ভ্যাক্সিন-রাজনীতির কুটিল নোংরা আবর্তে বিশ্ববাসী

কোভিদের দ্বিতীয় ঢেউতে ভারতের অবস্থা শোচনীয়। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত ভারতে আসতে চলেছে এই মহামারীর তৃতীয় ঢেউ।
জয়ন্ত ভট্টাচার্য (বিশিষ্ট চিকিৎসক,গবেষক ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের কর্মী) :- টাইমস অফ ইন্ডিয়া-র “Much More Required” শিরোনামের সম্পাদকীয়তে (২৩.০৬.২১) বলা হয়েছে – “সরকারকে মানুষের কাছে ভ্যাক্সিন পৌঁছে দিতে হবে, ছোট প্রাইভেট গোষ্ঠীকে সংযুক্ত করতে হবে এবং যথাসময়ের ব্যবধানে কতটা সরবরাহ করা হল সে বিষয়ে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট তথ্য উন্মুক্ত করতে হবে।” এ বক্তব্য থেকে বুঝতে অসুবিধে হয়না যে ভারতে সবার জন্য ভ্যাক্সিনের ব্যবস্থা করা কেবলমাত্র জনস্বাস্থ্যের অঞ্চলে নেই – সরকারের সদিচ্ছা এবং স্বচ্ছ ও স্পষ্ট তথ্যকে সবার সামনে খুলে দেবার মতো রাজনৈতিক বিষয়ও এর অংশ। অন্যভাবে বললে, ভ্যাক্সিন স্বাস্থ্যের গণ্ডি অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এর নাম দেওয়া হয়েছে “ভ্যাক্সিন ন্যাশনালিজম” বা ভ্যাক্সিন জাতীয়তাবাদ। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশগুলো।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর মতো মান্য পত্রিকায় “From Vaccine Nationalism to Vaccine Equity – Finding a Path Forward” (এপ্রিল ৮, ২০২১) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে – “বহুসংখ্যক দরিদ্রতম দেশে ভ্যাক্সিনের সরবরাহের কোন অস্তিত্বই নেই, এবং বিশেষজ্ঞরা অনুমান করছেন কম-সম্পদ সম্পন্ন ৮০% দেশে এ বছর (২০২১) একটিও ভ্যাক্সিন পাবেনা।”

নেচার-তুল্য জার্নালে প্রকাশিত এ ডায়াগ্রাম থেকে সহজেই বোঝা যায় আন্তর্জাতিকভাবে মোট ভ্যাক্সিনের শেয়ার ধনী ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে কি বিপুল বৈষম্য তৈরি করেছে। নেচার-এ গ্যাভিন ইয়ামি (যিনি ডারহাম ইউনিভার্সিটি, নর্থ ক্যারোলাইনার সেন্টার ফর পলিসি ইম্প্যাক্ট অন গ্লোবাল হেলথ-এর ডিরেক্টর) “Rich countries should tithe their vaccines” (২৫.০২.২০২১) শিরোনামে একটি প্রবন্ধে যে বিষয়গুলোর ওপরে জোর দিলেন সেগুলো হল – (১) কোভিড-১৯ প্রতিরোধের লক্ষ্যে ১৯ কোটির বেশি ডোজ দেওয়া হয়েছে (জনস হপকিন্স সেন্টার-এর ২.০৩.২০২১-এর হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ২৫ কোটি টিকা দেওয়া হয়েছে যা গত এক সপ্তাহে ১৭% বৃদ্ধি পেয়েছে), (২) এর ৩/৪ অংশ দেওয়া হয়েছে মাত্র ১০টি ধনী দেশে, (৩) এই ১০টি ধনী দেশের জিডিপি পৃথিবীর মোট জিডিপির ৬০%, (৪) ২৫০ কোটি জনসংখ্যার ১৩০টি দেশে একটিও ভ্যাক্সিনের ডোজ দেওয়া হয়নি, (৬) উচ্চ আয়ের দেশ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৬%, কিন্তু এরা অর্ধেকের বেশি ভ্যাক্সিন কিনে নিয়েছে। তিনি মন্তব্য করেছেন – “When SARS-CoV-2 transmission is wildly uncontrolled, the virus has more scope to evolve into dangerous variants.” অবহেলিত দেশগুলোর কাছে ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেবার জন্য COVAX (GAVI, CEPI এবং WHO-র যৌথ উদ্যোগ) এগিয়ে এসেছে। ১৯০টির কাছাকাছি দেশ COVAX-এ যোগদান করেছে। কোভ্যাক্স আশা করছে ২০২১-এর শেষাশেষি ২০০ কোটি ডোজ কিনতে পারবে। কিন্তু ধনী দেশগুলো ইতিমধ্যেই ৫৮০ কোটির বেশি ডোজ কিনে নিয়েছে ভ্যাক্সিন উৎপাদক সংস্থাগুলোর সাথে সরাসরি চুক্তি করে।
প্রবন্ধ লেখকের আশঙ্কা যদি পৃথিবীর সব দেশে টিকাকরণ প্রক্রিয়া ঠিকমতো না হয় তাহলে এই অতিমারি আরও ৭ বছর প্রলম্বিত হবে। এবং আন্তর্জাতিক অর্থনীতি হয়তো ৯ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইয়ামির সিদ্ধান্ত – “It is in everybody’s interests to act collectively to boost vaccinations. It is self-defeating to act otherwise.”
২১.০৬.২১ পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী – পৃথিবীর ২১.৮% মানুষ কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনের অন্তত একটি ডোজ পেয়েছে। বিশ্বজুড়ে ২৭০০ কোটি ডোজ এখনো অব্দি দেওয়া হয়েছে। এখন প্রতিদিন গড়ে ৩ কোটি ৮০ লক্ষ ডোজ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে দরিদ্র দেশগুলোর মাত্র ০.৯% মানুষ অন্তত ১টি ডোজ ভ্যাক্সিন পেয়েছে।
COVID-19 vaccine doses administered per 100 people, Jun 19, 2021
United Arab Emirates 145.89
Israel 122.94
Bahrain 113.57
United Kingdom 108.66 (Jun 18, 2021)
United States 94.82
Germany 78.46 (Jun 18, 2021)
Italy 75.39
France 70.62 (Jun 18, 2021)
China 70.21
Brazil 40.68
India 19.63 (World 33.63I)
নীচের ছবিটি আরও ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে সাহায্য করবে। এবং এটাও বোঝা যাবে যে ভারতের অবস্থান ঠিক কোথায় – প্রচুর ঢক্কানিনাদ এবং “বিশ্বগুরু” হবার প্রবল আয়োজনের পরেও।

