মগ্নপাষান

গল্প, উপন্যাস আমার খুবই পছন্দের জঁর। শরদিন্দুর ‘ঝিন্দের বন্দী’ নভেলখানা সবে শেষ করেছি। গৌরিশঙ্কর, কস্তুরি, ধনঞ্জয়, ময়ূরবাহনরা মাথায় ভর করে আছেন তখনো। অন্তিমপর্বে দুষ্টের দমন আর গৌরির অচল বৌদিকে লেখা চিঠি অথচ চিঠির শেষে গৌরির নিজের পরিচয়খানা মুছে আরেক পরিচয়ে পরিচিত হয়ে উঠা —- সব মিলিয়ে বেশ একটা দুঃখ সুখের মিশেল হাওয়া মনে। সেসময়টাতেই এক বন্ধু বললেন মগ্নপাষান বইখানা পড়ে দেখতে। দিদির বাড়ি বইখানা ছিলো। ঘটনাচক্রে আমিও তখন দিদির বাড়িতেই! পূর্ব অভিজ্ঞতা অনুযায়ী এই দিদির বাড়ি যে কখানা বই শুরু করেছি তার সবকটাই মনে এক অদ্ভুত দাগ কেটে রেখে গেছে। এ বইখানাও তার ব্যতিক্রম নয়।
ভারতের ইতিহাসে সম্রাট অশোকের নাম চিরকালীন। মৌর্য বংশের কুলপ্রদীপ এই মগধনরেশের বীরগাঁথা আজও জনমানসে যথেষ্ট কৌতূহল উদ্রেক করে। কলিঙ্গ যুদ্ধ এবং চণ্ডাশোকের ধর্মাশোকে উত্তরণের কাহিনী সকলেরই জানা। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক হিসেবেও অশোকের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। তাঁর শাসনকালে তৈরি স্তুপগুলি তো জনপ্রিয় পর্যটন স্থল। আর অশোক চক্র দেশের জাতীয় পতাকায় সমুজ্জ্বল।
কিন্তু এই অশোকের জীবনে রয়েছে এক অজানা অধ্যায়। সম্রাট বিন্দুসারের প্রয়াণের পর নিজের সহোদরদের হত্যা করে কীভাবে সিংহাসন লাভ করেছিলেন তিনি, তা নিয়ে ধোয়াঁশা আজও। সম্রাট পদে আসীন হওয়ার আগে তাঁর জীবনের বেশ কিছু বছরের হিসেব নেই ইতিহাসের পাতায়। লেখক সূর্যনাথ ভট্টাচার্যের এই আখ্যানে উঠে এসেছে সেই গল্পই।
সম্রাট বিন্দুসারের এক নিচ কুলের রানীর সন্তান ‘প্রিয়দর্শন’। রাজমহলে তাচ্ছিল্যের পাত্র সে। অগ্রমহিষীর সন্তান সুসীমের সাথে তাঁর দ্বন্দ্ব। তাঁর বন্য স্বভাবের জন্য প্রজারা ভয় পেতেন তাঁকে। সম্রাটের মৃত্যুর পর এক ভয়াল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয় পাটালিপুত্র। মগধের পরবর্তী নরেশ কে হবেন তা নিয়ে শুরু হল দুই ভাইয়ে ভয়ঙ্কর লড়াই, যা চলল দীর্ঘ চার বছর। এই দ্বন্দে নানা সময় নানা পাত্রের আগমন। জড়িয়ে গেল তিন্দারী গ্রামের হতভাগ্য, নিষ্পাপ নিবাসীদের ভবিষ্যৎও।
সূর্যনাথ ভট্টাচার্যের অসামান্য লেখনীর মাধ্যমে অশোকের জীবনকাহিনী এক অন্য মাত্রা পায়। তাঁর ভাষার দক্ষতা, লেখায় অপ্রচলিত শব্দকোষের মন্ত্রমুগ্ধকর ব্যবহার বাংলা ভাষাপ্রেমী হিসেবে সমৃদ্ধ করে পাঠককে। গল্পের ঠাসবুনোট ও নাটকীয়তার সংমিশ্রণ বিবশ করে একনাগাড়ে বইটি পড়ে যেতে। আর শেষ পাতার পর রবীন্দ্রনাথের অমোঘ সেই লাইনের কথা মনে পড়ে, ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ – ইচ্ছে হয় যেন শীঘ্রই এই আখ্যানের সিক্যুয়াল প্রকাশ হয়।
