ইতু-কথা

সীমিতা মুখোপাধ্যায়
১
ঘুম ভেঙে উঠে বসল অক্ষর। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা। এটা কোথায় ও? পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল, পার্স কিছুই খুঁজে পেল না। চারদিকে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। কেমন একটা গন্ধ ভেসে আসছে। কখনো মনে হচ্ছে, অক্ষর একটা সুলভ শৌচাগারের মধ্যে পড়ে রয়েছে— চতুর্দিকে অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝালো গন্ধ। আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, গন্ধটা কেমন হাসপাতাল হাসপাতাল। না না, গন্ধটা যেন চিড়িয়াখানার। সামনের দিকে একটু এগোতেই গরাদে ধাক্কা খেল। তার মানে, ও জেলে! কিন্তু, কোন দোষে?
অক্ষর একটি বেসরকারি সংস্থার নিম্নপদস্থ কর্মচারী। অফিসের কাছেই একটা মেস ভাড়া করে থাকে। অবসর সময়ে লেখালেখি করে। অক্ষরের স্ত্রী অনিন্দিতা, হাইস্কুলের শিক্ষিকা। প্রেম করেই বিয়ে। একটি কন্যা সন্তানও আছে। তবে, ভয়ানক দাম্পত্য-কলহ। অক্ষর অশান্তির ভয়ে বর্তমানে মেসে গিয়ে থাকছে। সপ্তাহ শেষে মেয়ের টানে একবার করে বাড়ি যায়। যাওয়া মানেই ঝগড়া-ঝাটি। অনিন্দিতা আজকাল অক্ষরকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। যে-কবিতা লেখা নিয়ে ওদের প্রেমের শুরু, এখন সেই কবিতা নিয়েও অনিন্দিতার আপত্তি। অনিন্দিতা বলে— “লিখে কত টাকা পাচ্ছ? ওই সময়টা পারলে দুটো টিউশনি করো।” অক্ষর বড়ো আহত হয়। অক্ষরের রোজগার কম বলে অনিন্দিতা উঠতে-বসতে খোঁটা দেয়। অনিন্দিতার চোখে অক্ষর একটা অপদার্থ। এসব সত্ত্বেও, অক্ষর এখনো অনিন্দিতাকে ভালোবাসে, ভাবে— একদিন না একদিন অনিন্দিতা ঠিক বুঝবে, আবার সব আগের মতো হয়ে যাবে— প্রেমের দিনগুলো যেমন ছিল, বিয়ের প্রথম প্রথম সবকিছু যে-রকম ছিল, ঠিক তেমনি। অক্ষরের মনে পড়ল— শনিবার রাতে সে বাড়ি ফিরেছিল। সেদিন অনিন্দিতা অস্বাভাবিক রকমের ভালো ব্যবহার করছিল। অক্ষরের খুব ভালো লাগছিল। অফিস থেকে আসতে না আসতেই অনিন্দিতা ওকে এক গ্লাস ফলের রস খেতে দিয়েছিল। অক্ষর খুব তৃপ্তি করে খাচ্ছিল … কিন্তু, তারপর? তারপর অক্ষরের আর কিছুই মনে পড়ছে না। তবে, ওই জুসে কি কিছু মেশানো ছিল? অক্ষর উপলব্ধি করল, ঘরে সে একা নয়। আসেপাশে, আরও কিছু জন্তু-জানোয়ার আছে। ভয়ে অক্ষরের হাড় হিম হয়ে গেল। সে যে ভয়ানক কোনো বিপদে পড়েছে, তা বুঝতে পারল। এই অবস্থায় চিৎকার করা উচিত কি অনুচিত, ঠিক ভেবে পেল না।
এমন সময় ঘড়ঘড় করে একটা পিলে চমকানো শব্দ। একটা দরজা খুলে গেল। কে একজন ঘরের মধ্যে ঢুকছে বলে মনে হল। ঘরে ঢুকেই তিনি সুইচবোর্ডে হাত দিয়ে পটপট করে কয়েকটা আলো জ্বেলে দিলেন। আরে! ইনি তো অক্ষরের মামা শ্বশুর। বিখ্যাত সাইন্টিস্ট। কত দেশ-বিদেশের কন্ফারেন্সে যোগ দিতে যান। নামকরা এক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর। মামাবাবু ঘরে ঢুকে দরজাটা আবার বন্ধ করে দিলেন। অক্ষর লক্ষ্য করল— সে একটা খাঁচার মধ্যে বন্দি। আসেপাশে এরকম আরও অনেক খাঁচা রয়েছে, তার মধ্যে কয়েকটা ইঁদুর, বাঁদর, গিনিপিগ ইত্যাদি রয়েছে। চারিদিকে কেমিক্যালের বয়াম, গ্যাসের সিলিন্ডার, পাইপ, টেস্টটিউব, বিকার, ওভেন সব থরেথরে সাজানো। সব কিছু বেশ নোংরা। অনিন্দিতার সঙ্গে অক্ষর আগে কয়েকবার মামা শ্বশুরের বাড়িতে এসেছে, অবিবাহিত মানুষ, প্রাসাদোপম বাড়ি, সামনে বিরাট বাগান। কিন্তু, এই ঘরটা তো দেখেনি। এটা তার মানে মামাবাবুর সিক্রেট ল্যাব। কী হয় এখানে? অক্ষরকে এখানে খাঁচায় পুরে রাখা হয়েছে কেন? হঠাৎ, মামাবাবুর গমগম স্বরে কথা বলে উঠলেন— “জানি, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন। একটু সবুর করো। সব বলছি।” তারপর একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লেন। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে বলতে লাগলেন— “প্রথমেই বলে রাখি, ঘরটা সাউন্ডপ্রুফ। চেঁচিয়ে কোনো লাভ হবে না। বরং, আমার সঙ্গে সহযোগিতা করলে তোমার লাভ বই ক্ষতি কিছু নেই। অনিন্দিতা তোমাকে লাখ খানেক টাকা আর একটা ফ্ল্যাটের বিনিময়ে আমার কাছে বেচে দিয়েছে।” শুনে অক্ষর শিউরে উঠল— “কী বলছেন কী? আমি বিশ্বাস করি না। অনিন্দিতা মোটেও এত নিচে নামতে পারে না।” মামাবাবু বলতে লাগলেন— “শনিবারের রাত, তুমি অফিস থেকে এলে, অনিন্দিতা তোমাকে ফ্রুট জুস দিল।”
— “ওই ফ্রুট জুসেই তবে …”
— “হ্যাঁ, ড্রাগ মেশানো ছিল। তুমি অচৈতন্য হয়ে পড়লে। তারপর রাতের আঁধারে গাড়ি নিয়ে গিয়ে তোমায় টুক করে তুলে আনলাম। রবিবার দিনটা তোমার হুঁশ ফেরেনি। এখন সোমবার, সবে ভোর হচ্ছে।”
— “কিন্তু, কেন?”
