মাতৃত্ব

তরুণকুমার দে
শুরু
তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম। দুর্গাপুজোর রাতে পাড়ার মণ্ডপে যাত্রা দেখাটা ( বয়স্করা বলতেন – ‘যাত্রা শোনা’ ) খুব পছন্দের বিষয় ছিল। একবার ‘রাজা দেবিদাস’ নামে একটা জমজমাট যাত্রা হয়েছিল। তখন তো ছেলেরাই মেয়ে সাজতেন। রানি যিনি হয়েছিলেন, তাঁর চেহারাটা ছোটখাটো হলেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় অভিনয় করেছিলেন এবং গলায় জোরও ছিল। একটা জায়গায় ছিল – রাজার সেনাপতি ইসলাম খাঁর বিবিকে শত্রুপক্ষ ধরে নিয়ে গেছে শুনে তিনি খুব রেগে গিয়েছেন। ওই জায়গায় তাঁর সংলাপ ছিল এই রকমঃ
( নিজের বড় ছেলেকে ) ‘আমার আঠারোটা ছেলে তোমরা। সবাই বলে আমি রত্নগর্ভা। আজ আমি তার প্রমাণ চাই। এই ভুঁইফোড় আফগানকে (=বাংলার নবাব সোলেমান কররানি, যার নির্দেশে নারী হরণ হয়েছিল।) বুঝিয়ে দাও, যে ছাতকের মেয়ের গায়ে হাত তুললে মাথা দিয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।’
শিল্পী বলেছিলেনও অত্যন্ত উদ্দীপক ভঙ্গিতে। আমার তো সারা শরীর গরম হয়ে উঠেছিল। যাত্রা দেখছিলাম, তাই; নইলে হয়তো যারা সেনাপতির বিবিকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের লক্ষ্য করে দু/তিনটি পাটকেল ছুঁড়তাম। সেই সময়ে আমি তো বটেই, এমন কি আমি নিশ্চিত, ছোট বড়ো অন্য সব দর্শকই অপহারকের উপর বিষম ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন। অথচ দর্শকদের বারো আনাই ছিলেন আমার মতো অমুসলমান আর অপহৃত হয়েছিল সোফিয়া, এক বিবাহিতা মুসলমান নারী। হ্যাঁ, অপহারক ছিল এক ব্রাহ্মণ।
অন্য এক বছরে ওই পুজোর সময়েই দেখেছিলাম ‘ধর্মের বলি’ যাত্রা। পালা-কাহিনি অনুযায়ী বাংলার সুবেদার মুর্শিদকুলি খাঁ একদা হিন্দু ছিলেন। তাঁর সেই সময়ের ছেলে বজ্রনারায়ণ এবং মুসলমান হবার পরের ছেলে ফরিদ খাঁ যুদ্ধে সাংঘাতিক আহত হয়ে মুর্শিদকুলির হিন্দু স্ত্রীর কোলে মাথা রেখেছিল। যিনি ওই মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তিনি পুরুষ হলেও তাঁর কাঁদতে কাঁদতে বলা সংলাপ – (‘নিষ্ঠুর নিয়তি তোদের বাঁচতে দিলে না।’) আমার চোখে জলের ধারা নামিয়েছিল। বজ্রনারায়ণ হিন্দু হলেও ফরিদ যে মুসলমান, সেই ভাবনা আমার মনে মোটেও আসেনি। আশেপাশে যাঁরা বসেছিলেন, তাঁদের কারও চোখই শুকনো ছিল না। বুঝেছিলাম – তাঁরাও আমার মতো ওই মায়ের দুই ছেলেরই একসঙ্গে নিহত হবার বেদনারই শরিক হয়েছিল। সেই সময় বেশ বুঝতে পেরেছিলাম – কারও মনেই এই ভাবনা আসে নি যে, শোকাহত ওই মায়ের এক ছেলে হিন্দু হলেও অন্যজন মুসলমান।
ক্লাশ সিক্সে যখন পড়ি তখন পেশাদার দলের ‘প্লাবন’ যাত্রাপালা দেখেছিলাম। ওই পালাতে আর এক মাকে বুঝেছিলাম। ওই পালায় দেখানো হয়েছিল – দুর্গাপুজোর ঠিক আগেই হয়েছে বন্যা; মুসলমানদের একটি গ্রাম সম্পূর্ণ ভেসে গিয়েছে এবং পাশের গ্রামের এক ডানপিটে ছেলে তার সঙ্গীদের নিয়ে বন্যার্তদের উদ্ধারে নেমেছে। জলে ডুবে-যাওয়া এলাকা থেকে বিপন্ন মানুষদের নিয়ে এসে তারা জমিদারের চণ্ডীমণ্ডপ এবং নহবৎখানাতেই তুলেছিল। সেজন্যই জমিদারের দুর্গাপুজো সে বারের মতো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে জমিদার বিষম ক্রুদ্ধ হয়েছিল। তারপর থেকে জমিদারের সঙ্গে ডানপিটে ছেলেদের প্রায়ই সংঘর্ষ হচ্ছিল। বন্যার্তদের উৎখাত করবার জন্য এক রাতে চণ্ডীমণ্ডপ আর নহবৎখানায় জমিদারের লোকজন আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আগুনের মাঝে আটকে থাকা মানুষদের উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ডানপিটে যুবকের দল। এক ডানপিটে যুবক এক সদ্যবিধবা নারীর পরিবারকে আগুনের বেড়াজাল থেকে বাঁচাতে গিয়ে মারাত্মকভাবে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। এরপরে ওই যুবকের মা এসে ওই নারীকে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলেন। মেয়েটি উচ্চবর্ণ হিন্দুর বাড়িতে থাকতে সঙ্কোচ বোধ করছিল। সদ্য ছেলে হারাবার পরেও সেই মা তখন বলেছিলেন – ‘ছেলে যাকে কুড়িয়ে এনেছে, মা কি তাকে ফেলতে পারে ?’ যাত্রার আসরের চারপাশে বসে-থাকা কয়েক হাজার মানুষ ( আমিও ছিলাম তাঁদেরই একজন ) একসঙ্গে আসরের উপরে দাঁড়িয়ে-থাকা সেই প্রৌঢ়া মাকে ‘ঠিক ঠিক’ বলে সমর্থন আর অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। অথচ সেই মা ছিলেন হিন্দু, মেয়েটি মুসলমান।
আরো বছর তিনেক পরে দেখেছিলাম ‘ভৈরবের ডাক’ যাত্রাপালা। সেই পালায় শত্রুর হাতে বন্দী এক হিন্দু কিশোরকে খুন করা হয়েছিল। ছেলেটিকে মৃত্যুর আগে শুশ্রূষা করেছিল তাদেরই শত্রুপক্ষের এক মুসলমান সেনাপতির যুবতী মেয়ে। মারা যাবার ঠিক আগে ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ‘মা মা’ বলেছিল। মুমূর্ষুর সেই ডাক মেয়েটির মধ্যে ধর্ম-জাত-বর্ণ নিরপেক্ষ মাতৃত্ব-বোধের জন্ম দিয়েছিল। এরপরে সেই মেয়েটিকে আরও চারটি দৃশ্যে দেখা যেত। ওই দৃশ্যগুলোতে মেয়েটির ধর্ম-জাতি-বর্ণ নিরপেক্ষ রূপই চিত্রিত হয়েছিল আর তার অঙ্কুরোদ্গম হয়েছিল মুমূর্ষু ওই কিশোরের ‘মা’ ডাক শুনে। অভিনয় শেষে ওই চরিত্রটির আলোচনাই বেশি হয়েছিল দর্শকদের মধ্যে। আমার এক স্কুলের দাদা তো বলেই ফেলেছিলেন – ‘মায়ের ভালবাসার জাত মানে না , ধর্ম দেখে না, ছোটোলোক ভদ্রলোক বাছে না।
ভ্রাতৃদ্বন্দ্বের পরিণাম
