• March 25, 2023

মার্জিত-ঋণ

 মার্জিত-ঋণ

সীমিতা মুখোপাধ্যায়


— বৃষ্টিস্নাতা?
— হ্যাঁ, বলো, মার্জিত।
— আমাকে পাঁচ হাজার টাকা ধার দিতে পার? সামনের বৃহস্পতিবার ফেরত দিয়ে দেব।
— হ্যাঁ, দিতে পারি।
— ঠিক আছে। কাল তাহলে যাদবপুর এইট-বি বাসস্ট্যান্ডে দেখা করছি।
— ক’টার সময়?
— সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ যদি যাই?
— ওকে। এসো।

কল রেকর্ডটা শুনে গল্ফগ্রিন থানার মেজোবাবু বললেন— ক্যাশ দিয়েছিলেন? কল রেকর্ড ছাড়া এই টাকা লেন-দেনের আর কোনো প্রমাণ নেই?
— না।
— টাকাটা কবে দিয়েছিলেন?
— ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।
— তারিখ?
— ৪ঠা সেপ্টেম্বর।
— আর কোনো কল রেকর্ড?
— হ্যাঁ আছে। পরেরটা শুনুন।

বৃষ্টিস্নাতা পরের কল রেকর্ডটা চালাল।
— মার্জিত, তুমি সেই আমার থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়েছিলে, মনে আছে?
— হ্যাঁ, মনে আছে।
— চারমাস হতে চলল। এবার ফেরত দাও।
— ঠিক আছে। কাল পার্কস্ট্রিটে এশিয়াটিক সোসাইটির সামনে পাঁচটা নাগাদ চলে এসো। টাকা ফেরত পেয়ে যাবে।
— ওকে। কথার খেলাপ যেন না হয়।

শুনে মেজোবাবু বললেন— তারপর?
— শুনে নিন পরের কল রেকর্ডটা।
— আপনার ফোনটা একবার দিন।
বৃষ্টিস্নাতা তার আইফোনটা মেজোবাবুর দিকে এগিয়ে দিল। মেজোবাবু বললেন— এরপর কোনটা?
— ওপর থেকে তৃতীয় কল।

মেজোবাবু কল রেকর্ড চালালেন।
— হ্যালো, মার্জিত? আমি পার্কস্ট্রিটে দাঁড়িয়ে আছি। আজ তো টাকাটা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। তুমি আসবে না?
— আমি টাকাটা আজ দিতে পারছি না। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।

শুনে মেজোবাবু বললেন— এইভাবে ভদ্রলোক দুবছর ধরে ঘোরাচ্ছেন?
— হ্যাঁ। পরের কল রেকর্ডটা শুনুন।

চতুর্থ কল রেকর্ড শুরু হল।
— মার্জিত, তুমি কি টাকাটা ফেরত দেবে না? এক বছর তো হতে চলল।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, দেব না কেন। এতদিন লকডাউন চলল তাই যেতে পারিনি।
— লকডাউন তো কী? ইচ্ছে থাকলে ঠিকই ফেরত দেওয়া যায়। ফোন পে, গুগল পে কত কী উপায় আছে।
— আমি তোমার বাড়ি গিয়ে ক্যাশ দিয়ে আসব।
— কবে?
— দুদিন সময় দাও। দেখছি।

মেজোবাবু বললেন— তারপর তিনি আর দেখে উঠতে পারলেন না। লাস্ট কলটা কবেকার?
— পরশু রাতের।
— শুনি।

মেজোবাবু প্লে বাটনটায় টাচ করলেন।
— মার্জিত, তুমি ওই পাঁচ হাজার টাকা ফেরত দেবে কি দেবে না বলে দাও।
— দেব না।
— কেন? তুমি তো ধার হিসেবে নিয়েছিলে।
— হ্যাঁ, তা নিয়েছিলাম। কিন্তু, ফেরত দেব না।
— আমি এবার পুলিসে যেতে বাধ্য হব।
— সে তুমি যা পার করে নাও।

