• March 25, 2023

জোনাক জ্বলা সন্ধ্যা

 জোনাক জ্বলা সন্ধ্যা

রেজওয়ানা ফাতেমা স্বপ্না
প্রভাষক, ক্যান্ট পাবলিক স্কুল ও কলজ, পার্বতীপুর
:- চার বন্ধু। ডিউ, কনক, স্বপন ও রাফি এই ছুটিতে চলেছে স্বপনদের গ্রামর বাড়িতে। কারণ ডিউ ছেলেবেলা থেকে বিদেশে বেড়ে উঠেছে। দেশে ফিরে কখনও ঢাকার বাইরে যায়নি। ওরা সবাই স্বপনদের বাড়িত পৌঁছালো। সারাদিন ভীষণ হইহুল্লাড় করে দিন কাটল। তাদের দেখে মহে হতে লাগল, হঠাৎ করে তরুণ থেকে যেন কিশোর বয়সে ফিরে গিয়েছে তারা। কখনও গাছ থেকে ডাব পেড়ে খাওয়া, কখনও পুকুর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতার কাটা, বিল থেকে শাপলা ফুল তোলা, মাছ ধরা ইত্যাদি। গ্রামীণ জীবনের সব স্বাদ যেন একদিনে পেতে হবে এমন একটা ভাব ওদের। এ সবকিছু অবশ্য ওরা করছে ডিউয়ের জন্য।
পথ চলতে চলতলতে ছোট্ট একটা জলাশয়র সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো ডিউ।
এখানে কী হচ্ছে স্বপন?
ওরা দেখল একটা ডোবায় কিছু চাষী পাট থেকে আঁশ ছাড়িয় নিচ্ছে।
শোন, বাংলাদেশের সোনালী আঁশ বলা হয় পাটকে। জানিসতো?
হ্যাঁ জানি।
প্রথম মাঠে পাট গাছ হয়, সময় হলে সেই গাছ কেটে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়, যখন পচন ধরে তখন এভাবে গাছ থেকে আঁশ ছাড়িয়ে ধুয়ে শুকাতে হয়। এরপর এই আঁশ থেকেই সুতা…
স্বপনের কথা শেষ হতে না হতেই ডিউ পানিতে নেমে পড়ল পাটেরর আঁশ ছাড়াতে। কিন্তু পাট পচার বিশ্রী গন্ধে তার বমি করার যোগাড়। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গোসল খাওয়া শেষ করে বিকেল হতেই সবাই রওনা হল গ্রামের হাটে। সেখানে গুড়ের জিলাপি আর অতিরিক্ত চিনি দেওয়া চা খেল বাঁশেরর চটার তৈরি বেঞ্চে বসে। সন্ধ্যায় দোকানীরা যখন ছোট ছোট কেরোসিনের ল্যাম্প জ্বালানা শুরু করল তখন তারা বাড়ির পথে রওনা হল। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে স্বপনদের পুরানা জমিদারী স্টাইলের বাড়ির ছাদে চলে গেল ওরা। স্বচ্ছ শরতের আকাশ, আকাশে অগণিত তারা। যেন কেউ সারা আকাশ জুড়ে জুঁই ফুল ছড়িয়ে রেখেছে। ছাদে মাদুর বিছিয়ে আকাশের দিকে মুখ করে সবাই তারা গুণছিলো। হঠাৎ মোবাইলেরর শব্দে ছেদ পড়ল তারা গোনায়। ডিউয়ের বাবা ফোন করেছেন। ভদ্রলাক এরই মধ্যে ১৫-২০ বার ফোন করেছেন। ফোন রেখে ডিউ বলল, এই হল আমার বাবা, দেখেছিস তোরা, আমি যেন এখনও ছোট খোকা রয়েছি। কখন কী খাব, কী পড়ব, কী করব সবই যেন তার রুচিমত। ভাল লাগে না এত সব। তোদের বাবারাও কি এমন রব?’
স্বপন ও রাফি বলল বাবার সাথে তাদর বড়ই মধুর সম্পর্ক, একবারে বন্ধুর মত। রাফি আবার বলল সে আর তার বাবা নাকি একই শার্ট পড়ে, লোকে দেখে ববে যেন একবারেই দুই ভাই। সবার এই আলাচনার সময় কনক একবারে ভিন গ্রহের মানুষ। সে যেন কানে কথাই শুনছে না। অন্যরা সবাই তখন কনককে চেপে ধরেছে।…
কী রে? এমন ভ্যাবলাকান্তের মত মুখ করে বসে আছিস কেন? কিছু বল।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কনক বলল…
কী বলব রে। তোদের কারো মতই আমাদের অবস্থা না। আমি একবার নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। বাবা অনক কষ্ট করে নিজর সাধ্যের সবটুকু আমাদের পেছনে ব্যয় করেন। সংসারের টানা-পোড়েনে তার মুখ থেকে যেন হাসি পালিয়েছে সারা জীবনের মত। ইয়ার্কি-ঠাট্টা তিনি একদম পছদ করেন না। আর বন্ধুর মত ব্যবহার তো দূরর কথা। তাকে আমরা সবাই বদমজাজী আর বদরাগী বলে জানি, ভয়ে একদম কথা বলি না পর্যন্ত। একদিনের কথা সারা জীবন আমার মনে গেঁথে থাকবে। সেদিন আমাদের বাড়িতে বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন এসেছে। আমরা ভাইবানেরাও ছুটিতে এসেছি। বশ মজা হচ্ছে। বাবার এগুলা ভালা লাগছে না, তাই সে বাড়ির বাইরে হাঁটাহাঁটি করছে। হঠাৎ ইলকট্রিসিটি চল গেল। বাবা বেশ উঁচু গলায় আমাকে নাম ধরে ডেকে চলেছন—
কনক, তোরা সবাই বাইরে আয় একটা মজার জিনিস দেখে যা।
আমরা বেশ অবাক হয়ে আসছি আর ভাবছি বাবা দেখাব মজার জিনিস! এতো বিস্ময়কর ব্যাপার। তবে বাইরে এসে আমরা সবাই নির্বাক হয়ে গেলাম। দেখলাম শত শত জানাকী পোকা বাড়ির সামনে ভিড় করেছে। এতো জোনাকী আমি একসাথে কখনও দেখিনি। মন হল আমি যেন বাবার হাত ধর শূন্যে ভাসছি। কখনও বাবার সাথে মাঠে দৌড়াচ্ছি, কানামাছি খেলছি আবার খুনসুটি করছি। আমি তখন স্বপ্নলোকের বাসিদা। হঠাৎ বাতি জ্বলে ওঠায় আমার স্বপ্ন ভঙ্গ হল। চোখ দুটো তখন আমার ছলছল কর উঠল। মনে হল এই বাবাকে আমি ভুল বুঝি! তার থেকে দূরে সরিয়ে রাখি নিজেকে? এত রোম্যান্টিক সে? এত আবেগ তার? এত ভালো আমার বাবা!জোনাক জ্বলা সেই সন্ধ্যাটা সারা জীবনেরর জন্য আমার মনের ফ্রেমে গাঁথা হয়ে আছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post