিয়েট অ্যালেক্স মার্তাস আশ্রমবাসী মহিলাদের সঙ্গে মহর্ষির কুরুচিকর আচরণ নিয়ে সাওয়াল তোলেন। এমন সময় পল ম্যাকার্টনে ও রিংগো স্টার আশ্রম ছেড়ে দেন ও তার কিছু সময় পরেই মিয়া ফেরো নামক এক অভিনেত্রী মহর্ষির তার প্রতি আপত্তিজনক ব্যবহার নিয়ে মামলা করলে জন লেননও আশ্রম ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশ্য আরেক আশ্রমবাসী কানাডিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক পল সাল্টজম্যান জানান যে মহর্ষি বিটলসের অ্যালবাম “হোয়াইট” ও আশ্রমে লেখা সকল গানের মুনাফার ২৫ শতাংশ দাবি করেছিলেন এবং তার প্রত্যুত্তরে বিটলস সাফ ইনকার করে আশ্রম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিটলসের সদস্যরা… লেনন ও ম্যাকার্টনে এই ঘটনায় এতই রাগান্বিত হয় যে পরবর্তীকালে পরোক্ষ ভাবে মহর্ষিকে “জালিয়াত” ইঙ্গিত করে লেখেন “দ্য মাহার্ষি সং” কিন্তু জর্জ হ্যারিসনের পরিবার মহর্ষির উপর লাগা সব লাঞ্ছনাকে অমূলক বলে ঘোষণা করে। মহর্ষি নিজের আশ্রম ছেড়ে অন্তর্ধান নেয়।
এই ঘটনার দুবছর পরেই “দ্যা বিটলস” ভেঙে যায়।
স্বামী বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের পর পাশ্চাত্য সভ্যতা ভারতের ঐতিহ্যর উপর আগ্রহ দেখানোর একটা বিরাট কারণ হিসাবে দ্যা বিটলসকে দেখে। এমন একটা সময় যখন ঈশ্বরের থেকেও উপরে বিটলসকে স্থান দিচ্ছিল পাশ্চাত্যের মানুষরা তখন আধ্যাত্মিকতার ও জীবন দর্শনের খোঁজে সেই বিটলস এসে পরে তৃতীয় বিশ্বের দেশে যাকে সকলে কেবল যাযাবর ও সাপুড়ের দেশ বলে গণ্য করতো… বিটলসের ভারতীয় পোশাক পরিচ্ছদে সাত্ত্বিক জীবনযাপনের ছবি বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ছাপতো অহরহ যা মানুষের ভারতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়।আর ভারতেও বিটলস ডিলানের ঘরানার সংগীত চর্চার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় ব্যান্ড কালচার। মহীনের ঘোড়াগুলি, কবীর সুমনের হাত ধরে আসে বাংলা গানের যুগান্তর।

দ্বিজিতা, ছাত্রী, ছাত্রী ,বিশ্বভারতী 

Leave a Reply

Your email address will not be published.