ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা ও ফ্যাসিবাদ—ক্যুয়ো ভাদিস!পর্ব-দুই

অশোক মুখোপাধ্যায়
ভারতে বহুকাল ধরেই ধর্ম এক রকমের বারুদ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতা দখল করার পর সে সারা দেশে এক দলীয় শাসন চাপিয়ে আরএসএস বয়ানে লোকে হাসবে কাঁদবে জামাপ্যান্ট পরবে গান গাইবে আর হিন্দুধর্মের নামে গর্বিত হতে গিয়ে মুসলমান খ্রিস্টান বিরোধী ঘৃণার চাষ করবে—এরকম একটা অসহিষ্ণু হিংস্র পরিবেশ গড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধর্মীয় ঘৃণার এই বাতাবরণের আড়ালে চলছে দেশি বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে দেশের জল জঙ্গল জমি পাহাড় খনি বিনি পয়সায় তুলে দেবার নোংরা প্রকল্প আর তার জন্য স্থানীয় গরিব মানুষকে উচ্ছেদ। এই ব্যাপারে দুচার কথা বলা এখন চিন্তাশীল শুভমনস্ক মানুষের জরুরি কাজ। তারই অংশ হিসাবে এই প্রতিবেদনের আজ দ্বিতীয় পর্ব।
ধর্ম সঙ্কট কেন?
ঠিকই। এখানে এই প্রশ্ন দুটো ওঠাও খুব স্বাভাবিক। ধর্মই বা সত্তা-সঙ্কটে পড়ল কেন? আর যারা এর হিংসাত্মক কার্যকলাপে পেছন থেকে মদত দিচ্ছে, তারাই বা তা দিচ্ছে কেন?
আসুন, একটা একটা করে উত্তর খুঁজি।
প্রথমে ধর্ম থেকে শুরু করি।
ধর্ম সঙ্কটে পড়েছে জ্ঞানের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার দরুন। মধ্য যুগ পর্যন্ত সারা পৃথিবীতেই একটা সময় ছিল যখন ধর্মতন্ত্রই মানুষ ও সমাজের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ এবং নির্ধারণ করত। জ্ঞান বিজ্ঞান ইতিহাস নীতি-নৈতিকতা শিল্পচর্চা নান্দনিকতা ইত্যাদি। মান্যবর ধর্মতাত্ত্বিকরা বিভিন্ন বিষয়ের উপর যে টীকা টিপ্পণী লিখে রাখতেন, তাতে এই সমস্ত জিনিসের ব্যাপারে দিক নির্দেশ থাকত। সূর্য ঘোরে কিনা, চাঁদ জ্বলে কিনা, শনি ঘাগড়া পরেছে কিনা—সব ওনারাই জানিয়ে দিতেন। তার বাইরে অন্য কিছু জানার বা বলার জো ছিল না। সচরাচর কেউ এই সব কথায় সন্দেহ করত না। চুপচাপ মেনে নিত। সরল বিশ্বাসে। তাতে অসুবিধা খুব একটা হত না। তবে, কোনো কারণে কেউ অন্য রকম মত জানালে বা এই সব নির্দেশে এতটুকু সন্দেহ ব্যক্ত করলে তার জীবনকে সত্যিই নরক বানিয়ে দেওয়া হত। তাই চাইলেও, বা, ভিন্ন কিছু জানলেও, ভয়ে কেউ কিছু বলত না।
আর মধ্যযুগের শেষ দিকে এসে যাঁরা অন্য কথা বলতে চেষ্টা করেছিলেন—এই যেমন, রজার বেকন, মিগুয়েল সার্ভেতো, জিওরদনো ব্রুনো, তোমাসো ক্যাম্পানেল্লা, গ্যালিলেও গ্যালিলেই, প্রমুখ—তাঁদের রোমান চার্চ কী হাল করে ছেড়েছিল, এখন সকলেই জানেন। সেই পুরনো কাসুন্দি আর ঘাঁটছি না।
কিন্তু ইতিমধ্যে কয়েকটা সমস্যা হয়ে গেল। একদিকে এত সব কাণ্ড করেও বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে রোখা গেল না। নতুন জ্ঞাত তথ্যগুলো, জ্ঞানের নতুন কুসুমগুলো প্রথমে ইউরোপে কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ল। তারপর তার বাইরে তিন মহাদেশ পাঁচ মহাসাগর পেরিয়ে দিকে দিকে। বাইবেলে যে অনেক ভুল খবর আছে, চার্চের কর্তারা যে অনেক ভুল সিদ্ধান্তকে এতকাল ধরে মদত দিয়ে এসেছেন, তা আর চাপা রইল না। শোনা যায়, ১৬৩৩ সালে গ্যালিলেও নাকি পোপের নিযুক্ত মূর্খ বিচারকদের প্রদত্ত আজীবন জ্ঞানচর্চা বর্জিত গৃহবন্দিত্বের আদেশ শোনার পরে অস্ফূট স্বরে বলেছিলেন, eppur sie mouve, অর্থাৎ, এর পরও সে ঘুরছে, সেটাই শেষ অবধি সত্য হয়ে দাঁড়াল। সূর্যের চারদিকে পৃথিবী ঘুরতেই লাগল। অন্য গ্রহগুলোও পৃথিবী নয়, সূর্যকেই প্রদক্ষিণ করাটা বেশি পছন্দ করে চলল। চার্চ, বাইবেল, ঈশ্বরের ফতোয়ার তিল মাত্র তোয়াক্কা না করেই!