ইতিহাসধর্মী লেখা আজকাল প্রকাশিত হচ্ছে প্রচুর। কিন্তু অধিকাংশ কাজই পাতে দেওয়ার মত নয়। মধ্যমতার এই ভিড়ে ‘মগ্নপাষাণ’ অবশ্যই তফাতে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।
বইটির প্রেক্ষাপট আড়াই হাজার বৎসর পূর্বের মগধ সাম্রাজ্য। সময়কাল সম্রাট বিন্দুসারের মৃত্যুপরবর্তী চারবছর। যে সময়টা সমস্ত মগধ সাম্রাজ্য জুড়ে চলছিলো অরাজকতা, গুপ্তহত্যা, ষড়যন্ত্র, সিংহাসন দখলের রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত। বইটির কাহিনী যাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে তিনি মগধ সাম্রাজ্যের কনিষ্ঠ রাজকুমার। প্রিয়দর্শন। মাতৃকুলের বংশকৌলিন্য নেই। তাই রাজকুমার হলেও সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী তিনি নন। প্রজারা ভয় পায় তার চন্ডরূপকে । ‘স্বভাবে উগ্র, সিদ্ধান্তে হঠকারী, পরিচয়ে বন্য! শুধু মানবিকতার প্রশ্নে তিনি দেবতাকেও ভয় পান না।’- এই দুই লাইন ই পাঠকের মনে কনিষ্ঠ কুমার সম্পর্কিত যাবতীয় ধ্যান ধারনা গড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ২৬৩ পাতা জুড়ে রচিত হয়েছে সেই ‘বন্য রাজকুমারে’র আখ্যান। তাঁর চন্ড থেকে ধর্মে উত্তরণ। ধর্মরাজ্য স্থাপনের সংকল্প নিয়ে আর্যাবর্তের সর্বকালীন সর্বশ্রেষ্ঠ এক সম্রাট হয়ে উঠার যাত্রা।
বইটির প্রাককথনে লেখক নিজেই বলেছেন, ‘এ উপন্যাস সম্রাট অশোকের জীবনালেখ্য নয়। তিনি এই আখ্যায়িকার নায়ক নন…. তিনি এখানে প্রিয়দর্শন নামে উপস্থিত।” তারপর প্রাককথনের তৃতীয় প্যারায় লেখক জানিয়েছেন, এ উপন্যাসের কাহিনী সম্পূর্ণত কাল্পনিক। সুতরাং ঐতিহাসিক সত্যাসত্য, যুক্তিতর্কের নিরিখে পাঠ এ বই দাবী করে না। বরং তাতে উপন্যাসটি পাঠের রসমাধুর্য বিনষ্ট ই হবে। সম্রাট বিন্দুসারের মৃত্যুপরবর্তী সময়ে মগধের রাজকার্য কিভাবে পরিচালনা হয়েছিলো এবং কিভাবেই বা বংশকৌলিন্যহীন বন্য রাজকুমার আর্যাবর্তের সুমহান সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারীরূপে সিংহাসনে আরোহন করলেন, তার চন্ড থেকে ধর্মে উত্তরণের কারন কি শুধুই কলিঙ্গ যুদ্ধ নাকি সে যুগের সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদ, ঘৃণ্য বর্ণবাদের বিপরীতে মানবিক গুণের বলেই তিনি আকর্ষিত হয়েছিলেন বৌদ্ধধর্মের প্রতি – মূলত এ উপন্যাসে এই প্রশ্নগুলোরই উত্তর অন্বেষন করেছেন লেখক। ঐতিহাসিক উপাদানের সাথে কল্পনা মিশিয়ে।
