হে ক্ষণিকের অতিথি

ড. রমজান আলি :- অতিথির আসাতে কোন পূর্ব প্রস্তুতি থাকে না। আমাদের অন্তরে কতোনা অতিথির আগমন ঘটে নিত্য। তবে তার আগমনের জন্য একটা প্রতীক্ষা, না থাকলে, এই এসে চলে যাওয়াটা এত বেদনাপূর্ণ হত না। কিন্তু ক্ষণিক বা ঝরা শেফালির মতাে চলে যাওয়াটা কি শেষ পর্যন্ত দানা বাঁধতে পেরেছে , রবীন্দ্রনাথের গানে ? যদি তাই
হতাে তা হলে ‘মিলন ছলে বিরহ আনাে’ কথাটা আসতাে না। কিন্তু তার আসাটা প্রভাতে কেন ? হয়তাে গীতিকাব্যের প্রভাতকালে বলেই
তিনি প্রভাত শব্দটা প্রয়ােগ করেছেন। আবার নির্দ্বন্দ্ব জীবন থেকে দ্বান্দ্বিকতায় যাওয়া বলে এই দ্বন্দ্বহীন জীবনকে প্রভাত বলে ইঙ্গিত দিতে পারেন।
সংস্কৃত শব্দ ‘শেফালিকা’ বা শিউলিকে আমরা তদ্ভব রূপে শিউলি বলি। প্রেমিকার রূপ সংস্কৃতিতে ধোয়ামােছা বলেই শেফালি শব্দটা আরও উজ্জ্বলতা পেয়েছে। শেফালির ফুলের মধ্যে একটা স্বপ্নভঙ্গ কাজ করে। সকালে ফুটবে এই আনন্দে, কুঁড়ি অবস্থায় সে সারারাত স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সকালে ফোটার পর তাকে ঝরে পড়তে হয়। তাই হয়তো সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর উপন্যাসে নায়িকার নাম রেখেছিলেন শবনম শিউলি। নায়িকা কি তেমন করেই ঝরে পড়ছে ? না নায়িকার প্রেম ঝরে পড়ছে ? তা নিয়ে প্রথম প্রথম দ্বিধায় হৃদয় থর থর করে কেঁপে ওঠে। প্রাচীন ধ্রুপদের মতাে আবার উচ্চারিত হল ‘হে ক্ষণিকের অতিথি’ — জোর দেওয়া হল তিনটি শব্দেই। হে’ যিনি শ্রদ্ধেয়, অন্তরের গভীর ভালােবাসা থেকে এই শ্রদ্ধা উঠে আসে। না হলে কখনােই বলা যেতাে না ‘চরণ ধরিতে দিয়াে গাে আমারে নিও না , নিও না সরায়ে। আর ক্ষণিকের বলেই তো এত বিরহ বেদনা। প্রেম বিবাহে রূপ পেলে এই বেদনাটা থাকে না।
বিষাদ তাে মাঝে মাধ্যেই আমাদের গ্রাস করে , না করলে আর পাঁচজন মানুষের সঙ্গে কবির কোন পার্থক্য থাকতাে না। আর কবির নিজের বিষাদে যখন অন্যের বিষাদ অনুভূত হয় তখন আর উপমা খুঁজে পাওয়া যায় না। বিস্ময় নয়, অতিথিকে উদ্দেশ্য করে একটা চাপা জিজ্ঞাসা কাজ করে "কার বিষাদের শিশিরনীরে এলে নাহিয়া " তার আশ্রয়টা ভারি সুন্দর – শিশিরনীরে। আর কারো কাছ থেকে সে কি বিষাদ বহন করে নিয়ে এসেছে ? তাই
বিষাদের শিশির বিন্দু গায়ে মেখে শেফালির ঝরে পরা। যদি শেফালির স্বপ্নের মৃত্যুই ঘটে, তবে সে কি মােহনীয় ব্যাপার। কিন্তু তা তাে, নয়, আশা জাগিয়ে প্রাপ্তিযােগের নির্দেশ দিয়ে তাই বলা হয়েছে – ‘এলে নাহিয়া’। কিসে বা কার জলে স্নান করে এলো ? মানব জীবনের বিশাল অবশ্যম্ভাবী বলেই, বিষাদের শিশির জলে স্নাত নায়িকার আর এক রূপ।
রবীন্দ্রনাথের নিজের এই রূপ, কি তাঁর সঙ্গী-সাথীরা কেউ কখনাে দেখেন নি ?