— “আমার ভাগ্নি তোমার মতো একটা অপদার্থকে নিয়ে কী করবে? তোমায় ডিভোর্স দিয়ে এক লাখ টাকা পাবে কিনা সন্দেহ। তোমার দৌড় কত অবধি সে কি জানে না? প্রস্তাবটা আমিই দিই। বুদ্ধিমান মেয়ে, এক কথায় রাজি হয়ে গেল।”
— “মানে! আমায় বেচে দিল! আমি তার স্বামী, তার সন্তানের বাবা …”
— “আমাদের কাছে এসব মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের কোনো স্থান নেই।”
— “তবে, আমাকে বিয়ে করেছিল কেন?”
— “তুমি ওইসব কবিতা-টবিতা লিখে আমার ভাগ্নিটাকে ফাঁসিয়েছিলে। সে-ও বয়সের দোষে একটা ভুল করে ফেলেছিল, শুধরে নিয়েছে। যাক গে, ওসব বাদ দাও। তোমাকে আমার কী কাজে লাগবে সেটা শোনো। আমার এখনকার গবেষণার বিষয় হল— একটা মানুষকে কী করে সুপার হিউম্যান অর্থাৎ অতিমানব বানানো যায় তার পদ্ধতি আবিষ্কার করা। মানে এমন একজন মানুষ যার শরীরে থাকবে অসুরের মতো বল, অসুখ-বিসুখ-রোগ-জ্বালা তাকে স্পর্শও করতে পারবে না, একরকম ভাবে বলতে পারো— সে হবে অমর, তার বয়সও বাড়বে না।”
অক্ষর মনে মনে ভাবছে— বুড়ো বলে কী? পাগল হয়ে গেছে নাকি? অক্ষরকে এখানে কি তবে গিনিপিগের ভূমিকা পালন করতে হবে?
মামাবাবু বলতে থাকলেন— “আমি এই বিষয় নিয়ে অনেক দূর এগিয়েছি। বলা চলে, আমি সাফল্যের দোরগোড়ায় এসে ঠেকেছি। এমন একটা ওষুধ আবিষ্কার করেছি … ওই দেখো।” মামাবাবু একটা খাঁচার দিকে হাত দেখালেন। অক্ষর এতক্ষণ ভাবছিল উক্ত খাঁচায় একটা ধেড়ে শুয়োর রাখা আছে। ভালো করে দেখে, অক্ষরের মুখটা রক্তশূন্য হয়ে গেল— ওটা আসলে একটা ইঁদুর।
মামাবাবু মুচকি হেসে বলে চললেন— “তিনটে ডোজ পড়েছে। নেংটি ইঁদুর থেকে কী অবস্থা হয়েছে দেখো।” অক্ষর চোখের সামনে অন্ধকার দেখতে পেল। মামাবাবু আবার বলে উঠলেন— “এবার বলো, আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবে কি করবে না। তোমার ফিরে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ। খাঁচার মধ্যে থাকতে চাও না খাঁচার বাইরে? যদি, কো-অপরেট করো তোমাকে জামাই আদরে রাখতে না পারলেও, এই ল্যাবের মধ্যেই মানুষের মর্যাদা দিয়ে রাখতে পারব। আর এই জীবনটা নিয়ে তুমি করতেই বা কী বলো? ওই চারটে ন্যাকান্যাকা কবিতা লিখে কী হত তোমার? কিস্যু হত না। স্কুল-ম্যাগাজিনে আমিও ওরকম কত পদ্য-টদ্য লিখেছি। তার থেকে বিজ্ঞানের কাজে লাগো। কত বড়ো একটা কাজ করছি বলো তো? এক ধাক্কায় মানব সভ্যতা হাজার বছর এগিয়ে যাবে। কোনো যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও তুমি এত বড়ো একটা কর্মকাণ্ডের অংশ হতে চলেছ— এ কি কম সৌভাগ্যের?”