প্রিয়দর্শন বাদেও এই উপন্যাসের প্রত্যেকটা চরিত্রকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে ফুঁটিয়ে তুলেছেন লেখক। তারা প্রত্যেকে বড় মায়াময়। উজ্জ্বল। কারুবাকি, কারুমালি, সুবর্ণ, জয়ন্ত, সুসীম, টিয়ারেস, আচার্য কাকন্দ, ভিক্ষু নরোপা, আসন্ধিমিত্রা, রানি বেদিশা, মহীন্দ্র, সঙ্ঘমিত্রা – সবাই খুব জীবন্ত। স্বমহিমায় উজ্জ্বল। পড়তে পড়তে প্রতারক জয়ন্তকে ঘৃণা হলেও ভিক্ষু অমিত্রসিদ্ধিকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। অশ্বলেখার জন্য মনের ভেতরে কেমন যেন শূণ্যতা ছড়িয়ে থাকে। মৃত্যুসজ্জায় যখন অশ্বলেখা অমিত্রসিদ্ধিকে বলে,” এত দেরীতে তোমার সময় হলো?” – গলার মাঝে দলাপাকিয়ে কান্না উঠে আসে হঠাৎ..! সুবর্ণের উদারতা, ভালোবাসার জন্য অপেক্ষার কাছে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে ইচ্ছে হয়। আর কারুবাকি…. রুবা… বিম্বের জন্যে অপেক্ষায় থাকা সে তপস্বীনিকে বিম্বের কাছে ফিরে আসার জন্য কেন যেন খুব রাগ হয় শেষে!
আর প্রিয়দর্শন…! সবশেষে তার নির্দেশে তিন্দারির পাহাড়ের গায়ে প্রোথিত হওয়া অনুতপ্ত পিতৃহৃদয়ের বিলাপ, অপত্যশোকের মর্মান্তিক হাহাকারের মাঝে তার পূর্বের সমস্ত হঠকারি আচরন, রূঢ় ব্যবহার এমনকি আত্মজহত্যাও ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছে হয়! অনুতপ্ত এক বৃদ্ধ সম্রাটের প্রতি ক্ষোভ বা রাগ নয়, অদ্ভুত এক দুঃখে ভারী হয়ে আসে মন।
গোটা উপন্যাসটির দৃশ্যায়ন খুবই অসাধারন। বিশেষত সবশেষে কলিঙ্গ যুদ্ধের দৃশ্যকল্পটি। এতোটাই নিখুঁত এবং সুন্দর দৃশ্যায়ন যে কলিঙ্গরাজের বিধবা স্ত্রী-পুত্রও যেন চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেন! উপন্যাসটির ভাষা এবং বর্ণনাভঙ্গি অসাধারন। তৎসম শব্দের ব্যবহার, যুগোপযোগী শব্দচয়ন, প্রাচীনগন্ধী ভাষা উপন্যাসটির গুরুগম্ভীর ভাবের সাথে সাথে আলাদা মাধুর্য এনে দিয়েছে। অথচ এই গুরুগম্ভীর ভাষা কোথাও পাঠকের পড়ার গতি শ্লথ করে না। বরং সাবলীল ভাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা নেশার মতো শেষ হতে থাকে।
আর যা মন কাড়ে তা হলো বইটির প্রচ্ছদ। অসাধারন আঁকা এবং বইটির বিষয়ের সাথে একদম যথাযথ।
এককথায় উপন্যাসটি অদ্ভুত রকমের ভালো। ঐতিহাসিক জঁর যাদের পছন্দ এই বইটি পড়ে দেখতে পারেন। ঠকবেন না এটা নিশ্চিত। বরং পাঠ শেষে শরদিন্দুর ঐতিহাসিক গল্পগুলোর মতোই এক অদ্ভুত মনকেমনের ভালোলাগায় ভরে থাকবে মন। আর আমার মতো ভ্রমণপিপাসু পাঠকেরা তিন্দারি গ্রাম খুঁজতে যাওয়ার প্ল্যান কষতে থাকবেন মনে মনে… এ আমি নিশ্চিত।