মেজোবাবু বললেন— তা ভদ্রলোক করেন কী? বেকার?
— না, ডাব্লিউবিসিএস অফিসার।
— বলেন কী! তিনি পাঁচ হাজার টাকার জন্য এই রকম করছেন?
— হ্যাঁ, শুনলেন তো।
— দু-বছর ধরে মার্জিতবাবুর সঙ্গে আপনার এই পাঁচ বারই কথা হয়েছে?
— না, আরও অনেকবার টাকার জন্য তাগাদা দিয়েছি। সব কল রেকর্ড করা হয়নি।
— ভদ্রলোকের ফোন নাম্বার দিন।
বৃষ্টিস্নাতা মার্জিতর ফোন নাম্বার দিল।

মেজোবাবু ফোন করলেন।
— মার্জিত চট্টোপাধ্যায় বলছেন?
— হ্যাঁ, আপনি কে?
— আমি গল্ফগ্রিন থানা থেকে বলছি।
— বেশ। বলুন।
— মিস বৃষ্টিস্নাতা বসুকে চেনেন?
— চিনি।
— তাঁর কাছ থেকে বছর দুই আগে পাঁচ হাজার টাকা ধার করেছিলেন।
— হ্যাঁ।
— টাকাটা ফেরত দিয়েছিলেন?
— না।
— আপনি থানায় নিজে আসবেন? না, গাড়ি পাঠিয়ে নিয়ে আসতে হবে?
— নিজেই আসব।
— কাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ টাকাটা নিয়ে থানায় চলে আসুন। মিটিয়ে ফেলুন।
— আমি টাকা দেব না।
— কারণ?
— আমার কাছে এখন টাকা নেই।
— আপনার তো সরকরি চাকরি। জেল-হেফাজত হলে তো চাকরিতে সাসপেনশন হয়ে যাবে।
— গেলে যাবে। কী করব? ঠিক আছে। কাল বিকেল পাঁচটায় গল্ফগ্রিন থানায় যাচ্ছি।

ফোন কেটে দিয়ে মেজোবাবু বৃষ্টিস্নাতাকে বললেন— এভাবে বলা হয়তো উচিত নয়, তাও বলছি, আপনাকে দেখে তো বেশ উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে বলেই মনে হচ্ছে, হঠাৎ পাঁচ হাজার টাকার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠলেন কেন? অবশ্যই আপনার হকের টাকা, ফেরত পাইয়ে দেবার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব, তাও জানতে ইচ্ছে হয়।
— দেখুন, ও যদি গরিব-দুঃখী হত, আমি মাফ করে দিতাম। কিন্তু, ওর যথেষ্ট রেস্ত আছে। তাছাড়া, টাকা ফেরত দেবার নাম করে ও আমাকে যথেষ্ট হ্যারাস করেছে। আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি করে অনেক ঝুলিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী, আমি আর টাকাটা ফেরত চাই না। ওর শাস্তি চাই। আমি চাই ওর একটা শিক্ষা হোক।
— মার্জিতবাবুর কি এইরকম লোকের টাকা মেরে বেড়ানো স্বভাব?
— সে জানি না। জানলে কি আর টাকা ধার দিতাম?
— বটে। আপনি কী করেন?
— আমি শর্ট ফিল্ম বানাই।
— বাবা কী করেন?
— বাবা কী করেন তাই দিয়ে কী হবে? আমি একজন প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। নিজস্ব পরিচয় আছে। বাবার পরিচয়ে বাঁচতে চাই না।
— আর মা?
— সেটাও বলব না।
— বেশ। নিজের ঠিকানা আর ফোন নাম্বারটা দিয়ে বাড়ি চলে যান।
বৃষ্টিস্নাতা তাই করল।

বৃষ্টিস্নাতা বেরিয়ে যাবার পর অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব ইন্সপেক্টর আলেখ্যর প্রবেশ। মেজোবাবুর কামরায় ঢুকে আলেখ্য বলল— মেয়েটি হেব্বি স্মার্ট, দেখতেও … হি হি, চমৎকার!
মেজোবাবু আলেখ্যকে বেশ পছন্দ করেন, এটাও জানেন আলেখ্যর একটু আড়ি পাতা স্বভাব আছে। মেজোবাবু বললেন— তা, সব শুনে কী মনে হল?
— খটকা।
— পুরো কেস জন্ডিস।
— ঠিকানা তো দিয়ে গেছে, চলুন না একটু এনকোয়েরি করে দেখি।
— দুর দুর! কোন যুগে পড়ে আছ এখনো। ফেসবুকটা খোলো। সব ইনফরমেশন ওখানেই পাওয়া যায়।