সেই মুহূর্তে আবার ঘড়ঘড় করে আওয়াজ। দরজা ঠেলে একটি কিম্ভূত মেয়ে ল্যাবের মধ্যে প্রবেশ করল। রোগা-প্যাংলা, নাকে-কানে-মুখে অসংখ্য পিয়ার্সিং, চুলে বেগুনী-সবুজ-নীল কত রকমের রং— যেন রামধনু খেলছে, হাতে বোধহয় একশোটা ব্যান্ড, হিপি টাইপের লুক। মেয়েটিকে দেখা মাত্রই অক্ষরের বিরক্ত লাগতে শুরু করল। মামাবাবু মেয়েটিকে দেখিয়ে বললেন— “এর নাম ইতু। বনগাঁ বর্ডার থেকে একে আমি কিনেছি। পাক্কা নেশাখোর। মাথায় কিছু নেই। ভালো করে কথাও বলতে পারে না। লিখতে-পড়তে জানে কিনা সন্দেহ। বাড়ির সব কাজ করে। ল্যাবের পশুপাখিদের যত্ন নেয়। সময় মতো নেশার জিনিস দিয়ে দিলেই এ খুশি। এ তোমারও দেখভাল করবে। আর হ্যাঁ, ওই যে দেখছ ল্যাবের দরজা, ওটা হাইটেক, আমার বা ইতুর চোখ স্ক্যান করে, তবে খোলে। সুতরাং, বুঝতেই পারছ, এখান থেকে পালানো সম্ভব নয়। তা বললে না তো, খাঁচায় থাকবে না বাইরে?”
অক্ষর আমতা আমতা করে বলল— “বাইরে।” মামাবাবু হাঁক পাড়লেন— “এই যে ইতু, খাঁচাটা খুলে দিয়ে যাও তো।” ইতু চাবির গোছা নিয়ে এসে অক্ষরকে খাঁচা থেকে বের করল। তারপর ল্যাব থেকে বেরিয়ে চলে গেল। মামাবাবু কড়া গলায় বললেন— “বেচাল দেখলে ইতু কিন্তু আবার তোমাকে খাঁচায় পুরবে। চেহারা দেখে ইতুকে অবজ্ঞা করো না। ড্রাগখেকো তো। গায়ে পিঁপড়ের মতো জোর। মানে, পিঁপড়েরা নিজের দেহের প্রায় ৫০০০ গুণ বেশি ওজন সহ্য করতে পারে, তাই বললাম আর কী। আর ওই যে দেখছ আরেকটা দরজা, ওইটা তোমার বাথরুম। একটা মানুষের যা যা দরকার ইতু সবই তোমাকে ল্যাবে এসে দিয়ে যাবে। শুধু ল্যাবের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করো না, পারবে তো না-ই, উল্টে তাতে তোমারই ক্ষতি, বুঝেছ তো?” অক্ষর সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল। মামাবাবুর প্রস্থান করলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পিপীলিকা তথা ইতুর প্রবেশ। মামাবাবু ভুল কিছু বলেননি— মেয়েটা পিঁপড়েই বটে। একা একটা ম্যাট্রেস নিয়ে চলে এসেছে, সঙ্গে আবার একটা জলের বোতল। অক্ষরের গলা শুকিয়ে এসেছিল। ইতু ঠকাস করে একটা টেবিলের ওপর জলের বোতলটা বসিয়ে দিয়ে গেল। আহ! ঠান্ডা জল। অক্ষর ঢকঢক করে খানিকটা জল খেয়ে ফেলল। ইতু ততক্ষণে ল্যাবের জিনিস-পত্র সরিয়ে-টরিয়ে ম্যাট্রেস পাতার মতো কিছুটা জায়গা করে ফেলেছে। ইতু আবার চলে গেল, ফিরে এল একটা ভ্যাকুম ক্লিনার, একটা বিছানার চাদর আর একখানা বালিশ নিয়ে। ফাঁকা জায়গাটা পরিষ্কার করে ইতু সেখানে অক্ষরের জন্য পরিপাটি বিছানা পেতে ফেলল। আধ ঘন্টা বাদে একটা খাটো টুল এনে বিছানার সামনে বসিয়ে, সেখানে অক্ষরকে চা-জলখাবার দিল। অক্ষর চা খেল। খিদে পাচ্ছিল। কিন্তু, ল্যাবের মধ্যে যা বিটকেল গন্ধ, তার ওপর মামাবাবুর কথা শুনে অক্ষরের জীবনের সব খাওয়া যেন খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ফলত, কিছুই খেতে পারল না। বারবার ভাবছে— অক্ষর নিশ্চয় কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে, এক্ষুনি ঘুম ভেঙে যাবে, উঠে হয়তো দেখবে— মেসের বিছানায় কিম্বা অনিন্দিতার বেডরুমে শুয়ে আছে।
২
দু-দিন কেটে গেছে। ল্যাবের গন্ধটা এখন গা সওয়া। অক্ষর খায়-দায়, ল্যাবের পশু-পাখিদের সঙ্গে কথা বলে, স্মৃতি থেকে উদ্ধার করে এনে জন্তুগুলোকে কিছু স্বরচিত পদ্য শোনায়। শুধু ওই দানব ইঁদুরটাকে একটু এড়িয়ে চলে— ওটাকে দেখলেই অক্ষরের নিজের ভবিষ্যৎ-চিন্তা জেগে ওঠে আর মন খারাপ হয়ে যায়।
ইতু বেশ কয়েক জোড়া ফতুয়া আর পাজামা দিয়ে গেছে, একটা টেবিল ফ্যানেরও বন্দোবস্ত করেছে, রোজ এক প্যাকেট করে শান্তি বিড়িও যোগান দিচ্ছে। প্রথম দিন বিড়ির প্যাকেটটা দেখে অক্ষর একটু হতচকিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, পরে ভেবে দেখল, এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, অক্ষরকে যেদিন আনা হয়েছিল, সেদিন হয়তো মেয়েটা অক্ষরের পকেট হাতড়ে শান্তি বিড়ির প্যাকেট পেয়েছিল। অক্ষরের দৃঢ় বিশ্বাস— ওর মোবাইল, পার্স সব এই নেশাখোর মেয়েটাই ঝেপেছে। ইতুকে দেখলেই অক্ষরের গা রি রি করতে থাকতে— এক তো মেয়েটার বিচিত্র সাজগোজ। দুই, মেয়েটা ড্রাগ নেয়। তিন, শুধুমাত্র নেশার জিনিস পাচ্ছে বলে একটা উন্মাদ সাইন্টিস্টের খিদমত খাটছে। চার, মেয়েটা একেবারেই নির্বোধ, রোবট বললেও ভুল বলা হবে না। তবে, রান্নাটা ভালোই করে, কত আজব সব রান্না-বান্না করে খাওয়ায়। মামাবাবু একদিন এই প্রসঙ্গে বলছিলেন— “ইতুটা এমনই একটা গাধা, “কী রান্না করেছ, এই রান্না কোথা থেকে শিখেছ” —জিজ্ঞাসা করলে আর বলতে পারে না!”