পৃথিবীর নানা অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে ভ্রাতৃদ্বন্দ্ব ঘটেছে। প্রটেস্ট্যান্ট-ক্যাথলিক, ইহুদী-খ্রিস্টান, মুসলমান-খ্রিস্টান, বৌদ্ধ-বৈদিক, পৌত্তলিক-মুসলমান, হিন্দু-মুসলমান, শিয়া-সুন্নীর মধ্যে কখনো এশিয়া, কখনো ইউরোপ, কখনও আফ্রিকা, কখনো অন্য কোনো মহাদেশে দাঙ্গা হয়েছে, হচ্ছে। বিভিন্ন বয়সের নানা রাজনৈতিক দলের সভ্য এবং নিরপেক্ষ নারী-পুরুষ নির্যাতিত হয়েছে বারবার। প্রাণ হারিয়েছে বিভিন্ন ধর্ম-মত-গাত্রবর্ণ ও নানা সামাজিক-স্তরের অসংখ্য মানুষ। নানা সামাজিক-স্তর, গাত্রবর্ণ এবং নানা ধর্ম ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের অগণিত নারী (গণ পাশবিক নির্যাতনের পরে ) আহত বা নিহত, অপহৃত কিংবা ( ইচ্ছার বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগে তথা আসুরিক প্রথায় ) বিবাহিত হয়েছে। ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির ক্ষতি বা ধ্বংসের পরিমাণও সামান্য ছিল না। ১৯৪৭-য়ে দেশভাগের অব্যবহিত আগে ও পরে যে সব দাঙ্গা হয়েছিল, তার ফলে বাংলা ও পাঞ্জাবের বসতিগুলোর জনবিন্যাসের আমূল পরিবর্তন হয়ে ভারত ও পাকিস্থান দুটি রাষ্ট্রই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল। ‘In the nine months between August 1947 and the spring of the following year, between fourteen and sixteen million Hindus, Sikhs and Muslims were forced to leave their homes and fle to safety from blood-crazed mobs.’ [১] এর সঙ্গে যোগ করুন – ‘In the same period over 600000 of them were killed.’ এই ছবি তো শুধু ভারতীয় উপমহাদেশের। যে সুসভ্য ইউরোপিয়ানরা আমাদের শাসন করেছিলেন, তাঁদের প্রতিবেশী দেশে ১৫৭২-য়ে কী ঘটেছিল একই ধর্মমতের দুটি শাখার মধ্যে ? ‘….plotted by Catherine de’ Medici and carried out by Roman catholic nobles and other citizens….. homes and shops of Huguenots were pillaged and their occupants brutally murdered; many bodies were thrown into the Seine.’ [২]
আপাত দৃষ্টিতে বিস্ময়কর এই যে, অনেক সময়েই সামান্য কারণে কিংবা মিথ্যা রটনা বা গুজবের ফলেই ভয়াবহ দাঙ্গার জন্ম হয়। যেমন, ১৯৪১-য়ের দোলের সময়ে এক মুসলমান মহিলার গায়ে কিশোরদের রং দেবার পরে দাঙ্গা শুরু হয়ে বহু মানুষ নিহত কিংবা আহত হয়েছিল। ১৯৮৯-তে ভাগলপুরে দাঙ্গা হয়েছিল মুসলমানদের দ্বারা তাঁদেরই ভাড়াটে ইউনিভার্সিটির হিন্দু ছাত্রদের হত্যা করবার মিথ্যে সংবাদ প্রচার হবার পরে। ১৯৩০-য়ে একসঙ্গে হিন্দু-মুসলমান বাচ্ছাদের খেলতে খেলতে নিজেদের মধ্যে তুচ্ছ ঝগড়াকে উপলক্ষ্য করে পূর্ববঙ্গে ভয়াবহ এক দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছিল।
‘রাখীভাই’ পালায় গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ্ চিতোর আক্রমণ করেছিলেন এই অজুহাতে যে, তাঁর ভাইকে এক হিন্দু নারী প্রহার করেছে। আসলে ওই নারী মন্দিরে পুজো দেবার জন্য একটি থালায় মিষ্টান্ন সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সুলতানের ভাই মদ্যপান করে মানসিক বিবেচনা হারিয়ে সেই মিষ্টান্ন কেড়ে নিয়েছিল। ওই নারী তখন তাকে লাঠি দিয়ে কয়েকবার আঘাত করেছিল। ওই অজুহাতেই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। বাহাদুর শাহের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে চিতোর প্রায় ধ্বংস হয়েছিল। দু পক্ষের অনেক সৈনিক নিহত বা পঙ্গু হয়েছিল, কয়েক শো নারী আত্মহত্যা করেছিল। আগে থেকেই বাহাদুর শাহের চিতোর অধিকার করবার ইচ্ছা ছিল। ওই তুচ্ছ ঘটনাকে উপলক্ষ্য করেই তিনি সেই ইচ্ছা পূরণের দিকে এগিয়েছিলেন। ইতিহাস যাই বলুক, পালায় যা দেখানো হয়েছিল, সেটা সত্যমূলক ছিল।
‘বাঙালি’ পালার নাট্যদ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছিল একটি পাঠশালার প্রার্থনা ( ‘হিন্দুর যিনি ভগবান, মুসলমানের তিনি আল্লা, ক্রেস্তানের তিনিই গড….’ ) মূঢ় এক মুসলমান রাজকর্মচারীর বলপ্রয়োগ করে বন্ধ করবার চেষ্টায়। ১৯৩০-য়ে কংগ্রেসের একটি মিছিলের ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি দিতে দিতে মসজিদের পাশের রাস্তা দিয়ে যাওয়া নিয়েই ভয়াবহ একটি দাঙ্গা হয়েছিল। ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি তখন রাজনৈতিক শ্লোগানে পরিণত হয়েছিল। আর মসজিদে হচ্ছিল ধর্মীয় প্রার্থনা। কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতার জন্য অহিংস আন্দোলন চালাচ্ছিল। সেই আন্দোলনের শরিক মুসলমানরাও ছিল। অন্যদিকে ইসলাম তার অনুগামীদের মানসিকতাকে সবদিক থেকে উন্নত করবার পথই দেখায়। অথচ ওই শ্লোগানের শব্দে প্রার্থনায় বাধা পড়ছে – সেই ধারণাকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল দাঙ্গা। বেশ বোঝা যায়, কল্পনা যোগ করে মর্মান্তিক বাস্তবকেই ‘বাঙালী’ পালায় তুলে ধরা হয়েছিল। যেহেতু যাত্রাপালা যুগপৎ আনন্দ এবং শিক্ষার মাধ্যম, সেইজন্যই পালাকার খুব ভেবেচিন্তেই কাল্পনিক episode-টি নির্বাচন করেছিলেন।
দাঙ্গার অন্তর-বাহির
দাঙ্গা কালে এবং অব্যবহিত পরে কী হয় ? শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দাঙ্গার ইতিহাস’ ( মিত্র ও ঘোষ, চতুর্থ পৌষ ১৩২১ মুদ্রণ ) গ্রন্থে পাওয়া যায় –
[ক] ‘….বহু নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করা ও জোর করে দাঙ্গায় সদ্যবিধবা ও তরুণী-বৃদ্ধাকে….বিবাহ দেওয়া।’ পৃষ্ঠা ৬৪ ( নারী-নির্যাতন )
[খ] ‘দাঙ্গায় মোট ৪৬ জন নিহত হয় এবং ৩৯ জন আহত হয়।’ পৃ: ৬৫ ( হত্যা এবং হত্যার চেষ্টা ) – এটি একটি দাঙ্গার ফলশ্রুতি।
[গ] ‘….বিদ্বিষ্ট ব্যক্তিদের ধরান-আগুন কোরান ও রামায়ণকে এক সঙ্গে ভস্মসাৎ করে।’ পৃ: ৯১ ( সম্প্রদায়-নির্বিশেষে মানুষের ধর্মীয় আবেগে আঘাত) – এটি আর একটি দাঙ্গার পার্শ্বচিত্র।
[ঘ] ‘লিওনারড মোসলের অনুমান পাকিস্তান এলাকার অমুসলমানদের শতকরা ৪০ ভাগ অর্থাৎ প্রায় দেড় কোটি নর-নারী-শিশুকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে শরণ নিতে হয়। ভারত থেকেও বেশ কয়েক লক্ষ মুসলমান সমান পীড়িত ও অসহায় অবস্থায় পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়।’ পৃ: ৭৩ ( বাস্তুচ্যুতি ) – ১৯৪৭-য়ের আগে-পরে ঘটে যাওয়া দাঙ্গার পরিণামের একাংশ।
[ঙ] ‘লুটপাট ও অগ্নি-সংযোগ যথারীতি চলতেই থাকে।’ পৃ: ৪৮ ( সম্পদ-হানি )
আর কী হয়ে থাকে ?