শুধু কি তাই? আইজ্যাক নিউটন নামে এক খ্রিস্ট ভক্ত বিজ্ঞানী জটিল জটিল সব আঁক কষে বের করলেন সেই ঘোরার ভেতরকার রহস্য এবং নিয়ম। এডমন্ড হ্যালি আবার সেই সব সূত্র প্রয়োগ করে দেখিয়ে দিলেন, একটা ধূমকেতু ৭৫ বা ৭৬ বছর বছর বাদে বাদে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর আকাশে দেখা দেবে; আর হ্যালি মারা যাওয়ার কিছু দিন পর সে সত্যিই এসে হাজির হল। এবং তারপর আরও বেশ কয়েক বার রোমান গির্জা, পোপ সকল এবং আমাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে সে ঝাঁটা নাচিয়ে ঘুরে গেছে। বিজ্ঞান আশ্রয় এবং প্রশ্রয় না দিলে এতটা বেয়াদপি সে দেখায় কী করে?
কোপারনিকাস থেকে শুরু করে নিউটন পর্যন্ত মাত্র এক-দেড়শ বছরেই এত কিছু নতুন জিনিস জানা হয়ে গেল যে সবাই বলতে লাগল, ইউরোপে এত কাল ছিল এক অন্ধকার যুগ। রেনেশাঁস এসে সেই অন্ধকার দূর করেছে। ইংল্যান্ডের এক কবি আবার বললেন, সব কিছু এত কাল গভীর অন্ধকারে ঢাকা ছিল, ভগবান নিউটনকে পাঠিয়ে দিলেন, তবেই তো চারদিকে আলো ঝলমল করে উঠল। তার মানে ধর্মের একচ্ছত্র দাপটের সময়কালকেই তো লোকে দুষছে অন্ধকার যুগ বলে। খ্রিস্টধর্ম এইভাবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে পড়তে লাগল জ্ঞানের জগতে আঁধার সৃষ্টিকারী শক্তি হিসাবে। হায় হায়!!
হ্যাঁ, আপনি ঠিকই লক্ষ করেছেন, এই জন্য আজকাল একদল ধর্ম প্রেমিক বিজ্ঞানের ইতিহাস বিশ্লেষক দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন, না, না, তোমরা যতটা অন্ধকার বলছ, সেই সময় অতটা গাঢ় তমসা ছিল না। তখনও লোকে জ্ঞান চর্চা করতে পেরেছে। মধ্যযুগেও তো হাওয়া কল, জল সেচন কল, ইত্যাদি উদ্ভাবন হয়েছে, গণিতে কিছু কিছু কাজ হয়েছে, বীজগণিত এবং ত্রিকোণমিতি জন্ম লাভ করেছে, সাহিত্য ও সঙ্গীত রচিত হয়েছে, ইত্যাদি। ইউরোপের কয়েকটা প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থাপিত হয়েছিল খ্রিস্টধর্মের প্রচারকদের উদ্যোগেই। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, পারি, ইত্যাদি। সমস্ত সময়টা তাহলে আর আঁধার ঘেরা হয় কী করে?
কী বলছেন, মশাই? আপনিও এই কথাটা নিয়ে চিন্তিত? আমি বলছি শুনুন, এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। সেকালে যেটুকু জ্ঞানের আলোর উদ্ভাস দেখতে পাচ্ছেন, এ হচ্ছে মানব সভ্যতার স্বাভাবিক গুণ। মানুষের শ্রম মেধা বুদ্ধি ও বুদ্ধিজাত সংস্কৃতির ফল। মানুষ স্যাপিয়েন্স হওয়ার আগে থেকেই, পুরনো প্রস্তর যুগ থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে যৌথ সংগ্রামে এরকম—হয়ত নিবু নিবু—আলো হাতেই একটু একটু করে এগিয়েছে। মধ্য যুগেও, ধর্মের যাঁতাকলে মানুষের বোধ বুদ্ধিকে পিষ্ট করে রাখার সর্বপ্রযত্ন প্রয়াস সত্ত্বেও, সমস্ত কিছু আর চেপে রাখা সম্ভব হয়নি। সত্যটা বুঝতে হলে আপনাকে দেখতে হবে, কতটুকু ক্ষেত্রে কিছু বিকাশ হয়েছিল, আর কতটা চেপে রাখা হয়েছিল। গ্রিকদের সমগ্র জ্ঞানভাণ্ডার হারিয়ে গেল কেন? আরবদের থেকে অনুবাদে ফেরত না পেলে তো সমস্তই বিলুপ্ত হয়ে যেত। নতুন জ্ঞানের আলো ফোটার সময় তাকে চার্চ এত বাধা দিয়েছিল কেন? আলোর পূজারীরা অন্ধকারকেই ধরে রাখতে চাইবে কেন? ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারল কেন? গ্যালিলেওকে অসম্মানিত করে তাঁর বিজ্ঞানচর্চাকে আটকাতে গিয়েছিল কেন? সত্যিকারের আলোর পূজারীরা কি কখনও আলোর দিশারীদের বিরোধিতা করতে পারে?