বৃষ্টিস্নাতার প্রোফাইল খুঁজে পেতে বিশেষ বেগ পেতে হল না। সাড়ে চার হাজার ফলোয়ার! মেজোবাবু আলেখ্যকে বললেন— মেয়ে যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে ফিল্ম স্টাডিতে পিএইচডি করেছে। বেশ কয়েকটা শর্ট ফিল্ম বানিয়েছে। কী আবার পুরস্কার-টুরস্কার পেয়েছে, দেখছি।
— বাবার নাম, নিখিলেশ রায়, তিনি যাদবপুর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।
— মেয়ে বসু আর বাবা রায়!
— মা, পুণ্যলতা বসু। বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজের অধ্যাপক।
— মেয়ে তার মানে মায়ের পদবী ব্যবহার করে।
— ডিভোর্স কেস না নারীবাদী কেস?
— দাঁড়াও দেখছি। আমার ক্লাসমেট রাজা তো বিজয়কৃষ্ণ গার্লস কলেজে পড়ায়। ওকে একটা ফোন করি।

মেজোবাবু রাজাকে ফোন করলেন। আলেখ্য চুপচাপ বসে শুনতে লাগল।
— হ্যালো, রাজা?
— আরে তুই! কতদিন বাদে! কেমন আছিস?
— আমি বিন্দাস। তোর থেকে একটা ইনফরমেশন নেওয়ার ছিল।
— বল।
— তুই পুণ্যলতা বসুকে চিনিস? তোদের কলেজেরই অধ্যাপিকা।
— চিনব না মানে! উনি তো আমাদের প্রিন্সিপাল!
— কোথায় থাকেন জান?
— গল্ফগ্রিনে। ওঁর স্বামী তো যাদবপুরের প্রফেসর।
— আচ্ছা।
— ভীষণই ভদ্রমহিলা। পরিবারও ভালো। ওঁর বিষয়ে হঠাৎ পুলিস এনকোয়েরি কেন?
— আরে, ব্যাপারটাকে পুলিস এনকোয়েরি হিসেবে দেখছিস কেন? আমি কি তোর কাছে পারসোনালি কিছু জানতে চাইতে পারি না? তাছাড়া, পুলিসের কাজ কি শুধু চোর-ডাকাত ধরে বেড়ানো? কত রকমের ভেরিফিকেশন করতে হয়, জানিস? পাসপোর্ট বল, ভিসা বল, চাকরি বল …
— ও আচ্ছা, বুঝেছি বুঝেছি।
— তবে, কথাটা পাঁচ কান করিস না। দুনিয়ায় উজবুকের তো অভাব নেই। কী না কী ভেবে বসবে।
— না না। তুই তো জানিস, আমি সাতে-পাঁচে থাকি না।
— আর তোর খবর বল।
— ভালো রে।
আরও দু-একটা কথা চালাচালি করে মেজোবাবু ফোনটা কেটে দিলেন। এবার আলেখ্যর উদ্দেশ্যে বললেন— ডিভোর্স নয়। মা-বাবা একসঙ্গেই থাকেন। পিওর নারীবাদী কেস।
— এদিকে দেখুন, দু-সপ্তাহ আগে বৃষ্টিস্নাতা ঢাকুরিয়া আমরি-তে ভর্তি ছিল। লোকেশন দিয়ে স্ট্যাটাস।
— কী লিখেছে?
— “রিলিজড”।
— হয়েছিলটা কী?
— চলুন না, ঢাকুরিয়া আমরি-তে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করি।
— কমেন্টগুলো পড়ো। সব উত্তর পেয়ে যাবে।
মিনিট খানেক পরে, আলেখ্য বলে উঠল— এই দেখুন স্যার, ঋত্বিক বসু লিখেছে— “বাড়ি আয়, তোর জন্য অনেক ক্যালানি অপেক্ষা করে আছে।”
— ঋত্বিক বসু কোনো আত্মীয় হবেন হয়তো। আর অস্বাভাবিক কিছু?
— হ্যাঁ, মেঘাবৃতা মিত্র লিখেছে— “আর যেন কোনোদিন না শুনি।”
— মেঘাবৃতাটা কে?
— এও অপরূপ সুন্দরী। মনে হয় বৃষ্টিস্নাতার স্কুল ফ্রেন্ড। দুজনেই ‘কারমেল’-এ পড়ত দেখছি।
— আর কিছু পাও নাকি দেখো।
— পেয়েছি। স্বর্ভানু কর্মকার, পেশা— ফিল্ম এডিটিং, লিখেছে— “তুই এত ইমম্যাচিওরের মতো কাজ করতে পারিস স্বপ্নেও ভাবিনি।” বাকি সবাই “কী হয়েছে” “কী হয়েছে” করে গেছে।
— বৃষ্টিস্নাতা কাউকে রিপ্লাই দিয়েছে?
— না।
— ওই তিনটে কমেন্ট বেশ সন্দেহজনক। শরীর খারাপ নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হলে লোকে এসব লিখবে কেন?
— সেইজন্যই তো বলছি, চলুন, একবার আমরি-তে যাই।
— গিয়ে শুনবে পেটের অসুখ বা জ্বর এইসব নিয়ে ভর্তি হয়েছিল। আসল তথ্য পাবে না। বিত্তবান পরিবারের মেয়ে, মা প্রিন্সিপাল, বাবা যাদবপুরের প্রফেসর। অর্থবলে বা ক্ষমতাবলে ওঁরা সত্যিটাকে চেপে দেবেন না?
— আপনি কি আন্দাজ করছেন, বৃষ্টিস্নাতা সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল?
— হ্যাঁ, তাই।
— তিনটে কমেন্ট থেকে এরকম ভেবে ফেলাটা কি উচিত?
— ওর বাঁ হাতের কব্জিতে সেলাইয়ের দাগ আছে। তবে সেটা দু-সপ্তাহ আগের নয়। বেশ পুরোনো।
— বলিহারি চোখ আপনার!
— মেয়েটির সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে। কমেন্ট দেখে মনে হচ্ছে, দু-সপ্তাহ আগে ও আবার একবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।
— কিন্তু, তার সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক?
— সেটাই ভাবছি।