[চ] ‘কালক্রমে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় সমাজবিরোধীদের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং তাদের কর্মের পরিধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। পৃঃ ১৭৯ ( আইন-শৃঙ্খলার স্থায়ী অবনতি )
[ছ] ‘….দোকানগুলির মালিকানা নিয়ে লুণ্ঠনকারীদের কোন মাথা ব্যথা নেই।’ পৃ: ১৮০ ( নির্বিচার লুণ্ঠন )
[জ] ‘….গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি ও চালানের এই ব্যবসা বন্ধ করার ক্ষমতা আপাততঃ পুলিশের নেই।’ পৃ: ১৮১ ( শান্তি রক্ষকদের অসহায়তা ) – একালের স্বাধীন ভারতের চিত্র।
[ঝ] ‘উন্নততর আগ্নেয়াস্ত্রের জন্য পাক-বাংলাদেশের সীমান্তের চোরাচালান এবং তাদের রসদের জন্য পুলিশ তো বটেই এমন কি সামরিক বাহিনীর ভাণ্ডার থেকেও পাচার ও রমরমা ব্যবসায়ের খবর সংবাদপত্রের পৃষ্ঠাতেই পাওয়া যায়।’ পৃ: ১৮১ ( বেআইনী অস্ত্রের প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতা ) – সাম্প্রতিক ভারতের চিত্র।
[ঞ] ‘দেশে বর্তমানে পেশাদার দাঙ্গা সংঘটনকারীদের সৃষ্টি হয়েছে।’ পৃ: ১৮৩ ( দাঙ্গা-সৃষ্টির পেশায় পরিণত হওয়া ) – দাঙ্গাকারীদের লক্ষ্য সম্পদ আহরণ।
তিনি আরও একটি আতঙ্কপ্রদায়ক মন্তব্য উল্লেখ করেছিলেন, যা ছিল পুলিশ কমিশনের একদা সদস্য এন এস সাকসেনার –
‘অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই মোটামুটি গুণ্ডাদের কার্যকলাপের পরিণাম। সুতরাং দাঙ্গার মূল কারণ হল – গুণ্ডাদের উপর নিয়ন্ত্রণ লোপ পাওয়া।’ এরই সঙ্গে মি সাকসেনার হতাশ উক্তিও উদ্ধৃত করা হয়েছিল – ‘এই সব গুণ্ডাদের পিছনে প্রবল রাজনৈতিক আনুকূল্য থাকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কোন রকম ফৌজদারী মামলা দায়ের বা তদন্ত কার্য আরম্ভ করা সম্ভব হয় না।’ পৃ: ১৮০ ( দাঙ্গাকারীদের নির্ভীক ও নিশ্চিন্ত ভাব ) গ্রন্থকার মূল যন্ত্রী(দের)ও চিহ্নিত করেছিলেন। [৩]
স্বাধীনতার শৈশবে একটি গ্রামের কাহিনি
পালাটি শুরুই হয়েছিল ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা পাবার ঠিক পরে। ১৯৪৬-য়ে কলকাতা, নোয়াখালিতে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল। ( পরে বিহারেও ভয়াবহ হানাহানি হয়েছিল। ) সেই দাঙ্গার স্মৃতি তখনও আবছা না হলেও এবং স্বাধীনতা-লগ্নেই বাংলা ( এবং পাঞ্জাবে ) সংখ্যালঘুদের মনে ভবিষ্যৎ চিন্তার জন্ম হলেও, ওই বঙ্গের হিন্দু-বৌদ্ধ-জৈনরা ( এবং পশ্চিম পাঞ্জাবের শিখ ও হিন্দুরা ) এবং এই বঙ্গের ( এবং পূর্ব পাঞ্জাবের ) মুসলমানরা অনেকে স্বাধীন হবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের জন্মস্থান ত্যাগ করবার সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের এমনই একটি পরিবারের বাস্তুচ্যুত হবার ঘটনা দিয়েই ব্রজেন্দ্রকমার দে-র ‘কাঁটার বাসর’ যাত্রাপালার প্রস্তাবনা হয়েছিল।
পীরগঞ্জ গ্রামের রায়- পরিবার ছিল উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর । সেই পরিবারের বড় ছেলে বিনয় ওকালতি করতো কলকাতায়। গ্রামের বাড়িতে থাকতেন তার বিমাতা সত্যভামা এবং বৈমাত্রেয় ছোটো ভাই মলয়। বিনয় ভাল ছাত্র এবং সৎ স্বভাবের মানুষ ছিল। বর্ণাভিমান বা সাম্প্রদায়িক মানসিকতার উর্ধে ছিল সে। অন্যদিকে মলয় পড়াশোনায় মোটেও মনোযোগী ছিল না। তার উপরে সে ছিল গোঁয়ার, হঠকারী ও অনেকটাই আত্মকেন্দ্রিক এবং কিছুটা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন। সত্যভামা ছিলেন সাধারণ গ্রাম্য মা। বিনয় এবং মলয়ের প্রতি তাঁর সমানই স্নেহ লক্ষ্যিত হোত। সত্যভামার টান কিছুটা বেশিই ছিল সৎ ছেলে বিনয়ের দিকে। আর ছিল ভগীরথ। সে ছিল নৃত্যকালী ( ‘রামের সুমতি’ ), কদম ও ভৈরব ( ‘বিন্দুর ছেলে’ ) এবং ধর্মদাস ( ‘দেবদাস’ )-য়ের আদলে সৃষ্টি হওয়া এক ‘পুরাতন ভৃত্য’। পালার সূচনা হয়েছিল বিনয়ের আসন্ন বিয়ের দিন কয়েক আগে। বিনয়ের সেটি হতে যাচ্ছিল দ্বিতীয় বিয়ে। বিনয়ের প্রথম স্ত্রী বিয়ের দু বছর পরে এক বছরের একটি ছেলেকে রেখে প্রয়াত হয়েছিল। তখন সত্যভামা দ্রুত বিনয়ের দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করেছিলেন। সেই বিয়ে উপলক্ষ্যেই বিনয় গ্রামের বাড়িতে এসেছিল।
সেই সময়ে এক রাতে বিনয়দের বাড়িতে চোর ঢুকেছিল। অবশ্য মলয় চোরকে ধরে ফেলেছিল। এর আগেই দেশভাগ হয়ে পীরগঞ্জ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। তখনও ক্ষমতাসীন পক্ষের শাসনব্যবস্থা অনেকটাই শিথিল ছিল। স্বাভাবিকভাবেই সুযোগ-সন্ধানীরা, বিশেষ করে, সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কিছুটা প্রভুসুলভ আচরণ করছিল। আইন-শৃ্ঙ্খলা ব্যবস্থাতেও তার প্রভাব পড়েছিল। মলয়ের ধারণা ছিল যে, ধৃত অপরাধীকে পুলিশের হাতে দিলে তার কোনো বিচারই হবে না। কারণ চোর ছিল ইউনিয়ন বোর্ডের সদস্য এবং সে মুক্তিই পাবে। [৩] মলয় নিজেই চোরকে দণ্ড দিয়েছিল বেঁধে প্রচণ্ড প্রহার করে। সত্যভামা তাকে বাধা দিয়েছিলেন। কিন্তু মলয় তাঁর বাধা মানে নি। ভোরের দিকে প্রহারে জর্জরিত চোরকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরে কী হয়েছিল তা পালাকার সরাসরি বলেন নি। পালার চরিত্রগুলোর কেউ চোরের লজ্জায় আত্মহত্যা করবার তথ্য দিয়েছিল। অন্যেরা অতিরিক্ত প্রহারে চোরের মৃত্যু হয়েছে – এমনই বলেছিল। কিন্তু চোরের মৃত্যু ওই অঞ্চলের স্বার্থান্বেষী মহলের কাছে উচ্চ মধ্যবিত্ত বিনয়দের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি যথাক্রমে অধিকার ও লুণ্ঠন করা এবং বিনয়ের পরিজনদের হত্যা-করা বা ধর্মান্তরকরণের পথ উন্মুক্ত করেছিল। প্রৌঢ়া সত্যভামাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র মহিলা। নইলে এর সঙ্গে দাঙ্গার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ নারী নির্যাতনও যুক্ত হোত।
লুণ্ঠনকারীদের আগমন-সংবাদ পেয়ে বিনয় মলয়, ভগীরথ এবং সত্যভামাকে নৌকায় চাপিয়ে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাড়িতে লুকিয়ে-রাখা বহু মূল্যবান গয়না নিয়ে পরে পশ্চিমবঙ্গে চলে যাবার পরিকল্পনা ছিল তার। বিনয় জানতে পেরেছিল যে, তার এক-সময়ের সহপাঠী রসুল ওই লুণ্ঠনকারীদের নেতা। তার বিশ্বাস ছিল – রসুল কখনও সহপাঠী বিনয়ের ক্ষতি করবে না। বিশেষত বিনয় এক সময়ে রসুলের উপকার করেছিল।
ভ্রাতৃত্বের সমাধি
রসুল অবশ্য উপকারের স্মৃতি বা বন্ধুত্বের আহ্বান কিংবা মানবিকতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। সে বিনয়দের সম্পত্তি যতটা সম্ভব অধিকার করতে চেয়েছিল। পালাকার ওই নাট্যমুহূর্তে যারা দাঙ্গার পরিকল্পক, তাদের মনোভাবই তুলে ধরেছিলেন। পালার শেষ দিকে রসিদ তার উত্তমর্ণ ফকির মোল্লাকে বলেছিল – ‘আর একটা দাঙ্গা হাঙ্গামা বাধিয়ে দিয়ে আপনার টাকা কড়াক্রান্তি পর্যন্ত শোধ করে দেব।’ উত্তরে হতাশার সঙ্গে উত্তমর্ণ বলেছিল – ‘একটা সোমত্ত মেয়ে পর্যন্ত এখানে নেই, যা দিয়ে তুমি দেনা শোধ করবে।’ বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যুবতীদের সম্পর্কেই ইঙ্গিত করা হয়েছিল। [৪] ধর্ম বা সম্প্রদায়ের অবমাননার শ্লোগানের পিছনে ব্যক্তিগত প্রাপ্তিই ক্রিয়াশীল ছিল রসিদের মনে, যা প্রায় সব দেশে সব কালে প্রায় সমস্ত দাঙ্গাকারীদের সম্পর্কেই সত্য।
রসিদ তার আত্মীয় ওই চোরের মৃত্যুকে হত্যারূপে চিহ্নিত করে মলয়কেই ওই ঘটনার জন্য দায়ী করেছিল। রসিদের বক্তব্য ছিল – ‘চুরিই যদি করে থাকে, পুলিশে দাও নি কেন ?’
