সুকান্ত দে এর কবিতা

মা নিষাদ
ভেবেছিলাম, বন্ধুরা এসে খুঁজে নেবে
শব্দভেদী বাণ আর হৃদস্পন্দনের সম্পর্ক
ভেসে উঠবে চৌদ্দ মধুকর।
অথচ ভিড় এসে ঢেলে দিয়ে গেলো
ঝাঁঝালো নির্বাসনী তরল।
দেড়ফুট আয়ুর ভেতর
হাতড়ে হাতড়ে চোখ খুঁজি আর
বেঁচে থাকতে চেয়ে ঈর্ষা জমে যায়।
মনখারাপ বিষয়ক প্রবন্ধের ভেতর
মোটা অক্ষরে লেখা থাকে
‘মতি আর গৌরাঙ্গের মিলন হয়নি’
গম্বুজের চুড়োয় পড়েছে সোনার পড়ত
রাস্তার দুধারে ভিখারি
কাঙাল হরিদাস গ্রামে গ্রামে বার্তা দিয়ে ফেরে।
বন্ধুরা কবিতা লেখে
আমি তিনমহলার ঝরকাকাটা বারান্দা থেকে
কুচিকুচি কাগজ ওড়াই।
পেজ নং ১০৮৪
আবার একদিন নরম কবিতা লিখবো
যদি সে সরুফিতের লম্বা ফ্রক পরে
ছোটমেয়ের মতো জানলায় দাঁড়ায়
চোখ থেকে উপছে আসে সরল পৃথিবীর হাসি
প্রতিটা আঙুল থেকে বিপ্লবের নখদর্পণ
একটা একটা করে ওরা উপড়ে নিয়েছে
লিখতে গেলেই হাত কাঁপে
চোখের ওপর হাজার ওয়াটের আলো জ্বেলে
অন্ধকার করে দিয়েছে মানুষের বিশ্বাস
তাও একদিন আমি
প্রেমের কথা লিখবো
মাধবীলতার লালজমি-কমলাপাড় শাড়ির ভাঁজে
লুকিয়ে রাখা ঘ্রাণের কথা লিখবো
চৌরাস্তায়
পিঠ আর খুলি চুরমার করা বুলেট নিয়ে
উপুড় হয়ে পড়েছিল আমার লাশ
আমাদের লাশ
তারপরেও বলছি
পায়ের বুড়ো আঙুল থেকে
নম্বর আঁটা টোকেন খুলে
মর্গের দেরাজ খুলে বেরিয়ে এসে
ব্যস্ত রাস্তার ট্রাফিক থামিয়ে লিফট চাইবো
সেই যে মেয়েটি
বিপ্লবের ছেঁড়া আধময়লা চাদর গায়ে
এখনও বারবার পড়ে যায়
হাত বাড়িয়ে ধরতে চায়
একটা হলুদ বিকেলের স্বপ্ন
তার কাছে পৌঁছানোর জন্য
একদিন স্রেফ ইরেজার দিয়ে মুছে দেবো
ডোমের মোটা ছুঁচের সেলাইয়ের দাগ
তারপর ওর হাত ধরে
একটা নিশ্চিন্ত মৃত্যুর কাছে নিয়ে যাবো বলে
মডিউলেশন ছাড়াই
পড়ে যাবো সদ্যলেখা প্রেমের কবিতা
ও ফর্মালিনের শিশি থেকে
নিজের কাটা তর্জনিটা এনে বলবে-
‘পেজমার্ক দিয়ে রাখো
গঙ্গা দিয়ে বয়ে যাওয়া লাশের মিছিল দেখতে দেখতে
আমি এটা আবার শুনতে চাই’
পা ঠ প্র তি ক্রি য়া
আপনার পত্রিকায় আবার লিখতে চাই
হে সম্পাদক
তাতে কবিতা একঠ্যাঙে দাঁড়িয়ে থাকলে থাক
গোটা পত্রিকা পড়েই বলছি
সম্পাদনার বদলে কুলকুচো করেননি
যদিও লিখেছেন-
পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশ অনিশ্চিত হয়ে পড়ল
আক্ষেপ তো চারপাশে ছড়ানো
সারাটা জীবন পাতাবাহার হয়ে কাটিয়ে
শেষ বয়সে
সম্মানটম্মান তো আর পেলাম না
বলতে বলতে
চিৎপটাং
কবিতার হাঁটু অব্দি যেতেই গাঁটে বাত
মটমট শব্দ
পাঁজরের ঘুলঘুলি দিয়ে উড়ে যায়
‘সারে যাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারা’
অস্বীকার করার উপায় নেই
কুন্তল, শ্রুতিধর, তিলোত্তমা ভালো লিখেছে
রাণাদার সাথে ফোনে কথা হয় প্রায়ই?