পরদিন বিকেল পাঁচটা নাগাদ বৃষ্টিস্নাতা এবং মার্জিত দুজনেই গল্ফগ্রিন থানায় এসে হাজির হল। মেজোবাবু দুজনকে নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন। কোনো ভূমিকায় না গিয়ে সরাসরি মার্জিতকে জিজ্ঞাসা করলেন— “টাকাটা এনেছেন?” উত্তর এল— “না। আমি টাকা দিতে পারব না। আমায় গ্রেফতার করুন।” বৃষ্টিস্নাতাও বলল— “আমি টাকা চাই না। ওর শাস্তি চাই।” মেজোবাবু এবার বৃষ্টিস্নাতাকে বললেন— “দু-সপ্তাহ আগে ঢাকুরিয়া আমরি-তে ভর্তি হয়েছিলেন কেন?” বৃষ্টিস্নাতার মুখটা ক্ষণিকের জন্য ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু, তা কাটিয়ে উঠে বৃষ্টিস্নাতা উত্তর দিল— “ডায়রিয়া।” মেজোবাবু বললেন— “আপনি জানেন না ম্যাডাম, পুলিসের হাত কত লম্বা। যে-ডাক্তার আপনার চিকিৎসা করেছিলেন, যে-নার্স আপনার সেবা করেছিলেন তাদের তুলে এনে একটু জেরা করলেই সব সত্যি বেরিয়ে পড়বে।” মার্জিত বলে উঠল— “ও কেন, আমরি-তে ভর্তি হয়েছিল তার সঙ্গে এই কেসের কী সম্পর্ক? আমি তো স্বীকার করে নিয়েছি, আমি টাকা নিয়েছিলাম, ফেরত দিইনি। সব তো জলের মতো পরিষ্কার।” মেজোবাবু বৃষ্টিস্নাতাকে বললেন— “কাল যে কল রেকর্ডগুলো শোনালেন, সব কল তো ঢুকেছে পরশুদিন রাত আটটা থেকে নটার ভিতরে। পুলিসের চোখকে ফাঁকি দেওয়া এতই সহজ? কী সিনেমা করেন? এই স্ক্রিপ্টটা একদম দাঁড়াল না। এরকম গাঁজাখুরি সিনেমা বানিয়ে পুরস্কার পান?” বৃষ্টিস্নাতা ছাড়বার পাত্রী নয়, একটু ঢোক গিলে বলতে লাগল— “না, কলগুলো গত দু-বছরের। অন্য একটা ফোনে ছিল। গত পরশু ওই সময় অন্য ফোন থেকে আমার আইফোনে ট্রান্সফার করি।” মেজোবাবু ধমকে উঠলেন— “সেই ফোনটা কোথায়?”
— খারাপ হয়ে গেছে।
— বাহ! কলগুলো ট্রান্সফার করার পরক্ষণেই ফোনটা খারাপ হয়ে গেল?
— হ্যাঁ, খারাপ হব হব করছিল বলে কলগুলো এই ফোনে ট্রান্সফার করেছিলাম। ট্রান্সফার করার পরে সেই যে অফ হয়ে গেল আর অন করা যায়নি।
— নিয়ে আসুন ফোনটা। আমরা, পুলিসেরা সব পারি। আপনার অফ ফোনকেও অন করে দেব।
— ফোনটা তো আর নেই। আমি ফেলে দিয়েছি।
— কোথায় ফেললেন?
— কাল সকালে ‘লোহা ভাঙা টিন ভাঙা’ যাচ্ছিল, তাকে দিয়ে দিয়েছি।
— বাজে কথা। আপনি একটা স্ক্রিপ্ট লিখেছেন আর গত পরশু রাতে দুজনে মিলে পাঁচ অঙ্কের একটি শ্রুতি নাটক রেকর্ড করেছেন।