বিনয় উত্তরে সেই সময়ের পুলিশের প্রায় নিষ্ক্রিয়তাকেই উল্লেখ করেছিল। [৫] কিন্তু রসিদ তাতে শান্ত হয়নি। রসিদ মুসলমানদের প্রতি হিন্দুদের অমানবিক আচরণের স্মৃতি ভোলেনি। তাই সে ‘আমাদের এরা (=হিন্দুরা) মানুষ বলে গ্রাহ্য করেনি’ বলে ক্রোধোন্মত্ত সঙ্গীদের ‘মার্ মার্’ ধ্বনি দিয়ে আরও উত্তেজিত করেছিল। বিনয়ের আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স ছিল। সে লুণ্ঠনকারীদের কিছুক্ষণ বাধাও রেখেছিল। কিন্তু গুলি ফুরিয়ে যাবার পরে রসিদের দল তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। [৬]
রসিদ বাস্তবে ছিল নিম্ন-মধ্যবিত্ত। [৭] সে সম্পত্তি বাড়াবার উদ্দেশ্যেই দাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়েছিল। বিনয়ের পরিবারের যে অনেক সোনার গয়না ছিল – এটা তার জানা ছিল। সেই সময়ে উচ্চ মধ্যবিত্তদের ব্যাঙ্কের locker ব্যবহার-করা সীমিত ছিল। ব্যাঙ্কের শাখাও সংখ্যায় কম ছিল। বাড়িতেই গয়না বিশেষ কোথাও রাখা হোত। হিংস্র লুণ্ঠনকারীদের প্রহারে যখন বিনয় সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিল, তখন রসিদ সঙ্গীদের থামিয়েছিল এই বলে যে, বিনয়কে কলমা পড়িয়ে সে একটি মুসলমান মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবে। তথ্য এই জানায় যে, দাঙ্গার ঘটনায় পাকিস্তানে কেবলমাত্র নারীর নয়, পুরুষের ধর্মান্তরকরণও হয়েছিল। [৮] দাঙ্গা প্রশমিত হলে এবং প্রশাসন কিছুটা কঠোর হবার পরে কোথাও কোথাও ‘তারা ( = ধর্মান্তরিতরা ) স্ব-অবস্থানে ফিরে আসে বলে জানা যায়।’ [৯] যাত্রাপালায় বিনয়ের ক্ষেত্রেও তেমনই দেখানো হয়েছিল।
নারী-নির্যাতন
যে সব অঞ্চলে দাঙ্গা হয়েছে, সেই সব অঞ্চলের নারীদের দুর্ভোগ পুরুষদের থেকেও অনেক মর্মান্তিক হয়েছে। হিটলারের আমলের জার্মানি ছাড়া সব দেশের ক্ষেত্রেই চিত্রটি ছিল প্রায় একই রকমের। এই উপমহাদেশে দাঙ্গাপীড়িত গ্রাম ও শহরের বিপুল সংখ্যক নারী অপহৃত ও ধর্মান্তরিত হয়েছিল। হিন্দু হলে তাদের অনেককে বলপ্রয়োগ করে ( সদ্যবিধবা অথবা সধবা হলেও ) বিয়েও করা হয়েছিল। কিন্তু যে সব মুসলমান নারী হিন্দুদের দ্বারা অপহৃত হয়েছিল ? সব সম্প্রদায়ের অপহৃত নারীদের একাংশ নিদারুণ গণ-পাশবিক অত্যাচারের ফলে মারা গিয়েছিল এবং অনেকেই আত্মহত্যা করেছিল। অন্যদের ? বিয়ে করা হয়েছিল অবশ্যই অমুসলমান নারীদের অনেককে। মুসলমান নারীদের অধিকাংশেরই সেই স্বীকৃতিটুকুও জোটেনি। কারণ মুসলমানীকে বিয়ে-করা হিন্দুর সংস্কারের বিরুদ্ধ ছিল। পরিণামে তাদের মধ্যে যারা অমুসলমানদের অবরোধে থেকে নিয়মিতভাবে নিগৃহীত হচ্ছিল, তারা আক্ষরিক অর্থেই ‘sex-slave’-য়ে পরিণত হয়েছিল। [১০] কিন্তু যে দিকটি প্রায় অনালোচিতই থেকে গেছে, বিনয়কে ঘিরে ( কিছুদিন নূতন সমাজে কাটিয়ে পূর্বের পরিবেশে ফিরে যাবার পরে পুরুষদের ক্ষেত্রে যে সম্ভাবনা ছিল। ), বিরল সেই সমস্যাকেই পালাকার সামনে এনেছিলেন।
দাঙ্গাকারী
বিনয়দের পরিবারের অস্থাবর সম্পত্তি নিজের অধিকারে নিয়ে আসবার জন্য রসিদ নিজের যুবতী বোন রুকমীর সঙ্গেই বিনয়ের বিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য কলমা-পড়া এবং বিয়ের অনুষ্ঠানের সময়ে বিনয় গুরুতর আহত এবং প্রায় অজ্ঞান ছিল। রুকমীর অন্য এক উচ্চশিক্ষিত ও অধ্যাপক মুসলমান যুবকের সঙ্গে বহুদিনের পূর্বরাগ (=courtship) ছিল। এমন কি সেই ওই বিয়ে সম্পর্কে রসিদের অমত থাকবার জন্য গোপনে সেই যুবকের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে civil marriage করবার বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে দাঙ্গার কিছু দিন আগে রুকমী প্রেমিককে চিঠিও দিয়েছিল। কিন্তু সম্পত্তির লোভে রসিদ ‘জোর করে’ বিনয়ের সঙ্গে রুকমীর বিয়ে দিয়েছিল। পরে দেখা হলে প্রেমিককে রুকমী জানিয়েছিল – ‘বিয়ে করতে তাঁরও ( বিনয়ের ) ইচ্ছা ছিল না’, রুকমীরও আপত্তি ছিল। এই উপমহাদেশে অভিভাবকরা বিয়ের সময়ে কী ভাবে নারীর ইচ্ছা- অনিচ্ছাকে দলন করে, এটি ছিল তারই নিদর্শন। তবুও রুকমী বিনয়কে মন থেকেই গ্রহণ করেছিল। শৈশব থেকে হিন্দুদের পাশাপাশি থাকবার জন্যই যে রুকমীর মনে হিন্দুসুলভ ওই মানসিকতা সৃষ্টি হয়েছিল – পালাকার কৌশলে তা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন – সংস্কৃতি, এমন কি আচারকেও ‘লক্ষ্মণের গণ্ডী’তে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। তবে পালাকার তাঁর অন্য পালায় অভিভাবকদের বলপ্রয়োগে দেওয়া বিয়ের বিরুদ্ধেই একাধিকবার অসম্মতি জানিয়েছিলেন।
একটি বিরল দৃষ্টান্ত
আহত এবং প্রায় মরণাপন্ন বিনয়কে রুকমী সেবাশুশ্রূষা করে সুস্থ করে তুলেছিল। আহত ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত বিনয় শত্রুপুরীতে বিছানার পাশে একমাত্র সহায় দেখেছিল রুকমীকে। ধীরে ধীরে সে মানসিকভাবে রুকমীর ঘনিষ্ট হয়েছিল। সেবা করতে করতে রুকমীও বিনয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। তার উপর শৈশব থেকে হিন্দুদের পাশাপাশি থাকবার জন্য রুকমীর মনের গভীরে অনেক হিন্দুসুলভ সংস্কার প্রবেশ করেছিল। সে দেখেছিল যে, গুরুতর আহত বিনয় কলমা পড়ার সময়ে প্রায় জ্ঞানহীনই ছিল। রুকমীর মতে ‘কলমা তিনি( = বিনয় ) পড়েন নি, পড়েছে মোল্লা মৌলবীরা।’ রুকমীর মতে, বিনয় হিন্দুই ছিল। হিন্দু-সংস্কারে সম্পৃক্ত রুকমী ধরে নিয়েছিল যে, সে মুসলমানের মেয়ে হলেও হিন্দু পরিবারের বউ। পালাটির ঘটনাকাল সরাসরি বলা না হলেও, বোঝা যায় যে, স্বাধীনতা পাবার ঠিক পরেই দাঙ্গা, জন্মভূমি ত্যাগ, হত্যা, ধর্মান্তরকরণ, নারী-নির্যাতন দিয়েই পালার সূত্রপাত হয়েছিল। Special Marriage Act 1954 এবং Hindu Marriage Act 1955 তখনও গৃহীত হয়নি। তাই মুসলমানী রুকমী ও হিন্দু বিনয়ের বিয়ের স্বীকৃতি অথবা বিচ্ছেদ – দুইই খুব জটিল অবস্থানেই ছিল। বিশেষত দুজনেরই নাগরিকত্ব তখনও চূড়ান্ত হয়নি। কারণ সাধারণ নির্বাচন প্রসঙ্গ তখনও ভারত-পাকিস্তান কোনো রাষ্ট্রের নেতাদের ভাবনায় ধরা দেয়নি। সুতরাং রুকমী-বিনয়ের বিয়েকে কয়েক বছর পরের ‘Muslim and non-Muslims can lawfully marry without changing their religion….’ – অনুযায়ী বিচার করাই সম্ভব ছিল, যদি বিনয়ের উপর বলপ্রয়োগের বিষয়টি অগ্রাহ্য করা যায়। কিন্তু এদেশে সেই আইন প্রচলনের আগেই বিনয় রুকমীকে পাকিস্থানে রেখে পশ্চিমবঙ্গে চলে এসেছিল। কাজেই কথিত ধর্ম অপরিবর্তিত রেখে ওই বিয়ে করা রুকমীর পক্ষে অসম্ভব ছিল। বিনয় ও রুকমীর বিচ্ছেদকে অগ্রাহ্য করবার কারণও পালায় ছিল। কারণ তাদের আলাদা না-থাকা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপেই ঘটেছিল। তা ছাড়া এদেশে চলে আসবার আগে বিনয়ের সঙ্গে রুকমীর একান্তে এই আলাপ হয়েছিলঃ
‘রুকমী।। আমাকে বিয়ে করেছ বলে সত্যই কি তোমার বড় কষ্ট হচ্ছে ?