সেদিন হল কী, বেশ রাত, ডিনার হয়ে গেছে, ইতু এসে এঁটো থালা-বাসনও সরিয়ে নিয়ে গেছে। অক্ষর শোবার তোড়জোড় করছে, এমন সময় ইতু এল। এসে অক্ষরের বিছানার কাছে হাঁটু মুড়ে বসল। অক্ষরের কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল— আঁচড়ে-কামড়ে দেবে নাকি রে বাবা, ড্রাগখোরেরা সবই পারে! ইতু বলল— “করবা?” অক্ষর এই প্রথম ইতুকে কথা বলতে শুনল। এতদিন শুধু মুখ বুজে কাজই করে যেতে দেখেছে। কিন্তু, মেয়েটা বলে কী? ইতু আবার বলল— “করবা?” কী করতে বলছে ইতু? কী চায়? অক্ষরের মাথায় কিছুই ঢুকল না। ইতু কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে চলে গেল।
পরদিন সকাল থেকে ইতু অনেকবার ল্যাবে এসেছে। আগের দিনের ঘটনা অক্ষরের মাথাতেও ছিল না। হঠাৎ, মনে পড়তেই অক্ষর ঠিক করল এবার ইতু এলে ইতুকে জিজ্ঞাসা করবে, আগের দিন রাতে ও ঠিক কী বলতে চেয়েছিল। ভাবতে না ভাবতেই, ঘটাং করে ল্যাবের দরজা খুলে গেল। মামাবাবু এবং একটা ছোটো বাক্স হাতে ইতু প্রবেশ করল। মামাবাবু সহাস্য বদনে অক্ষরকে বললেন— “আজ তোমার প্রথম ডোজ। এসো, এই চেয়ারটায় বসো।” শোনা মাত্রই অক্ষরের হাত-পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবার উপক্রম হল, আবার দেখে— ইতু সিরিঞ্জ ঠিক করছে। অক্ষর কোনো রকমে একটা ঢোক গিলে বলল— “ও ইঞ্জেকশন দেবে নাকি?” মামাবাবু বললেন— “তবে না তো কে? ড্রাগ নেয় তো। নেশাড়ুদের হাত খুব ভালো হয়। পাশ করা লোকেদের হার মানিয়ে দেবে।” অক্ষর অগত্যা চেয়ারে এসে বসল। ইতুও ভীষণই নির্লিপ্ত ভাবে অক্ষরের বাঁ হাতে ইঞ্জেকশন দিয়ে চলে গেল। অক্ষরের একটুও লাগল না। তবে, সারাদিন ধরে অক্ষরের মনে হতে লাগল, এই বোধহয় জ্বর আসছে, কিন্তু, জ্বর এল না। কখনো মনে হচ্ছিল, এই বোধহয় পেট গুড়গুড় করছে, এই বোধহয় বমি পাচ্ছে। পরে বুঝল, সবটাই মনের ভুল, আসলে ওর কিছুই হচ্ছিল না। রাতে মামাবাবু এসে একবার খোঁজ নিয়ে গেলেন। অক্ষর ভালো আছে দেখে মামাবাবু ওর পিঠ চাপড়ে বললেন— “নিজেকে নিয়ে গর্বিত হও। তুমি পৃথিবীর প্রথম সুপার হিউম্যান হতে চলেছ।” রাতে শুয়ে শুয়ে অক্ষর স্বপ্ন দেখতে লাগল— ওর গায়ে অসুরের শক্তি হয়েছে, নৃসিংহের মতো মামাবাবুর বুক চিরে ফেলেছে, ল্যাবের দরজা ভেঙে ও পালিয়ে যাচ্ছে।” এমন সময় দরজার শব্দ হল। অক্ষরের ঘুমটা গেল ভেঙে। অন্ধকারের মধ্যে ইতু এসে বিছানার পাশে বসল বলে মনে হল। ইতুর আবার সেই এক প্রশ্ন— “করবা?” খুব রাগ ধরল অক্ষরের, কী সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিল, তার মধ্যে— “করবা?” শুনেও না শোনার ভান করে চুপচাপ মটকা মেরে পড়ে রইল অক্ষর। ইতু উঠে চলে গেল।
অক্ষর পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখল, হাতটায় বেশ ব্যথা হয়েছে। অক্ষরের ঠিক কী হতে চলেছে সে নিজেও জানে না। সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। যে-কটা দিন আছে একটু লিখতেও পারবে না? সকালবেলায় ইতু আসতেই অক্ষর বলল— “আমাকে কি একটা খাতা-পেন দেওয়া যায়? তোমার মালিক কি তা অনুমোদন করবেন? কাজ নেই, সারাদিন ক’টা জন্তুর মধ্যে বসে থাকি। আমি একটু কবিতা লিখলে কি সেই মহান বৈজ্ঞানিকের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?” ইতু ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে দেখে, অক্ষর বিরক্তিতে স্বগতোক্তি করল— “ধুর! কাকে বলছি!” কিছুক্ষণ বাদে ইতু অক্ষরকে একটা রাইটিং প্যাড আর দুটো পেন এনে দিল— একটা লাল কালি, অন্যটা কালো কালি। অক্ষর ইতুর প্রতি একটু প্রসন্ন হল, ইতুকে বলল— “তোমার বাড়ি কোথায় গো?” ইতু উত্তর দিল— “দূর দ্যাশে।”
— “বাংলাদেশে?”