এতক্ষণ মেজোবাবু ও বৃষ্টিস্নাতার মধ্যে কথাবার্তা চলছিল। মার্জিত তার মধ্যে বলে উঠল— “আমি তো দোষ স্বীকার করে নিয়েছি। তারপর এত কথা আসছে কোথা থেকে? নিন, আমাকে গ্রেফতার করুন।” মেজোবাবু মার্জিতকে বললেন— “ডাব্লিউবিসিএস হতে গেলে কত পড়তে হয় আমি জানি। এত কষ্ট করে পাওয়া চাকরিটা এভাবে জলাঞ্জলি দেবেন?” মার্জিত বলল— “আমার শাস্তিই প্রাপ্য।” মেজোবাবু বললেন— “আপনার চাকরির দরকার ছিল না, বুঝতেই পারছি। চাকরির পরীক্ষায় বসতে গেলেন কেন? আপনার বদলে যার সত্যিই চাকরির দরকার আছে সে তো চাকরিটা পেতে পারত।” ঠিক সেই সময় আলেখ্যর প্রবেশ। আলেখ্য এসে বলল— “স্যার, একটি মেয়ে এসেছে। বৃষ্টিস্নাতা বসুর খোঁজ করছে।” মেজোবাবু বললেন— “মেয়েটির নাম কি মেঘাবৃতা মিত্র?” আলেখ্য অবাক হয়ে বলল— “আপনি কী করে জানলেন?” মেজোবাবু বললেন— “পাঠিয়ে দাও।” মেঘাবৃতা হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে মেজোবাবুর উদ্দেশ্যে বলতে লাগল— “এদের কথা একদম শুনবেন না। দুজনেই ডাহা মিথ্যে কথা বলছে।” মেজোবাবু মেঘাবৃতাকে বসতে বললেন। মেঘাবৃতা এবং মেজোবাবুর মধ্যে কথপোকথন চলতে লাগল। মেজোবাবু বললেন— “কেসটা প্রেমের, সেটা বুঝেছি। বাকিটা আপনি বলবেন।”
— বলুন কী জানতে চান।
— দু-সপ্তাহ আগে আপনার বান্ধবী কেন ঢাকুরিয়া আমরি-তে ভর্তি হয়েছিল আপনি জানেন?
— জানি। কিন্তু, বলাটা মনে হয় ঠিক হবে না।
— যা বোঝার বুঝে গেছি। এবার বলুন, এদের ব্যাপারটা কী?
— বৃষ্টিস্নাতার সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে। সব জেনেই মার্জিত ওকে ভালোবেসেছিল। কিন্তু, পরে মার্জিত আর পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছিল না। তাই সরে যেতে চায়। এর চেয়ে বেশি আমি কিছু জানি না।
মেজোবাবু এবার বেশ ক্ষেপে উঠে বৃষ্টিস্নাতা এবং মার্জিতকে বলতে লাগলেন— “পুলিসের সময় নষ্ট করতে আপনাদের লজ্জা করে না? দুজনেই মুচলেকা দিয়ে যাবেন— এরকম যেন আর কোনোদিন না হয়। আর এই যে মিস বৃষ্টিস্নাতা বসু। ডাকছি আপনার বাবাকে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট থেকে এক্ষুনি আপনার বাবার ফোন নাম্বার পেয়ে যাব। মুচলেকাটা বাবার সামনেই লিখবেন।” সেই সময় মার্জিত বলে উঠল— “ওকে যেতে দিন, স্যার। ওর কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার।” মেজোবাবু