• June 1, 2023

অমল ও দইওয়ালা: বর্তমান প্রেক্ষিত

 অমল ও দইওয়ালা: বর্তমান প্রেক্ষিত

রণিতা ভট্টাচার্য

বহুদিন আগে অমলের কঠিন অসুখ হয়েছিল। সে বহুদিন ঘরবন্দী ছিল। একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে আমরা আবার গৃহবন্দী। মারণ রোগ আমাদের চোখ রাঙাচ্ছে। আর আমরা জীবনকে দিয়েছি বন্দিদশা।
জানালা দিয়ে বাইরের জগত ধরা দেয় চোখে। অমল বসে থাকত,দইওয়ালার সাথে গল্প করত শ্যামলী নদীর তীরে পাহাড়ের তলায় তাদের গ্রামের। লাল রঙের রাস্তা চলে গেছে গ্রামে। মেয়েরা নদী থেকে কলসী করে জল নিয়ে যায়।
অমলের শিশুমনে ভালোলাগা থেকে যায় দইওয়ালার হাঁকে। সে তার মতো করেই তুই বাচা শিখতে চাইলে দইওয়ালা তাকে বোঝায় যে প্রচুর পুঁথি পড়ে অমল একদিন পন্ডিত হবে।
বর্তমান সময়ে কী ভীষণ রকম প্রাসঙ্গিক দইওয়ালার বলা কথাগুলো। ঘরবন্দী শৈশব কাটছে যাদের, প্রচুর পুঁথি পড়ে একদিন তাদের পন্ডিত হতেই হবে। দইওয়ালার সুর শোনার তো তার সময়ই নেই। একদিকে মারণব্যাধির ভীতি, অন্যদিকে এগিয়ে চলা সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা।
অমল কল্পনা করেছে দইওয়ালার গ্রামে যাওয়ার পথ।তার মন উদাস হয়ে ওঠে আকাশের শেষ থেকে পাখির ডাক ভেসে এলে। সে যেন দেখতে পায় পাহাড়ের গায়ে গরু চরে বেড়াচ্ছে। যে দইওয়ালা প্রথমে অমলকে বলেছিল, সে দই না নিলে বেলা বইয়ে দিচ্ছে কেন? সেই দইওয়ালাই তাকে যাওয়ার সময় দই দিয়ে চাই পয়সা নেই জানা সত্ত্বেও। সে যে অমলের সাথে কথা বলে খুঁজে পেয়েছে তার দই বেচার সুখ। যা দৈনিক প্রয়োজনকে ছাড়িয়ে গেছে।
এমনই তো কত পেশার মানুষজন রয়েছেন আমাদের আশেপাশে। একটুখানি ভালোবাসায় খুঁজে পান বাঁচার রসদ। যে অমল ঘরবন্দী সেও অনাবিল এক আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারে সহজ সরল দইওয়ালার জীবন।
দইওয়ালা অমল কে জিজ্ঞেস করেছিল, সে জানালায় বসে আছে কেন? কি হয়েছে তার? কেন তার বন্দীদশা? অমল তাকে জানিয়েছে সে জানে না তার কি হয়েছে। তাকে কবিরাজমশাই বাইরে যেতে মানা করেছেন বলে, সে সেখানেই বসে থাকে।
কি অদ্ভুত মিল এতগুলো বছর পেরিয়েও। আমরা আজ জানিনা, কি হয়েছে আমাদের। কি চলছে চারপাশে। শুধু ডাক্তাররা আমাদের বাইরে যেতে না করেছেন। তাই আমরা ঘরবন্দী। কংক্রিটের শহরে দইওয়ালা সুর নেই, তাই কল্পনাও আজ স্তব্ধ।
অমল আর দইওয়ালার কথা হয়েছিল, কবিরাজমশাই অনুমতি দিলেই অমলকে নিজের গ্রামে নিয়ে যাবে দইওয়ালা।
আর আজ যখন আমরা এগিয়ে এসেছি অনেকটা পথ বিজ্ঞানের হাত ধরে, তবু আমরা জানি না ডাক্তাররা কবে আমাদের অনুমতি দেবেন মুক্ত বাতাসে ছোটার। ঘাসের ওপর দৌড়ে প্রজাপতি ধরব কবে।
“অমল ও দইওয়ালা” রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এক অনবদ্য সৃষ্টি। তার অন্যান্য সৃষ্টির মতই বর্তমান পরিস্থিতিতে এ যেন খুব প্রাসঙ্গিক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.