— “এইডাই তো বাংলাদ্যাশ।”
অক্ষরের মনে হল, মেয়েটি বোধহয় ঢাকার কোনো বড়োলোক বাপ-মায়ের বখে যাওয়া সন্তান। নেশা করে করে বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। অক্ষর জিজ্ঞাসা করল— “আচ্ছা ইতু, তুমি হিন্দু না মুসলিম?”
— “হেইডা আবার কী?”
অক্ষর মনে মনে হাসল। নেশা করে যদি মাথা থেকে সব বিভেদ, বিভাজন দূর হয়ে যায়, তবে নেশা একপক্ষে ভালো। তারপর অক্ষর বলল— “আমার মোবাইলটা কি তোমার কাছে আছে?” ইতু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। অক্ষর আবার বলল— “আমাকে যখন এখানে আনা হয়, তখন তুমি আমার পকেট হাতড়ে কী কী পেয়েছিলে?” ইতু খপ করে সামনে পড়ে থাকা শান্তি বিড়ির প্যাকেট তুলে নিয়ে বলল— “ইটা পায়ছেলাম।” অক্ষরের কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করল— সত্যিই তো, ইতুর নেশা ছাড়া আর কোনো কিছুরই চাহিদা নেই। মামাবাবু তো ইতুকে নেশার জিনিসে চুবিয়ে রেখে দিয়েছে। অক্ষরের মোবাইল আর পার্স হাতিয়ে ইতু কী করবে? তার মানে, অক্ষর এখানে এসে পৌঁছনোর আগেই সে-সব হাত-সাফাই হয়ে গিয়েছিল। এতদিন ইতুকে ও বেকার ভুল বুঝে গেছে। এই মেয়েটার মাথায় চুরি করার বুদ্ধিটুকুও নেই। ইতুর হাত থেকে অক্ষর বিড়ির প্যাকেটটা নিতে গিয়ে হাতের সঙ্গে হাত ছুঁয়ে গেল। আগেও হয়তো এরকম হয়েছে। কিন্তু, আজ অক্ষরের বুকের মধ্যে কেমন একটা যেন হয়ে গেল।
বিকেলে সেই বিশাল ইঁদুরটাকে অন্তিম ডোজ দেওয়া হল। মামাবাবু যাবার সময় অক্ষরকে বলে গেলেন— “আজ রাতে ইতু এই ঘরে থাকবে। ইঁদুরটার কী হচ্ছে না হচ্ছে লক্ষ্য করবে।”
ইঞ্জেকশন নেবার পর থেকে ইঁদুরটা ভোঁস ভোঁস করে ঘুমাচ্ছিল। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পরে অক্ষর শোবার উপক্রম করছে, এমন সময় ইতু এল। অক্ষরের কেমন একটা অস্বস্তি হতে লাগল— ইতু আবার কী সেই প্রশ্নটা করবে? ইতু কি অক্ষরকে দিয়ে নিজের যৌন-চাহিদা পূরণ করতে চায়? ‘করবা’ মানে আর কী হতে পারে? অক্ষরের গা ঘিনঘিন করে উঠল— প্রেম ব্যাতীত যৌনতা! ইতুর মতো গোল্লায় যাওয়া মেয়েদের সঙ্গে অক্ষরের মানসিকতা মিলবে না। ইতু ইঁদুরের খাঁচার সোজাসুজি একটা চেয়ার সেট করে আলো নিভিয়ে দিল। অক্ষর মনে মনে ভাবল, মেয়েটা কী ধরণের মাথামোটা রে বাবা! থাকতে না পেরে ইতুর উদ্দেশে বলল— “তোমার মালিক তো ইঁদুরটার ওপর নজরদারি করতে বলেছে। আলো নিভিয়ে দিলে সেটা করবে কী করে? আর আমার ঘুমের কথা ভাবছ? লাইট জ্বালা থাকলে আমার ঘুম হয় না ঠিকই, কিন্তু, আজ রাতে আমার এমনিতেই ঘুম আসবে না।” ইতু বলল— “ঘুমায় পড়ো। আমি আন্ধারেও দ্যাখতে পাই।” অক্ষরের মনে হল— নেশা করলে যেমন গায়ে পিঁপড়ের মতো শক্তি হয়, তেমনি বোধহয় বিড়ালের মতো অন্ধকারে দেখার ক্ষমতাও জন্মায়। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মধ্যরাত, একটা জন্তুর চাপা গর্জনে অক্ষরের ঘুম ভেঙে গেল। পরক্ষণেই— খ্যাঁচ খ্যাঁচ খ্যাঁচ। তিনবার শব্দ হল। জন্তুটা গোঁঙাতে গোঁঙাতে শান্ত হল। কিন্তু, ইতু যেখানে বসেছিল, সেখানে কার চোখ জ্বলছে! অক্ষর দৌড়ে গিয়ে দু-একবার এটায় ওঠায় ধাক্কা খেয়ে ল্যাবের আলো জ্বালল। দেখল— প্রকাণ্ড ইঁদুরটা খাঁচার