বৃষ্টিস্নাতার দিকে তাকিয়ে বললেন— “এখনো আপনি এই নিরাপরাধ ছেলেটির চাকরি খেতে চান?” বৃষ্টিস্নাতা এতক্ষণে ভাঙল, ওর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। মেজোবাবু মার্জিতকে বললেন— “কেন এই নাটকটা ফাঁদলেন?” মার্জিত বলতে লাগল— “বৃষ্টিস্নাতার রাগ, জেদ সামাল দিতে গিয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। দু-সপ্তাহ আগে ও ঘুমের ওষুধ খেয়ে যখন হসপিটালে ভর্তি হল, তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম— আর নয়। আমার জন্য একটা মানুষের প্রাণ চলে যাবে— এ হতে দেওয়া যায় না। তাই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বৃষ্টিস্নাতা প্রতিশোধ চায়। ও বলেছিল— ও আবার ওই একই কাজ করবে। মরে আমাকে জেলে পাঠাবে। আমি বলেছিলাম— না, তুমি বেঁচে থাকো। বেঁচে থেকেই আমায় জেলে পাঠাও। তাই এই প্ল্যান বানাই। টাকা-পয়সা সংক্রান্ত কেস হলে বৃষ্টিস্নাতার বদনাম হওয়ার সম্ভাবনাও কম। আমাদের সম্পর্কটাকে রাস্তায় টেনে নামাতে চাইনি। ওর বাবা-ময়েরও তো একটা সম্মান আছে।” মেজোবাবু চিৎকার করতে শুরু করলেন— “বেরোন। আপনারা দুজনে এক্ষুনি থানা থেকে বেরিয়ে যান। নয়তো, ধরে দুটোর বিয়ে দিয়ে দেব। জানেন তো, পুলিসেরা এরকম প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরে বিয়ে-টিয়ে দিয়ে দেয়? মার্জিতবাবু, ভালো তো বাসেন। জেলে যাওয়ার প্ল্যান না করে, প্রেমিকার পাশে থেকে লড়াই করুন। এটা তো একটা রোগ। চিকিৎসা করান।” তারপর মেঘাবৃতার উদ্দেশে মেজোবাবু বললেন— “অনেক ধন্যবাদ ম্যাডাম। বাধ্য হয়ে কাল আপনার ফেসবুক মেসেঞ্জারে মেসেজ করি। আপনি একজন নিরাপরাধ ব্যক্তিকে মিথ্যে কেসের হাত থেকে বাঁচাতে থানায় ছুটে এসেছেন, সত্যিই একজন দায়িত্ববান নাগরিকের পরিচয় দিলেন।”
তিনজনে বিদায় নেবার পর, আলেখ্য এসে মেজোবাবুকে বলল— স্যার, কী দিলেন মাইরি! বাইরে বেরিয়ে বৃষ্টিস্নাতা মার্জিতকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কাঁদছে।
— আর মেঘাবৃতা?
— ও তো হন হন করে হেঁটে চলে গেল দেখলাম।
— বেশ। ঈশ্বর ওদের শান্তি দিন!
মেজোবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

সীমিতা মুখোপাধ্যায় : কবি ও গল্পকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post