বিনয়।। হয়েছিল। আজ আমার কোনো গ্লানি নেই। তুমি আমার মৃতদেহে প্রাণ দিয়েছ। এ প্রাণ তোমারই।’
বিশ্বস্ততা/ভালবাসা
রুকমীর জানা ছিল যে, তার সঙ্গে বিয়ে হবার সময়ে বিনয়ের বছরখানেকের একটি ছেলে ছিল। সেই শিশু এবং রায়-পরিবারের অন্য সবাই কলকাতাতেই ছিল – এও তার জানা ছিল। হিংস্র রসিদ এবং তার সাম্প্রদায়িক সঙ্গীদের নজর এড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে যদি সে কলকাতায় চলেও যেতে পারে, বিনয়ের পরিবারের সদস্যা হওয়া যে অনিশ্চিত, সে এও বুঝেছিল। সে আরও জানতো যে, বিনয়দের লুকিয়ে রাখা গয়না খুঁজে পাবার পরে রসিদের কাছে বিনয়ের প্রাণের আর কোনো মূল্যই থাকবে না। তাই একদিন গভীর রাতে রুকমী বিনয়কে গোপনে নদীপথে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেই সময়ে রুকমীর গর্ভসঞ্চার হয়েছিল। অবশ্য অত্যন্ত বিরল সামান্য কয়েকটি ঘটনার মতোই রুকমী তা বুঝতে পারেনি।
এটি পালাকারের কল্পনা ছিল না। স্বাধীনতা লাভের ঠিক আগে নোয়াখালিতে যে ভয়াবহ দাঙ্গা হয়েছিল, ছিল তারই পার্শ্বচিত্র। একটি দৈনিক সংবাদপত্রে ওই জাতীয় একটি তথ্য ছিল। পালাকার নিশ্চয় ‘রুকমী’-র পরিণতি নিয়ে চিন্তিত হয়েছিলেন। কারণ সেখানেও ‘রসিদ’-য়ের হাতের মুঠো থেকে শিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল। সংবাদপত্র আর কোনো তথ্য দেয়নি। কিন্তু সম্ভাব্য কিছু মুহূর্ত পালায় ছিল। রুকমীর সম্পর্কে বলা হয়েছিল – ‘গাঁয়ের মুসলমানেরা কত ঝুলোঝুলি করলে, রসিদ কত অকথ্য নির্যাতন করলে, কিছুতেই সে নিকে করলে না।’ অন্যদিকে বিনয়ের পীরগঞ্জে যাওয়া সম্ভব ছিল না । সে ক্ষেত্রে তার প্রাণ বিপন্ন হতে পারত। বিনয় তিনটি চিঠি দিয়েছিল, যার কোনোটাই রুকমীর হাতে পৌঁছয় নি। অবশ্য বিনয় নিজের ধর্মান্তরকরণ এবং রুকমীকে বিয়ে করবার বিষয়টি গোপন করে যার সঙ্গে বিয়ের আয়োজন হয়েছিল, সেই পাত্রীকেই বিয়ে করেছিল। সেই জন্যই ষোল বছর পরে দেখা হলে, সে চলে আসবার পরে রুকমী অন্য কোনো মুসলমান ছেলেকে বিয়ে করেনি শুনে বিনয় অবাক হয়েছিল।
লক্ষ্যণীয় রুকমীকে ‘এ প্রাণ তোমারই’ বলবার সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই আইনজীবী হয়েও বিনয় রুকমীর প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ গোপন করে বিয়ে করেছিল। ১৯৫৫-র হিন্দু-বিয়ের আইন প্রচলনের আগে এক স্ত্রী বর্তমানে হিন্দুদের আরও বিয়ে করায় আইনী বাধা ছিল না। কিন্ত বর্তমান স্ত্রী রুকমী এবং নির্বাচিত পাত্রী দুজনকেই বিনয় অন্ধকারে রেখেছিল। প্রথম জনকে জানাবার সুযোগ ছিল না; বিনয় সেই চেষ্টাও করেনি এবং দ্বিতীয় জনের কাছে গোপন করেছিল। রুকমীর সম্প্রদায়ে তালাকপ্রাপ্ত ও বিধবা নারীর বিয়ে প্রচলিত। দীর্ঘ বিচ্ছেদের কারণ দেখিয়ে তালাক পাওয়াও অসম্ভব ছিল না। তা সত্ত্বেও সে ওই পথ বেছে নেয় নি। অতএব বিশ্বস্ততা তথা ভালবাসা রুকমীরই বেশি ছিল।
মাতৃত্ব ও কর্তব্য
রুকমীর নিকাহ্ না করবার দুটি কারণ ছিলঃ প্রথমত, সে বিনয়কে ভুলতে পারে নি। সে তার ও বিনয়ের অনাগতের সন্তানের ভ্রূণকে বিনষ্ট করতে বা সন্তানকে অনাদর করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, বিনয়ের প্রথম পক্ষের শিশু সন্তানকেও সে পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত করতে চায়নি। কারণ রুকমী বিনয়ের পরিবারে স্থান না পেলে কর্তব্যের দায়ে হয়তো বিনয় রুকমীকে নিয়ে আলাদা থাকতো। [১১] তৃতীয়ত, সে তার মেয়েকে বিনয়ের মতোই শিক্ষা দিয়ে বিনয়দের পরিবারের স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। মেয়ের প্রতি তার স্নেহ ওইভাবেই কর্তব্যে পরিণত হয়েছিল। রুকমীর মাতৃত্বের চরম প্রকাশ ঘটেছিল রসিদ জোর করে রুকমীর মেয়ের সঙ্গে এক অশিক্ষিত মাতাল দুশ্চরিত্র ছেলের বিয়ে দিতে চাইলে। পাত্রটি ছিল রসিদের উত্তমর্ণের ছেলে। তার সঙ্গে ভাগ্নীর বিয়ে দিয়ে রসিদ ঋণশোধ করতে চেয়েছিল। একদা রুকমীর বিয়েও বোনের অমতে জোর করেই দিয়েছিল রসিদ। ফলে রুকমীর পরবর্তী জীবন দুর্বিষহ হয়েছিল। ভাগ্নী যে ওই ছেলের সঙ্গে সুখে থাকবে না, তাও রসিদ বুঝতো। কিন্তু এক সময়ে দাঙ্গায় নেতৃত্ব দেবার ফলে সে তার উত্তমর্ণের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু রুকমী নিজের জীবন বিপন্ন করেও মেয়েকে রক্ষা করতে চেয়েছিল।
অনুপস্থিত মা
পালায় চরিত্র হয়ে না এলেও, উল্লিখিত আর এক নারীও মাতৃত্বে উজ্জ্বল হয়ে এসেছিল। সে ছিল রসিদের বিবি। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছোটো বাড়িতে রসিদের পরিবারের সবাই থাকতো। রসিদের বিবির আপত্তি বা অসহযোগিতা থাকলে রুকমী কি বিনয়কে যথাযথ শুশ্রুষা করতে পারতো ? সে সব সময়েই রুকমীদের মঙ্গল চেয়েছিল। রসিদের বিবির সম্পর্কে রসিদের মন্তব্য সেই ইঙ্গিতই দেয়:
‘রসিদ।। সেই ত শ্বশুরকে রাহা খরচ দিয়ে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়েছে। শয়তানিকে আমি মেরে শুইয়ে দিয়ে এসেছি।’
বিনয় মাটির তলায় গয়না পুঁতে রেখেছিল। রুকমী কলকাতায় চলে আসবার আগে নিজের বাবাকে গয়না কোথায় আছে বলে এসেছিল। সেই গয়না তুলে রুকমী কাছে পৌঁছে দেবার জন্য রসিদের বিবিরও আগ্রহ ছিল। পালার সংলাপে প্রকাশ পেয়েছিল, তারও একটি যুবতী মেয়ে ছিল। ( রসিদের উল্লিখিত অশিক্ষিত মাতাল দুশ্চরিত্র ছেলের সম্পর্কে বলা ‘….ছেলের মতো পাত্র হয় না’-র উত্তরে রুকমীর ‘তোমার মেয়েকে দিয়ে দাও না’ সংলাপ দ্রষ্টব্য। ) রসিদের লোভী ও হিংস্র চরিত্র তার বিবির অজানা ছিল না। রসিদ খোঁজ পেলে গয়নার জন্য যে নিজের বাবাকেও ছেড়ে দেবে না, সে জানত। ওই গয়নার সাহায্যে নিজের মেয়ের শিক্ষিত সচ্চরিত্র সুপাত্রে বিয়ে হবার চিন্তাও সে মন থেকে দূর করেছিল। রুকমী অপরিচিত ও সহায়হীন শহরে অর্থাভাবে যে অসুবিধায় পড়বে, এও সে বুঝেছিল। সেই জন্যই সে রুকমীর কাছে ওই সম্পদ পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেছিল। রসিদের হাতে নিজের সম্ভাব্য নির্যাতনের আশঙ্কাও তাকে ন্যায়ের পথ থেকে সরাতে পারেনি। চরিত্ররূপে না এনেও রসিদের বিবিকে পালাকার এক বিস্তৃত মাতৃত্বে মহীয়ান করেছিলেন। তাঁর অন্য কোনো পালায় এই নিদর্শন নেই।
প্রসারিত মাতৃত্ব
যেহেতু বিনয় নিজের ধর্মান্তর এবং তার পরে রুকমীর সঙ্গে বিয়ের ঘটনা সম্পূর্ণ গোপন করেছিল, দাঙ্গার আগে চূড়ান্ত হয়ে-যাওয়া বিয়েতে কোনো বাধা আসে নি। তার সেই তৃতীয়া জীবনসঙ্গিনী গীতা ( সে জানতো দ্বিতীয়া ) পরম স্নেহে এক বছরের সৎ ছেলের সব ভার তুলে নিয়েছিল। ( বিনয়ের সংলাপ: ‘ছেলে জানতেই পারলে না যে তার মা নেই।’ ) শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সৃষ্টি সিদ্ধেশ্বরী ( ‘নিষ্কৃতি’ ) এবং বিন্দু( ‘বিন্দুর ছেলে’ )র মতোই গীতা বিনয়ের ছেলে অলককে নিজের সন্তানের মতোই ভালবেসেছিল।’ নারায়ণী ( ‘রামের সুমতি’ ) রামকে যেমন ভালবাসত, তেমনই প্রয়োজনে শাসনও করত। গীতার হৃদয়ে কিন্তু স্নেহই ছিল। বিনয়ও গীতাকে ওই বিষয়ে সাবধান করেছিল – ‘তুমি আদর দিয়ে দিয়ে ছেলেটার মাথা খাবে।’