সামনে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, জায়গাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, খাঁচার শিক বাঁকানো আর ইতু যেখানে বসেছিল, সেখানেই বসে বসে একটা ছোটো পিস্তলে ফুঁ দিচ্ছে। তার মানে, ওই ইঁদুরটা খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে এসেছিল এবং ইতু সাইলেন্সার লাগানো ওই পিস্তলটা দিয়ে ইঁদুরটাকে গুলি করে মেরেছে। ইতু যে শুধু অন্ধকারে দেখতে পায় তা-ই নয়, সেই অবস্থাতে লক্ষ্যভেদ করতেও পারে। অক্ষর ভুল দেখেনি, অন্ধকারে ইতুর চোখ জ্বলছিল। অক্ষর বুঝল, ইতুও মামাবাবুর বানানো একটা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।
ইঁদুর হত্যা করে ইতু ল্যাব থেকে বেরিয়ে গেল। ফিরে এল মামাবাবুকে নিয়ে। মামাবাবু সব দেখে শুনে ইতুকে বললেন— “জন্তুটাকে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলো। কাকপক্ষী জেগে যাওয়ার আগে প্রমাণ লোপাট করতে হবে।” ইতু দৈত্যাকার ইঁদুরটাকে নিয়ে চলে গেল, পিছন পিছন মামাবাবুও। যাবার আগে মামাবাবু বললেন— “এখানকার ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে তোমার মাথা না ঘামানোই ভালো। পরশু তোমার সেকেন্ড ডোজ।” খাঁচার সামনের রক্তাক্ত জায়গাটা দেখে অক্ষরের বমি পেতে লাগল। এই অবস্থায় সারা রাত থাকতে হবে! অক্ষর আরেকটা জিনিসও উপলব্ধি করল— ওর জন্য হয়তো ওই ইঁদুরটার মতো মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে। মামাবাবু কি জানেন না, অতিমানব হয়ে গেলে অক্ষর আগে তাঁকেই খুন করবে? মামাবাবু এত কাঁচা কাজ করবেন না। আসলে, অক্ষর এখানে এসেছে গিনিপিগ হতে— ওর ওপর ওষুধটা প্রয়োগ করে দেখা হবে কতটা কাজ দিচ্ছে, সাইড এফেক্ট আছে কিনা ইত্যাদি। অথবা এমনও হতে পারে, গায়ের জোর বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে অক্ষরের বুদ্ধির বিনাশ ঘটানো হবে, ইতুর মতো অক্ষরকেও মামাবাবু পালতু কুত্তা বানিয়ে রেখে দেবে। অক্ষরের মনের মধ্যে যেটুকু আশা বেঁচে ছিল, তাও শেষ হয়ে গেল।
৩
ইঁদুর মারার পরদিন বিকেলে মামাবাবু ল্যাবে এসে বসলেন। অক্ষর দেখল মামাবাবুকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। অক্ষর জিজ্ঞাসা করল— “কী হয়েছে, মামাবাবু? কোনো সমস্যা?” মামাবাবু বললেন— “তুমি অ্যাডামের আপেল খাওয়ার গল্পটা জান?”
— “জানি তো।”
— “ঈশ্বর অ্যাডাম আর ইভকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেতে বারণ করেছিলেন। কিন্তু, লিলিথ বা শয়তানের প্ররোচনায় অ্যাডাম আর ইভ জ্ঞানবৃক্ষের ফল খেয়ে ফেলল। ফলে, মানুষের আদি পিতা-মাতার সামনে খুলে গেল জ্ঞান এবং বোধের জগৎ। ঘটনাচক্রে, জ্ঞানবৃক্ষ ছিল একটা আপেল গাছ। তারপর ধরো, নিউটনের ব্যাপারটা। নিউটনের মাথায় আপেল পড়ল আর নিউটন গতিসূত্র আবিষ্কার করে ফেললেন। আবার আপেল! এই গতিসূত্রের উপরে ভিত্তি করে মানুষ পৌঁছে গেল বিজ্ঞানের যুগে। এরপর, স্টিভ জবস। ‘অ্যাপেল’-এর আইফোন বাজারে আনলেন। দুনিয়া এসে গেল মানুষের মুঠোর মধ্যে। মানব সভ্যতা এক ধাক্কায় অনেক দূর এগিয়ে গেল। তিনটে যুগান্তকারী ঘটনায় কমন হল— আপেল।”
অক্ষর বসে বসে মামাবাবুর কথাগুলো গিলছিল। মামাবাবু আবার বলতে শুরু করলেন— “তোমার কি মনে হয়, তিনটে ঘটনায় আপেলের ব্যাপারটা পুরোপুরি কাকতালীয়?”