জয়দেবের কবিতায় প্যারাফিন কোটিং আছে
খেয়াল করেছেন নিশ্চই
শ্বেত পারাবত কখনই আমার কাঁধে এসে বসেনি
শরীর আলিঙ্গন করতে চেয়েছে
ব্যক্তিগত মোহর
পেছনে গুঁজে নিতে চেয়েছি
মিডিয়ার তরল জ্বালানি
স্বপ্ন দেখেছি
তারা দেখার বিভ্রম নিয়ে তাকাচ্ছে জনতা
সেলফি তোলার কথা বলতে গিয়ে
তোতলাচ্ছে
অথচ ‘পেছন’ শব্দটা গোবর দিয়ে ঢেকে
মাথার মণি চুরি করে নিয়েছে
পুঁজিবাদী ব্যাধ
কাঁচা খিস্তিগুলো
আমরা খরচ করে ফেলেছি
চায়ের আড্ডায়
কফিহাউসে
তাই সমবেত মন্ত্রোচ্চারণ
শোনা যাবে না আর
শিল্পের কোনও মজুরী হয়না
বিদ্রোহ হয়
এসব ফোঁড়া আর জ্বলন
উত্তরাধিকার সুত্রে পেয়েছি যারা
তাদের শান্তি হয়না কিছুতেই
চিতায় পুড়তে পুড়তেও
উঠে বসে
ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে
আশ্বস্ত হয়
নাঃ নিজের বলতে একমাত্র ডোম।
ভ ঙ্গু র
কোনওদিন বলিনি
স্লিভলেস ব্লাউজে
তোমার লতিয়ে ওঠা হাত দেখার পর
মৃণাল শব্দটা
প্রকট হয়েছিল বেদ মন্ত্রের মতো
বিশ্বাস করো মৌদি
চল্লিশের পর আর বয়স বাড়েনা
তিরিশের দিকে হাঁটে
তোমার এপ্রিলে জন্ম আমার নভেম্বরে
আজ থেকে ঠিক
৫ বছর ৯ মাস ২১ দিন পর
আমাদের বয়স হবে সমান-সমান
সেদিন প্রমান করে দেবো
তোমার ওই হাত একটা জবাবী খাম
বাহু স্পর্শ করা মাত্রই ফুটে উঠবে
মিছরির দানার মতো অক্ষর
হ্যা, আমি অহরহ মিথ্যে বলি
এর আগেও এই তত্ত্ব শুনেছে অন্তত দশজন
বিশ্বাস করেনি
অথচ তাদের প্রতিবিম্বরা
লাল এবং গোল টিপ
আয়নার ফ্রেমে লাগিয়ে রেখে
বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল
লালমাটির কাঁকুড়ে পথে
যেখানে ঝরে পড়া বকুলের গন্ধ
বুনে দেয়
সহজিয়া আখর
হৃদযন্ত্রের কানায় কানায় মধু ভরে দেয়
একতারার বোল
রিচ বাড়ানোর কবিতা
ইতিপূর্বে আপনার অনেক কবিতায়
আমি লাইক দিয়েছি
কমেন্টও করেছি অনেক,
আর আপনি!
আমার ফেসবুকের ওয়ালটাকে
পর্দার মতো ভাঁজ করে
সরিয়ে রেখেছেন!
ভাঁজ হয়ে গেছে গৌতম বুদ্ধ
সুজাতা
এমনকি পায়েসের বাটিটাও
প্লিজ!
একবার আসুন
পায়েসের বাটিটা অন্তত এগিয়ে দিন
যাতে আমার সিদ্ধিলাভ হয়
দেশদ্রোহী
ইদানিং আমার সর্ভানুর কথা মনে পড়ে খুব
সেই যে গো
যে তার বন্ধুকে বলেছিল-
‘তোর বৌকে বলিস
আমার সামনে এলে যেন কাপড়টা নাভির ওপরে পরে
ওকে দেখার পর সারারাত ঘুমাইনি
মনে হচ্ছিলো
ঘুমোলেই পাপ হয়ে যাবে
আটকাতে পারবো না
বিশ্বাস কর্ আমার মনে হচ্ছিল
সেটা তোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে’
সেই সর্ভানু এখন হিন্দুত্বের তারে
ওর গেঞ্জি জাঙিয়া মায়ের শাড়ি শুকোতে দেয়
এসব কথা আমাকে ব্যক্তিগতভাবে বলেনি
কবিতার মতো লিখেছিল
যেমন গোপীবল্লভপুরের অনিমেষ
আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল-
দেশ কি আমার কবিতা ছাপবে?
আমি ওকে বলতে পারিনি
অমন সুবোধ সুবোধ কবিদের সামনে
তোর সুবর্ণরেখা
যে নাভির নিচে কাপড় পরে
তাকে যেতে বারণ করিস
ওরা শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত লাল শালুতে মুড়ে
ব্যাঙ্কের ভল্টে ভরে রেখেছে
বরং বার্ণিক প্রকাশনার মধুকে পাঠা
ফেসবুকে যে সমুদ্রে মধুযাপনের ছবি দিয়েছে
আর লিখেছে – ‘কোনও সিরিজ লেখার কথা ছিল না’
তার নিচে লিখে দে
‘ছবি তোলার জন্য যার হাতে ফোন দিয়েছিলে
তার নাম উৎপল
ই-মেল চেক করো
রবিনশন ক্রুশোর সঙ্গে ওনার কথোপকথন
তিনভাগে লিখে পাঠিয়েছি
সেখানে লিলিপুটের দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার
রাস্তা বলা আছে’
সুকান্ত দে : বর্ধমানের বিশিষ্ট কবি সুকান্ত দে।লিটিল ম্যাগাজিনের সংগঠক।