অবশ্য গীতা বলেছিল – ‘মানুষের ছেলে,- মানুষ না হয়ে যদি জানোয়ার হও, তাহলে বুকের রক্ত দিয়ে যে তোমায় মানুষ করেছে, সেই তোমায় যমের মুখে তুলে দেবে।’
কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ হয়নি। পালাতেই আছে, গুরুতর অপরাধ করার জন্য বিনয় যখন ছেলেকে কঠোর শাস্তি দিতে যাচ্ছিল, তখন গীতা অলককে পালাবার সুযোগ করে দিয়েছিল। গীতাকে পালাকার সাধারণ মা-রূপেই চিত্রিত করেছিলেন। চরিত্রটিতে শুধু অপত্য-স্নেহই ছিল, ছিল না সন্তানকে সঠিক পথে চালনা করবার মানসিকতা। সে শুধু সোহাগই করেছিল, শাসন করেনি। ফলে অলক বিপথে চলে গিয়েছিল।
সর্বজনীন মাতৃত্ব
বিনয়, মলয়, গীতা, অলক এবং ‘পুরাতন ভৃত্য’ বৃন্দাবনকে নিয়ে সত্যভামা কলকাতার বাড়িতে সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। হঠাৎই সুযোগসন্ধানী মলয়ের কাছে বিনয়ের ধর্মান্তরকরণ এবং মুসলমানী-বিয়ের সংবাদ পৌঁছেছিল। শিক্ষাগত যোগ্যতা না-থাকা, কাজ না-জানা এবং কাজ করবার মানসিকতার অভাব, সর্বোপরি উগ্র স্বভাবের জন্য তার কোনো উপার্জন ছিল না। তাছাড়া সে নিয়মিতভাবে মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানও করত। খবর পাওয়া মাত্রই সে হীন পরিকল্পনা করেছিল। চোরকে প্রহার করবার সময়ে দেখা গিয়েছিল যে, তার আইনের উপর আস্থা নেই। চোরকে মাত্রাতিরিক্ত প্রহার করবার সময়ে বোঝা গিয়েছিল যে, মানবিকতাও তার নেই এবং সে ‘Give the devil his due’-তেও বিশ্বাস করে না। ছোটো ভাই উপার্জনক্ষম না হবার জন্য বিনয়ই তার পরিবারের সব ভার নিয়েছিল। লোভী মলয় রসিদের মতোই কৃতজ্ঞতা চাপা দিয়ে বিনয়কে বলেছিল – ‘তোমাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।’ সে খুব ভালো করেই জানত যে, বিনয় ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবে। এই নাট্যমুহুর্তে পালাকার সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের পশ্চাৎপট ব্যাখ্যা করেছিলেন। ইতিহাস বলে যে, সুলতানী আমল থেকে যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তাদের মুখ্য অংশই ছিল বৌদ্ধ, জৈন এবং নিম্নবর্ণের দরিদ্র মানুষ। মলয়ের দাবির উত্তরে বিনয় দাঙ্গার জন্য প্রধানত মুসলমানদের প্রতি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অমানবিক এবং নিষ্ঠুর আচরণকেই দায়ী করে দৃঢ় ভাবে অসম্মতি জানিয়েছিল। [১২] তার বিশ্লেষণে অনুযায়ী দীর্ঘদিনের অবমাননার ফলে ধর্মান্তরিত মুসলমানদের মনে যে ক্ষোভ জমা হয়েছিল, হিন্দুদের প্রতি হানা আঘাত তারই পরিণাম। বিনয়ের ওই বিশ্লেষণ অসম্পূর্ণ ছিল। পালায় বিনয়ের না-বলা অংশও রেখেছিলেন পালাকার রসিদ এবং কুসীদজীবী ফকির মোল্লার চরিত্র ও আচরণের মাধ্যমে। রসিদের মধ্যে যতখানি লোভ দেখা গিয়েছিল, তার অনেক বেশি ক্ষমতা লিপ্সা লক্ষ্যিত হয়েছিল ১৯৪৭-য়ের আগে অবিভক্ত ভারতের কিছু জননেতার আচরণে। যে জন্য স্বয়ং গান্ধীজীও নিঃসঙ্গতার শিকার হয়েছিলেন। [১৩] বিনয়ের কাছ থেকে প্রত্যাশিত উত্তর পেয়ে খুশি হয়ে মলয় বিনয়কে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিল। এই সময়ে অলক প্রাচীন ধর্মীয় প্রথাকে ব্যবহার করেছিল। বলেছিল – ‘তুমি যখন বিধর্মী, তখন আইনতঃ তুমি মৃত।’ আইনজীবী বিনয় অবশ্য উনবিংশ শতাব্দীর জ্ঞানেন্দ্রমোহন ঠাকুরের খ্রিস্টান হবার জন্য উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হওয়া এবং আদালতের রায়ে সেই সম্পত্তি ফিরে পাবার ঘটনা তুলে ধরে নি। বাড়ি ছেড়েই চলে গিয়েছিল। যাবার আগে বিনয় সত্যভামাকে সমস্তই জানিয়েছিল। অলক অবশ্য ভেবেছিল যে, যেহেতু বিনয় সৎ ছেলে এবং ধর্মান্তরিত, সত্যভামা গর্ভজাত সন্তান অলকের সঙ্গে ওই বাড়ীতেই থাকবেন। সত্যভামা বলেছিলেন – ‘তোর সঙ্গে কি থাকব ? তুই কী মানুষ ?’ লক্ষণীয়, সত্যভামার সংলাপের মধ্য দিয়ে পালাকার অন্ধ গোঁড়ামির সাহায্য নিয়ে অন্যের ক্ষতি যারা করে, তাদের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং তারা যে সর্বসাধারণের ঘৃণার পাত্র হয়, পরোক্ষে সেই দিকটিও প্রকাশ করেছেন।
মলয় তখন তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে, বিনয় অহিন্দু। জীবনের অধিকাংশ সময় পল্লীগ্রামে কাটানো প্রায় অশিক্ষিতা প্রৌঢ়া সত্যভামার উত্তর ছিল সুতীব্র এবং অনুকরণীয় – ‘ছেলের আবার জাত কি ?’
পালাকার তাঁর মধ্যযুগের পটভূমিতে রচিত অনেক পালায় সংলাপের মধ্য দিয়ে জন্মভূমির পরিচয়কেই আগে রাখবার বিষয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন।[১৪] যেহেতু মধ্যযুগে ভারতীয়ত্ব বোধের উন্মেষ হয় নি। সেজন্য ওই সব নাট্যমুহুর্তে ‘বাঙালিত্বকেই প্রত্যক্ষে নিয়ে আসা হয়েছিল। মুল লক্ষ্য ছিল, ধর্মীয় আনুগত্য ও বিশ্বাসকে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে না আনার পক্ষে প্রচার। কিছু কাল ধরে কোনো সরকারী ফর্মে ধর্মীয় পরিচয় লিখতে হয় না। ভারতের অধিবাসী – এই পরিচয় লিখলেই চলে। কিছু দেরিতে হলেও ওই সিদ্ধান্ত অভিনন্দন যোগ্য। ‘রাখীভাই’ পালায় আরও অগ্রসর হয়েছিলেন তিনি। বাদশা হুমায়ুনের সংলাপ ছিল – ‘আমরা হিন্দুও নই, মুসলমানও নই, সবাই ভারতমাতার সন্তান।’ [১৫] এটি অনৈতিহাসিক, কিন্তু প্রাসঙ্গিক – রচনাকালেও এবং এখনও। সত্যভামা চরিত্রের অপত্য স্নেহ তথা সর্বজনীন মাতৃত্ব পালাকার সকলের হৃদয়ে সঞ্চার করতে চেয়েছিলেন – পরিষ্কার বোঝা যায়।
উপসংহার
পালায় চারজন জননীকে ( একজন কেবল মাত্র সংলাপেই উল্লিখিত হয়েছিল। ) আনা হয়েছিল। রুকমী তার গর্ভজাত সন্তানের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়েছিল, যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। সে অবশ্য সৎ ছেলেকেও ভোলেনি। বিশেষ করে সেই ছেলের জন্যই যে বিনয়ের কলকাতায় যাওয়া প্রয়োজন, সে তা মনে করিয়ে দিয়েছিল। [১৬] কিন্তু অশিক্ষিত মাতাল দুশ্চরিত্র পাত্রের সঙ্গে রসিদ যখন তার মেয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিল, তখন সে রূঢ়ভাবেই প্রত্যাখ্যান করেছিল – ‘আমার মেয়েকে আমি যার তার হাতে দেব না।’
রসিদের বিবি আত্মীয়ার মেয়ের শুভ কামনা করবার পরিণামে নির্যাতন বরণ করেছিল। রুকমীর মেয়ের সঙ্গে রসিদের পছন্দের পাত্রের বিয়ে হলে সংসারের দারিদ্র্য দূর হবে এবং নিজের মেয়ের বিয়েও সুপাত্রে হবার সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, সে জানতো। কিন্তু নিজের মেয়ের সুখও (!) সে অন্যায় পথে আনতে চায়নি। রুকমীকে কলকাতায় পাঠিয়ে দিয়ে সে রুকমীর মেয়েকেও রক্ষা করেছিল।
গীতা সৎ ছেলেকে অন্ধভাবেই ভালবেসেছিল। কিছুটা ব্যতিক্রমী হলেও নিজে সন্তান গ্রহণ না করবার জন্য তা একেবারে অস্বাভাবিক ছিল না।