এরকম বিপুল বৈষম্যের একটি প্রধান কারণ হল ভ্যাক্সিন তৈরির আগেই ধনী দেশগুলো ভ্যাক্সিন প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির সাথে চুক্তি করে নিজেদের দেশের জন্য যা প্রয়োজন তার অনেক বেশি কিনে রেখেছে।

ভ্যাক্সিন না নিলে দেশের মোট জাতীয় আয় বা জিডিপিতে ক্ষতি কি হবে?
আমরা নীচের টেবিল থেকে এটা বুঝতে পারবো।
Detailed Change in GDP in Billions
Location | World without vaccine | Vaccine nations have access | All high-income and vaccine nations have access | All high- and middle-income plus vaccine nations have access |
World | -$3,449 | -$1,232 | -$292 | -$153 |
EU-27 | -$983 | -$311 | -$76 | -$40 |
USA | -$480 | -$127 | -$30 | -$16 |
China | -$356 | -$110 | -$27 | -$14 |
UK | -$145 | -$41 | -$10 | -$5 |
India | -$88 | -$26 | -$7 | -$3 |
Russia | -$52 | -$18 | -$5 | -$2 |
Other middle-income† | -$147 | -$65 | -$30 | -$6 |
Other low-income‡ | -$200 | -$82 | -$35 | -$28 |
দরিদ্র ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেবার জন্য COVAX নামে একটি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অভীপ্সা অত্যন্ত শুভ এবং মানুষের জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু একদিকে ভ্যাক্সিন সাম্রাজ্যবাদ, অন্যদিকে ভ্যাক্সিন জাতীয়তাবাদ এ কাজের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো প্রতিবন্ধক। ল্যান্সেট-এ “A beautiful idea: how COVAX has fallen short” (জুন ১৯, ২০২১) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে – “COVAX has delivered over 72 million doses to 125 countries. But that is far less than 172 million it should have delivered by now. Of the 2.1 billion COVID-19 vaccine doses administered worldwide so far, COVAX has been responsible for less than 4%.” এটা কোন শ্লাঘার বিষয় নয় যে আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার অতি দরিদ্র দেশগুলোতে যখন ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে তখন লক্ষ্যমাত্রার ৪%-এরও কম পূরণ করা গেছে।
ল্যান্সেট-এর আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল (“A global compact to counter vaccine nationalism”, May 25, 2021) – “Vaccine nationalism threatens to turn the triumph of science to give the world vaccines against COVID-19 into tragedy.” পোলিও এবং স্মল পক্সের মতো কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রেও যতক্ষণ সবাই সুরক্ষিত না হচ্ছে ততক্ষণ কেউই সুরক্ষিত নয়।
নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল-এর পূর্বোল্লেখিত প্রবন্ধে বলা হয়েছিল – “These inequalities reveal a fundamentally flawed view of global health, and our global economy more broadly, in which vaccines and essential medications are treated as a market commodity rather than as a public good.”
ভারতবর্ষ সহ সবদেশেই, বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এখানে জনতার সংগঠিত দাবী এবং, এমনকি, স্বাস্থ্য আন্দোলনের প্রসঙ্গ আসে যেখানে প্রসগ্ন তুলতে হবে – পৃথিবীর মানুষকে বাঁচানোর ভ্যাক্সিন সর্বোচ্চ মুনাফাদায়ক পণ্য হবে কিংবা সবার প্রয়োজনে, সবার ব্যবহারের জন্য পাবলিক গুড হবে? স্বাস্থ্য কি সবচেয়ে অবহেলিত রাষ্ট্রিক নীতি হয়েই থাকবে? এই ভয়ংকর অতিমারি আমাদেরকে এরকম এক অতি কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

1 Comments
লেখাটা পড়লাম, ভ্যাকসিন নিয়ে যে রাজনীতি চলছে তা খুবই উদ্বেগের।