— “আগে তো এভাবে ভাবিনি। তবে, এখন মনে হচ্ছে, কিছু একটা রহস্য আছে।”
— “রহস্য তো বটেই। এই আপেলের বিষয়টা প্রতীকী। এর পিছনে আছে একটা জনগোষ্ঠী— যারা বারবার পৃথিবীতে এসেছে এবং মানবসভ্যতাকে এক ধাপ করে এগিয়ে দিয়েছে।”
— “কারা এই আপেল-জনগোষ্ঠী? কোথা থেকেই বা আসে?”
— “মহাকাশ থেকে আসে।”
— “মানে এলিয়েন?”
— “হয়তো তাই।”
— “এরা কি ফ্লাইং সসারে করে আসে?”
— “ওসব পুরোনো টেকনোলজি এখন আর ওরা ব্যবহার করে না। ওরা আসে স্টারগেট দিয়ে।”
— “সেটা আবার কী?”
— “তা তোমার কবিতা লেখা ভোঁতা মাথায় ঢোকবার বিষয় নয়। আইনস্টাইন-রজেন ব্রিজেস থিয়োরি পড়েছ? সেসব জটিল অঙ্কের ব্যাপার। এক কথায় বলতে গেলে— স্টারগেটের মধ্যে দিয়ে খুব অল্প সময়ে লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ পেরিয়ে অন্য একটা জগতে চলে যাওয়া যায়।”
— “ওহ আচ্ছা!”
— “সমস্যাটা হল, এই আপেলদের কাছে আমার গবেষণার খবর পৌঁছে গেছে। ওরা আমাকে সফল হতে দেবে না। আমার কম্পিউটার হ্যাক করেছিল! বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ফাইল ডিলিট করে দিয়ে গেছে!”
— “ওরাই যে হ্যাক করেছিল আপনি বুঝলেন কী করে?”
— “চিহ্ন ছেড়ে গেছে।”
— “কিন্তু, তারা তো মানবসভ্যতাকে এগিয়ে দিতে চায়, আপনিও তো সেই একই কাজ করছেন। এই নিয়ে তো ওদের সঙ্গে সংঘাত হওয়ার কথা নয়।”
— “ওরা চায়, মানুষের উন্নতি হোক ওদের হাত দিয়ে। মানুষ নিজে নিজে এতটা এগিয়ে যাক —ওরা তা চায় না। মানুষকে ওরা এগিয়ে দেবে ওদের ইচ্ছামতো, ওদের সময়মতো। আমি আসলে একটু বেশিই স্পর্ধা দেখিয়ে ফেলেছি কিনা।”
অক্ষর মনে মনে ভাবল— আপেলরা আদতে ভালো, ওরা মামাবাবুর এইসব অনৈতিক কাজকর্ম মেনে নিতে পারছে না, তাই মামাবাবুর পিছনে লেগেছে। তাছাড়া মানুষ কি এখন অমর হওয়ার মতো পরিণতমনষ্ক হতে পেরেছে?
মামাবাবু যাবার আগে বলে গেলেন— “প্রথম ডোজটা তো তোমার মধ্যে কোনো পরিবর্তনই আনতে পারল না। কাল তোমাকে আরও কড়া করে ডোজ দিতে হবে।”
সেদিন রাতে ইতু আর উৎপাত করতে এল না।
৪
পরদিন সকালে, মামাবাবু আর ইতু এল অক্ষরকে ইঞ্জেকশন দিতে। ইতু গ্লাভস পরে এসেছে। অক্ষরের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। মামাবাবু এক ধমক দিলেন— “এত ভয়ের কী আছে? এ-ভাবে কাঁপলে ইতু ইঞ্জেকশন দেবে কী করে?” ইতু ততক্ষণে সিরিঞ্জ হাতে রেডি। নিমেষের মধ্যে ইতু সূঁচটা দিল মামাবাবুর গলায় গেঁথে, পুরোটাই পুশ করে দিল মামাবাবুর গলায়। মামাবাবু ল্যাবের মেঝেতে পড়ে ছটফট ছটফট করতে করতে সিলিঙের দিকে চক্ষুস্থির করে শান্ত হলেন। ইতু সিরিঞ্জটা ফেলে অক্ষরের হাত ধরে টানতে টানতে ল্যাবের বাইরে এল। অক্ষরকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাল। তারপর একটা রুকস্যাক এনে তাতে এটা-ওটা জিনিস ভরতে ভরতে বলল— “পালান লাগব।” ঘটনার আকস্মিকতায় অক্ষর হতবাক হয়ে পড়েছিল। এতক্ষণে মুখ খুলল— “আমার জন্য তুমি এত বড়ো একটা পদক্ষেপ নিলে? মানুষ খুন করলে? পুলিসের নজর এড়িয়ে কোথায় যাবে তুমি? কী করেছ তার গুরুত্ব বোঝ?” ইতু ততক্ষণে ওর বিছানার তলা থেকে পাতলা ফিনফিনে ল্যাপটপের মতো কিছু একটা টেনে বের করল। কি-গুলোয় কীসব বিজাতীয় ভাষা। রীতিমতো সুচারু হাতে ইতু ল্যাপটপ চালাতে লাগল। অর্থাৎ, ইতু রীতিমতো বুদ্ধিমান। অক্ষর বলল— “যা করলে তা তো প্রথম ডোজের বেলায়ই করতে পারতে, না জানি কীসব আমার শরীরে ঢুকে গেল।” ইতু বলল— “ওইডা টিটেনাস ছেলো। লোহায় কাটলে দ্যায়। আমি সলুশান বদলায় দেছেলাম।” বলেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কয়েক তাড়া কাগজ আর কী একটা সলিউশন নিয়ে ফেরত এল এবং সেগুলো ব্যাগস্থ করল। সেদিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অক্ষর বলল— “তুমি কোথা থেকে এসেছ বলো তো?” ইতু তার পাতলা ল্যাপটপ খুলে দেখাল— সৌরজগত, সেখান থেকে বেরিয়ে মিল্কওয়ে গ্যালাক্সি, সেখান থেকে বেরিয়ে আরও দূরের মহাকাশ, তার মধ্যে অন্য একটা গ্যালাক্সি, সেই গ্যালাক্সির অজস্র নক্ষত্রের মধ্যে একটা বিশেষ সৌরজগত, তার মধ্যে পৃথিবীর মতো দেখতে আরেকটা গ্রহ। অক্ষর চোখ কপালে তুলে বলল— “তবে তুমি কে, ইতু?” ইতু বলল— “মাস্টের যাগে আপেল কইত।” অক্ষর চোখে সর্ষেফুল দেখছে। বলল— “তুমি তোমার গ্রহে ফিরে যাবে? আমি কোথায় যাব?” ইতু বলল— “তুমার যাওনের আর জায়গা আছে? আমার লগেই যাবা।”
— “সত্যি আমাকে তোমাদের গ্রহে নিয়ে যাবে? আমার জন্য এত করছ কেন?”