কিন্তু সত্যভামা একেবারে গ্রামের মানুষ হয়েও নিজের গর্ভজাত সন্তানের পরিবর্তে একদা ধর্মান্তরিত সৎছেলের সঙ্গেই বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। তাছাড়াও মুসলমানী রুকমীকেও গ্রহণ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে হিন্দু বিনয় ও মুসলমানী রুকমীর মেয়েকেও ঘৃণা করেন নি। ( সত্যভামার সংলাপ – ‘….আমার ছেলের বউ, আমার নাতনিকে আমি ফেলব কোথায় ?’ ) এই episode যদি সরলীকরণ মনেও হয়, অভিনন্দনযোগ্য; সেই সঙ্গে সাদরে গ্রহণীয়। এই নাট্যমুহুর্তে পালাকার সত্যভামার মুখে একটি ব্যঙ্গাত্মক(satirical) বাক্য ব্যবহার করে ধর্মীয় আচারের অসারতাও দেখিয়েছিলেন – ‘আমি কিন্তু বাবা গঙ্গাজল দিয়ে আগে নাইয়ে নেব।’
সৎছেলেকে বুকে টেনে নেওয়া কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটেও বিরল নয়। কিন্তু শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় শুনিয়েছেন সত্যভামা-বিনয়ের থেকেও মহত্তর মা-ছেলের একটি কাহিনি, যা সত্যই ঘটেছিল ১৭/৮/১৯৪৬-য়ে। সেইদিন সন্ধ্যায় কলকাতার মানিকতলায় একদল মুসলমান দুর্বৃত্তের মাঝ থেকে এক হিন্দু ভদ্রমহিলাকে উদ্ধার করেছিলেন টহলদার কিছু সৈনিক। সৈনিকরা তাঁদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবার আগে ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বাড়িতে ঢুকেছিলেন ‘….আমার দুই ছেলের লাশ পড়ে আছে উপরে। তাদের একবার শেষ দেখা দেখব।।[১৭] সৈনিকরা ভদ্রমহিলার সঙ্গে সেইখানে গিয়ে দুজন মুসলমান যুবকের মৃতদেহ দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন। ভদ্রমহিলা জানিয়েছিলেন যে মৃতেরা মুসলমান, ‘কিন্তু ….আমার ছেলে।’ [১৭] ওই দুই যুবক দুর্বৃত্তদের হাত থেকে ভদ্রমহিলার সম্মান রক্ষা করতে গিয়েই নিহত হয়েছিলেন।
আর এক মা-কে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল ১৯৮৯-য়ের ভাগলপুরের দাঙ্গার সময়। এক মুসলমান ভদ্রমহিলার সদ্যোজাত শিশু সন্তানকে নির্মম হিন্দু গুণ্ডারা রাস্তার ধারে ছুঁড়ে ফেলেছিল, যাতে তার জীবনান্ত হয়। কিছুক্ষণ পরে এক হিন্দু ভদ্রলোক ওই শিশুকে পেয়েছিলেন। তিনি শিশুটিকে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে নিজের জীবনসঙ্গিনীর হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। পরম স্নেহে ভদ্রমহিলা শিশুটিকে পালন করেছিলেন। পরিবেশ স্বাভাবিক হলে জানা গিয়েছিল যে, শিশুটির মা অন্য এক গ্রামে আছেন। অচিরেই শিশুটি মা-কে ফিরে পেয়েছিল। উল্লিখিত গ্রন্থে শৈলেশকুমার ওই ঘটনাটি বর্ণনা করে মন্তব্য করেছিলেন – ‘হিন্দু পালক পিতামাতার কল্যাণে নিশ্চিত মৃত্যুর উপর বিজয়ী হয়ে তার মুসলমান জনক-জননীর ঘরে জীবনের আরাধনা করছে ভারতের এক ভবিষ্যৎ নাগরিক।'[১৮]
মানিকতলার শহীদ যুবকদের মহানুভবতার কথা মনে রেখেও এটা বলা যায় যে, বয়োজ্যেষ্ঠা ভদ্রমহিলার সান্নিধ্যে বিধর্মী ওই যুবকরা নিশ্চয় মাতৃস্নেহ অনুভব করতো। [১৯] বিপরীতে ওই যুবকদের আচরণে বয়োজ্যেষ্ঠা ভদ্রমহিলাও অবশ্যই মাতৃভক্তির স্পর্শ লাভ করতেন। এই অনাবিল নিঃস্বার্থ সষীদ-শ্রদ্ধার সম্পর্কই ভুল-বোঝাবুঝি, ক্রোধ-বিদ্বেষ, আক্রমণ-প্রতিহিংসার চির অবসান ঘটিয়ে পারস্পরিক ভালবাসার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে – এই ছিল ব্রজেন্দ্রকুমারের বিশ্বাস। ‘কাঁটার বাসর’ পালার ভূমিকায় তিনি জানিয়েছিলেন যে, পালাটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আনয়নের লক্ষ্যে নিবেদিত। সামাজিক পালায় গতানুগতিক যৌনতা বা হিংস্রতা কিংবা প্রাচীন ক্ষয়িষ্ণু মুল্যবোধ পরিবেশনের পরিবর্তে আধুনিক সমাজ-সমস্যার চিত্র এবং তার দূরীকরণের সম্ভাব্য পথ পালার সূত্রে ব্রজেন্দ্রকুমার নির্দেশ করতে চেয়েছিলেন।
এই পালা পাঠ করবার পরে একটি মন্তব্য করা হয়েছিল এই মর্মে যে, ব্রজেন্দ্রকুমারের এই পালার চৌদ্দটি দৃশ্যের মাত্র প্রথম দুটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত; পরের বারোটি দৃশ্য কল্পনা মাত্র। ব্রজেন্দ্রকুমার উত্তরে সাহিত্য- সম্পর্কিত এই বাক্যটি উদ্ধৃত করেছিলেন –
‘….তথ্যের পাত্রকে আশ্রয় করে আমাদের মনকে সত্যের স্বাদ দেওয়াই (=সাহিত্যের) প্রধান কাজ।’ [২০]
তথ্যসূত্র
[১] Leonard Mosley – ‘The Last Days of the British Raj’; Jaico Publishing House, January 1968 ; Page 279
[২] Reference: https;//www.britannica.com> Massacre-of-Saint-Bertholomews-Day
Catherine ছিলেন ফ্রান্সের রাজমাতা। Britanicca এও জানাচ্ছে – ‘The masacre of St. Bertholomew’s day had for its background the political and religious rivalries of the court of France.’ Huguenots-রা ছিলেন জন ক্যালভিনের আদর্শে অনুপ্রাণিত প্রটেষ্ট্যান্ট। দুই পক্ষই ছিল মূলত খ্রিস্টান।
[৩] ‘এদেশে হিন্দু মুসলমান ভাইয়ের মতো পাশাপাশি বাস করে; এই লোকটা ধূমকেতুর মতো তাদের মাঝখানে এসে সব তছনছ করে দিয়েছে।’ ‘বাঙালী’, চতুর্থ অঙ্ক প্রথম দৃশ্য।
‘….এরা পরস্পরের সঙ্গে গলাগলি করে পরম শান্তিতে বাস করছে; বিরোধ যা কিছু হয়, সে ‘আপনাদের’ সৃষ্টি। ….আপনারা উচ্চাসনে বসে এদের দুঃখে মাঝে মাঝে যখন কেঁদে ওঠেন, তখনই এরা বেশি করে মরে।’ ‘ধর্মের বলি’, চতুর্থ অঙ্ক তৃতীয় দৃশ্য।
[৩] পালাটি ১৯৭০-য়ের প্রথমার্ধে রচিত হয়েছিল।
[৪] মোসলের উল্লিখিত গ্রন্থ স্মরণীয় ঃ ‘That morning, in the bazar quarter of Amritsar, the Sikhs rounded up a large group of Muslim girls and women, stripped them of their clothes, and then forced them to parade in a circle before the jeering crowd. Then a number of the choicest and youngest were dragged off and raped repeatedly. The others were chopped down by kripans,….’ Page 278
স্বয়ং গান্ধিজিও লিখেছিলেন –
‘আমার নিকট সংবাদ আসিয়াছে যে অদ্যাবধি মুসলমান রমণীগণ হিন্দু গৃহে আবদ্ধ আছেন।’ বিহার ডাইরি – অনুবাদঃ রতনমণি চট্টোপাধ্যায়; গান্ধী রচনা সম্ভার – ষষ্ঠ খণ্ড ‘, গান্ধী শতবার্ষিকী সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ, ফেব্রুয়ারী ১৯৭০, পৃষ্ঠা ১০০
‘ ‘পাকিস্তানে কতিপয় স্ত্রীলোক অপহৃতা হইয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে জন কয়েক নিষ্ঠুর ভাবে অত্যাচারিত ও ধর্ষিত হইয়াছেন।’ দিল্লী ডাইরি,…., পৃষ্ঠা ৩০৯
‘মুসলমান গুণ্ডারা বহু হিন্দু ও শিখ বালিকা অপহরণ করিয়াছে।’ ঐ,…., পৃষ্ঠা ৩১৫
‘পাকিস্তানে বহু সংখ্যক হিন্দু ও শিখ নারী অপহৃতা হইয়াছে। কেবল ভগবানই জানেন, তাহাদের উপর কি সব বিভীষিকা চলিতেছে। ভারত ইউনিয়নের হিন্দু ও শিখগণও তদপেক্ষা ভাল আচরণ করে নাই। আমি জানিতে পারিয়াছি যে, অপহৃতা মুসলমান মেয়েদের উপর কামোন্মত্ত দস্যুরা অকথ্য অত্যাচার করিয়াছে। ঐ,….,পৃষ্ঠা ৩১৫
‘কয়েক হাজার হিন্দু ও শিখ বালিকা মুসলমান কর্তৃক অপহৃতা হইয়াছে।’ ঐ,….,পৃষ্ঠা ৩৬৩
‘জম্মুতে বহু মুসলিম হত্যা ও মুসলিম বালিকাহরণের কথা আমি শুনিয়াছি।’ ঐ,…., পৃষ্ঠা ৩৬০
‘আমি শুনিয়াছি এক মুসলিম পীরের কাছে কয়েকজন হিন্দু ও শিখ বালিকা রহিয়াছে।’ঐ,…., পৃষ্ঠা ৩৬৩
[৫] ‘….থানা এজাহার নেয় না, আবার নিলেও তাদেরই নানা অছিলায় ধরে নিয়ে যায় নয়ত ভয় দেখায়।’ নোয়াখালির দুর্যোগের দিনে – অশোকা গুপ্তা; দে’জ পাবলিশিং, অক্টোবর ২০০৩ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩০