ওগাে নিষ্ঠুর নয়, ওগাে অকরুণ। করুণ শব্দের এমন বিপরীত মেরু ভাবনা সেই মানুষটার পক্ষেই সম্ভব যার সত্যি সত্যিই এমন
অভিজ্ঞতা আছে। এর পরই চরম পরিণতি বা ক্লাইমেক্স – মিলন ছলে বিরহ আনাে’। এই প্রয়ােগটা কবির নিজের জন্য আর আপনার আমার জন্য,
সম্পূর্ণরূপেই আমার জন্য। কবি হৃদয়ের সঙ্গে পাঠক হৃদয়ের মিলন ঘটে গেল – সাধারণ মানুষের রাজ্য থেকে হাজার হাজার ফুট উচ্চতায়। সেই স্বর্গীয় স্থানটা শুধু আলোকময়। সেই মিলন-বিরহের রাজ্যে পৌঁছানাের ক্ষমতা কজনেরই বা আছে ? তাই মায়া — কী মায়া জানাে। এই মায়া শব্দের অনেক
অর্থের মধ্যে লুকিয়ে আছে অঘটনঘটনপটীয়সী শক্তি। আর এই স্তরে উঠেই বলা যায় — ‘চলেছ পথিক আলােকযানে’। পরক্ষণেই আঁধার
পানে কেন ? আসলে মহাকাশের এ এক ব্লাকহােল। যা প্রেমিক সত্তার সমস্ত ভাবনা-চিন্তা, সময়-ক্ষণকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আর প্রেমিক তার
সবকিছুকে ব্লাকহােলের দিকে ঠেলে দেওয়ার আনন্দে মাতােয়ারা। তাই তাে মন ভুলানাে, আর সেই ডাক মােহনতান, অন্তরের অন্তস্থলের
ডাক। রবীন্দ্র-গানে যার বহিঃপ্রকাশ ঘটছে।
ঝড় আসে ঝড় থেমে যায়। কিন্তু মানবমনের অভিসার চলতেই থাকে। ইন্দ্রিয়াতীত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে অন্তরে অনুভব করে।
কবিপ্রাণ, একটা বক্তব্যের অভিমুখ ঠিক করে নিচ্ছে। যেখানে মৃত্যু বিচ্ছেদ নেই, আছে কেবল পরাণপ্রিয়ের জন্য বিরহ আকুলতা, প্রতীক্ষা
আর মিলনপ্রত্যাশা। একটা আকাঙক্ষাই ভালােবাসার রূপ পরস্পরকে পরস্পরের দিকে তীব্র আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণই শেষ পর্যন্ত দেহ
আর মনকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে।
পথে যেতে নদীর ধারে বাঁদিকে নৌকায় ঠোক্কর খাওয়া একটা বড় গাছকে সাক্ষী রেখে সে যখন নদীর ওপারে চলে যাচ্ছে, ছুপ ছুপ আওয়াজ ক্রমশ ক্ষীণ হচ্ছে , তখন এপারে তৃষ্ণার্ত এক হৃদয়ের আকুলি-বিকুলি। সম্মুখের দিগন্ত বিস্তারি প্রকৃতির উন্মুক্ত ক্ষেত্র যখন
ঘােরতর বৃষ্টি ধারায় স্নাত, যখন বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে নদীর জলের উপর, যখন তৃষ্ণার্ত মাটির বুক থেকে সোঁদা গন্ধ উঠে আসছে, ঠিক
তখনই বিরহীরূপে কবি-হৃদয় আর পাঠক-হৃদয় হতাশ-সম আকাশের মতাে কাঁদছে। এই পরিবেশে একাকী হৃদয়ে একটা চিরন্তন বিরহীভাষ্য উচ্চারিত হয় – ‘দুয়ার খুলে হে প্রিয়তম, চাই যে বার’- কোন একজনের জন্য চিরজীবনের প্রতীক্ষা । প্রশ্ন হয় মিলনের জন্য সে কি আসবে না ? কেউ কি আসে না ? হৃদয়ের অস্তিত্বের সঙ্গে যে মানুষটা এমনি করে জড়িয়ে থাকে তাকেই তাে ‘পরানসখা বন্ধু বলা হয়। যার জন্য সারারাত জেগে
থাকা স্বাভাবিক – চোখে কালাে শিরার অসুখও অস্বাভাবিক নয়। তাই তাই আর্ত কন্ঠে ব্যক্ত হয় – ‘নাই যে ঘুম নয়নে মম’। যার জন্যই এত উৎকণ্ঠা, এত উদ্বেগ, এত ঔৎসুক্য –
সুদূর কোন নদীর পারে/
গহন কোন বনের ধারে/
গভীর কোন অন্ধকারে হতেছ তুমি পার।