ইতু আঙুল নেড়ে নেড়ে কেটে কেটে বলল— “আই লাভ উ।”
— “কী বলছ, তুমি তার মানে জান? আগে বলনি কেন? “
— “হ, জানি। কী কইর্যা জানুম— তুমরা, মাইন্সেরা, ‘করবা’ কইলে বোঝতে পার না, ‘আই লাভ উ’ কইলে বুঝ?”
অক্ষর হো হো করে হেসে উঠল। তারপর বলল— “এই বাংলা তুমি শিখলে কোথায়?”
— “আগে আরেটটা মাস্টেরের বাড়ি থাকোনের সময় তার থেইক্যা শিখসি।”
— “তুমি তো আসলে পড়াশোনা জানা খুব ভালো একটা মেয়ে। এ-পৃথিবীতে এসে যে এইসব ছাইপাঁশ নেশা করে বসলে, নিজের গ্রহে ফিরে কী করবে? কী হবে তোমার?”
— “ন্যাশার দোব্বো আমাগো গোরোহে অনেক রইছে। চলো চলো, তুমারে আমি আমাগো বিড়ি খাওয়াবানি।” অক্ষর আবার হেসে উঠল অনেক দিন বাদে ও এরকম প্রাণ খোলা হাসি হাসছে। পরক্ষণেই হাসিটা মিলিয়ে গেল— এসব স্বপ্ন নয় তো! ও সত্যিই মামাবাবুর ওই ভয়ানক পরিকল্পনার হাত থেকে রেহাই পেয়েছে?
এমন সময়, অক্ষর দেখল ইতুর ঘরের মধ্যে তারকা আকৃতির একটা আলোর গেট তৈরি হচ্ছে— অনেকটা গুপী-বাঘা সিনেমায় ভূতের রাজা যেমন একটা তারার সামনে অবতীর্ণ হত, সেরকম খানিকটা। অক্ষর বলল— “পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি, ইতু?” ইতু হাসতে হাসতে অক্ষরের দিকে এগিয়ে গেল।
একমাস বাদে নিউজে এল— ‘ল্যাবের দরজা ভেঙে বৈজ্ঞানিকের পচা-গলা দেহ উদ্ধার’! অনুমান করা হচ্ছে ড্রাগ ওভার ডোজ হয়েই এই মৃত্যু। পাশে পড়ে থাকা সিরিঞ্জে ড্রাগ পাওয়া গেছে। বাড়িতে প্রচুর পরিমাণে কোকেন লুকানো ছিল। অনেকেই বলছেন, শেষের দিকে এই অধ্যাপক-বিজ্ঞানীর মানসিক বৈকল্য দেখা দিয়েছিল। সকলকে বলে বেড়াতেন— তিনি অতিমানব বানানোর ওষুধ আবিষ্কার করেছেন। কিন্তু, ঘর সার্চ করে তেমন কিছুই পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন— নীল-বেগুনী চুলের একটি মেয়ে প্রফেসরের দেখাশোনা করতেন। মেয়েটি কোনো অজ্ঞাত কারণবশত উধাও। মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক আগে অধ্যাপক তার ভাগ্নিকে বেশ কিছু সম্পত্তি হস্তান্তর করেছিলেন। আশ্চর্যজনকভাবে ভাগ্নির স্বামীও নিখোঁজ। রহস্য ক্রমেই দানা বাঁধছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিস ভাগ্নিকে আটক করেছে।
সীমিতা মুখোপাধ্যায়
১৯৮২ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর হুগলী জেলার গরলগাছা গ্রামে জন্ম। বেড়ে ওঠা উক্ত জেলার উত্তরপাড়ায়। প্রাণী বিদ্যায় স্নাতকোত্তর হয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পেশায়। আপতত দুটি কবিতার বই। প্রথমটি হল— ‘যাপনচিত্র’ থেকে ২০১৫ সালের কোলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত ‘দশভুজা সার্কাস’ ও দ্বিতীয় বই— ‘অস্ট্রিক’ থেকে ২০১৮ সালের কোলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত ‘আমার অসময়গুলি’। এই জীবন নিয়ে, লেখা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা ছিল না কোনো দিন। লেখাকে নিজের নিয়তি মনে হয়।
1 Comments
[…] ইতু-কথা […]