[৬] ‘প্রতিরোধ করিতে গিয়া সায়েস্তাগঞ্জে চিত্তবাবু অনেকক্ষণ লড়াই করিয়া প্রাণ দিয়াছেন।….তিনি যে দালানের ওপরে থাকিয়া গুলি ছুঁড়িতে ছিলেন….তখন বন্দুকের টোটাও ফুরাইয়া গিয়াছে।’ নোয়াখালীঃ ১৯৪৬ – সুহাসিনী দাস, সম্পাদনা – দীপংকর মোহান্ত; সাহিত্য প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৪
[৭] ‘নোয়াখালীতে মুসলমান ধনী বড় নাই।’ ঐ, পৃষ্ঠা ৩১
[৮] ‘….এই বিবৃতিতে দেখা যায় যে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে দুহাজার জনকে ও জোর করে বিবাহ দেওয়া হয়েছিল ছয়জনকে ও খুন হয়েছিল একজন।’ { লক্ষ্যণীয় – ‘জন’ বলা হয়েছে, নারী বা মেয়ে বলা হয়নি। } নোয়াখালির দুর্যোগের দিনে – অশোকা গুপ্তা-র উল্লিখিত গ্রন্থ, পৃষ্ঠা ৩১
[৯] সুহাসিনী দাসের উল্লিখিত গ্রন্থ, পাদটীকা, পৃষ্ঠা ৮০
‘রক্তের অক্ষরে’ { কমলা দাশগুপ্ত }-তে দুর্যোগ কেটে যাবার পরে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের নিজেদের ধর্মাচরণ পালন করবার উল্লেখ আছে।
[১০] গান্ধিজি ১৯৪৭-য়ের ডিসেম্বরের শেষে অপহৃতা হিন্দু ও শিখ যুবতীদের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন – ‘….তাহাদের কয়েকজন বলিয়াছে – তাহারা আর ঘরে ফিরিয়া আসিতে চায় না। সমাজ তাহাদের গ্রহণ করিবে না, এই তাহাদের ভয়।….তাহাদের কয়েকজন অন্তঃসত্ত্বা হইয়াছে।’ { পৃষ্ঠা ৩৬৩ } গান্ধিজি এও লিখেছিলেন – ‘….পাতিয়ালা, কাশ্মীর ও অন্যন্য স্থানে হিন্দু ও শিখগণ কর্তৃক অনেক মুসলমান বালিকা অপহৃতা হইয়াছে।’ { পৃষ্ঠা ৩৬৩ } । গান্ধিজি ওই সব নারীদেরও ফিরিয়ে দেবার আবেদন করেছিলেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে ওই নারীরা সবাই নিজেদের পরিবারে পুরানো স্থান ও মর্যাদা ফিরে পাবে।
কিন্তু মোসলের পাদটিকা বলছে – ‘A combined Pakistan-Indian Commission to trace these young women was petered out; principally, according to Pakistanis, because the Hindus refused to have their wives and daughters back – they had been defiled.’ তথ্যসূত্র [১]-য়ে উল্লিখিত গ্রন্থ ; পৃষ্ঠা ২৮১
এই বিষয়ে হিন্দু নারীদের তুলনায় মুসলমানীরা কিছুটা ভালো জায়গায় (?) ছিল। মুসলমান পুরুষরা বহু বিধর্মী নারীকে বিয়ে করেছিল। কিন্তু দাঙ্গার মূলে অন্য পক্ষের প্রতি নিদারুণ ঘৃণাও ক্রিয়াশীল থাকে। দাঙ্গা যত ব্যাপক হয়, ততই ঘৃণা বৃদ্ধি পায়। আরও একটা সত্য, এই উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানই মুলত হিন্দু ছিল। দীর্ঘকাল পাশাপাশি বাস করবার ফলে হিন্দুদের থেকে বহু কুআচার এবং কুসংস্কার মুসলমানদের ব্যবহারিক জীবনে প্রবেশ করেছিল (বিপরীতটিও সত্য।)। উভয় পক্ষের অপহৃত নারীদের মধ্যে যে সামান্য সংখ্যক ফিরে এসেছিল, তারা সকলেই কি পরিবারে এবং সমাজে সাদরে গৃহীত হয়েছিল ? নির্যাতনের ফলে যারা অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিল, তাদের কী হয়েছিল ? তাদের কতজন কিছুদিনের মধ্যে ‘তিন-তালাক’ শুনেছিল, সেই পরিসংখ্যান কি নেওয়া হয়েছিল ?
সিপাহী মহাবিদ্রোহের সময়ে কোনো এক নবাব দুজন ইংরাজ-অফিসার পত্নীকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। নবাবের দ্বারা তাঁদের একজন অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন। নবাবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অপরাধে প্রথমে নবাব এবং ওই দুই শ্বেতাঙ্গিনীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। পরে দণ্ড হ্রাস করা হয়েছিল। Michael Maclagan-য়ের ‘Clemency Canning: Charles John’ থেকে নেওয়া এই তথ্যটি পেয়েছি প্রেমাংশুকুমার চট্টোপাধ্যায়ের ‘নন্দন’ { ০৪/১২/২০০৭ } -য়ে প্রকাশিত ‘১৮৫৭, ‘করূণাকর ক্যানিং কলকাতা, উত্তর ভারত ও লন্ডন’ প্রবন্ধ { পৃষ্ঠা ৫০ } থেকে। সিপাহী মহাবিদ্রোহের কালে ভারতীয়দের প্রতি ইংরাজদের ঘৃণা চরমে পৌঁছেছিল। সাত দশক পরেও সেই মনোভাব যে অপরিবর্তিত ছিল, তার প্রমাণ জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস গণহত্যায় আর একবার পাওয়া গিয়েছিল। অধিকাংশ দাঙ্গার অনেক আগে থেকেই অমুসলমান এবং মুসলমানদের মধ্যে বিদ্বেষ (যা ক্রমে ঘৃণায় পরিণত হয়েছিল।) বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
[১১] বিনয়ের সঙ্গে রুকমীর যে কথা হয়েছিল, তা এই রকম –
‘রুকমী।। মা কি আমায় গ্রহণ করবেন ?
বিনয়।। তোমায় যদি গ্রহণ না করেন, আমাকেও তাঁর ত্যাগ করতে হবে।’
[১২] ‘হিন্দুর জাতিভেদ যে আকার ধারণ করিয়াছিল, তাহা নির্মম ও অকৃতজ্ঞতার চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত।….দেবমন্দিরে তাহাদের উঁকি মারিবার ক্ষমতা নাই;….ব্রাহ্মণের পা ছুঁইয়া ধূলি গ্রহণের অধিকার তাহাদের নাই;….ভদ্রগৃহস্থের পায়ে একটু জল দেওয়ার অধিকার তাহাদের নাই;- এই সকল অন্যায় ভ্রাতৃবিরোধ ও ঘৃণার রাজ্যে মুসলমান নির্ঘৃণ ও সর্বজনীন ভ্রাতৃভাব লইয়া আসিলেন।….আজ যদি হিন্দুর প্রাণে বিন্দুমাত্র ন্যায়-অন্যায় বোধ থাকিত, কৃতজ্ঞতার লেশ থাকিত, তবে কি পূর্ববঙ্গে শতসহস্র লোক মুসলমান হইয়া এদেশের সাম্প্রদায়িক প্রশ্নকে এত জটিল করিয়া ফেলিতে পারিত ?’ – দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, প্রথম খণ্ড, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫২২
১৩ ‘বলতেন, দীর্ঘ পথ পর্যটনের পরে এমন একটা জায়গায় এসে তিনি পৌঁছেছেন, যেখানে তাঁর নিজেকে বড় নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।….তিনি বললেন, “তুমি কি বুঝতে পারছ না যে, আজ আমি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ।” ‘ – সুধীর ঘোষ, গান্ধীজীর দূত, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৬৭ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৮৫ ‘ ( তিনি = গান্ধীজি)
[১৪] ‘আমি আগে বাঙালি, তারপর মুসলমান।’ – ‘বাঙালি’, প্রথম অঙ্ক পঞ্চম দৃশ্য, দায়ুদের সংলাপ।
‘আমরা আগে বাঙালি হয়ে জন্মেছি, তারপর হয়েছি মুসলমান।’ – ‘রাজা দেবিদাস’, দ্বিতীয় অঙ্ক প্রথম দৃশ্য, সোফিয়ার সংলাপ।
[১৫] প্রথম অঙ্ক চতুর্থ দৃশ্য।
[১৬] ‘….তোমার ছেলে তোমায় ডাকছে।’ – প্রথম পর্ব দ্বিতীয় দৃশ্য।
[১৭] ‘দাঙ্গার ইতিহাস’ গ্রন্থ পৃষ্ঠা ২৪৩
[১৮] ঐ, পৃষ্ঠা ১১৭
[১৯] ‘থাক তুই ইঁট কাঠ পাথর নিয়ে, আমি কুবেরের ভাণ্ডার নিয়ে চলে যাচ্ছি।’ মাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়বার সময় মলয়ের প্রতি বিনয়ের সংলাপ।
[২০] ‘সৃষ্টি’, গ্রন্থ – সাহিত্যের পথে,রবীন্দ্র রচনাবলী, চতুর্দশ খণ্ড, জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ, পশ্চিমবঙ্গ সরকার, পৃষ্ঠা ৩২০
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বক্তব্যও ছিলঃ ‘….মানুষ নিছক বাস্তব নয়। তার অনেকখানি অবাস্তব, অর্থাৎ তা সত্য।’ ‘সত্য ও বাস্তব’, গ্রন্থ – সাহিত্যের স্বরূপ, …., পৃষ্ঠা ৫৩৯
এবং ‘….রূপের মহলে রসের সত্যকে প্রকাশ করতে গেলে তথ্যের দাসখত থেকে মুক্তি নিতে হয়।’ ‘সৃষ্টি’,….,পৃষ্ঠা ৩১৭