অর্থাৎ, ধর্মের প্রথম সঙ্কট হল এই যে সে আর নিশ্চিন্ত মনে অজ্ঞতা অন্ধতা কট্টরতা রূপী অন্ধকারের উপাসনা করে যেতে পারল না। এদিক থেকে ওদিকে এর হাতে ওর হাতে জ্ঞানের প্রদীপ একটা একটা করে জ্বলে উঠতে শুরু করল। আর তারপর সেগুলোর কোনো কোনোটা মশাল হয়ে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। ঈশ্বর বাইবেল যিশু—কে কোথায় থাকবে, কতটা থাকবে, সব অনিশ্চিত হয়ে গেল। তারা আর জ্ঞানের প্রতীক বা আধার বা স্তম্ভ নয়, কষ্টিপাথর নয়, বরং তারাও এখন থেকে যুক্তি তথ্য সাপেক্ষ সমাজতাত্ত্বিক ঐতিহাসিক বিচার বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে পড়ল।
ধর্মের আর এক সমস্যা হল, সমাজে তার খুঁটিগুলি বড্ড আলগা হয়ে গেছে। সহস্রাধিক বছর ধরে তার পৃষ্ঠপোষক ছিল সামন্তবাদী শাসকরা। সারা পৃথিবী জুড়েই রাজা জমিদার ব্যারন বাদশাহরা ছিল ধর্মের ধারক ও বাহক। রাজা বাদশাহরা ছিল ঈশ্বরের পার্থিব প্রতিনিধি। আর ঈশ্বর ছিল রাজা বাদশাহদের স্বর্গীয় প্রবর্ধন! দুইয়ে মিলে দু-পক্ষেরই ভারি সুবিধা ছিল। দেশের রাজাকে দেখে লোকে ভাবত, এই দুনিয়ারও একজন রাজা আছে। কত রকম তার নাম = ঈশ্বর, ভগবান, আল্লাহ্, গড, ইয়াহবে, . . .। আর ঈশ্বরের পক্ষে এত বড় দুনিয়াকে চালানো কি মুখের কথা! তাই স্থানীয় পাইক হিসাবে পাইকারি হিসাবে এখানে ওখানে রাজাকে বসিয়ে রাখা হত! আর এই দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়ার ফলে ধর্মকে আর খাওয়াপরার সমস্যা নিয়ে ভাবতে হত না। দান ধ্যান বেতন ভাতা পুরস্কার ইত্যাদির সাহায্যে মন্দির মসজিদ গির্জার যাবতীয় খরচ উঠে আসত। ইউরোপে চার্চের প্রধানরাই রাজার শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করত। মধ্য প্রাচ্যে রাজাই একাধারে ধর্মীয় ও পার্থিব শাসন কর্তা। খলিফা।
যখন থেকে সমাজে বদল ঘটে গেল, সামন্ততন্ত্র বহু দেশেই উৎখাত হয়ে গিয়ে ধনতন্ত্রের বিকাশ ঘটল, ধর্মের অন্ধকারের ভূমিকা স্মরণ করে দেশে দেশে সেকুলার বা ধর্মনিস্পৃহ সমাজ ও রাষ্ট্রের কথা উঠে এল, রাষ্ট্রীয় সমস্ত কার্যকলাপকে ধর্ম থেকে মুক্ত করা প্রশ্ন এসে গেল, ধর্মীয় কাঠামোর পায়ের তলার মাটি টলমল করে উঠল। সরকারি কাজেকম্মে নাক গলাবে না, এই শর্তে ইংল্যান্ডের নবোত্থিত বুর্জোয়া রাষ্ট্র তবু চার্চকে বেতন ভাতা দিয়ে পুষবে বলে কথা দিয়েছিল এবং এখনও সেই কথা সে মেনে চলেছে। ফ্রান্স এমন এক কাণ্ড করে বসল যে ধর্ম আজও সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ফরাসি বিপ্লবে শ্লোগান উঠল, আমাদের ধর্ম কম্ম অনেক হয়েছে, আর চাই না, এবার চার্চগুলিকে উঠিয়ে দাও; ওরা দেশের প্রচুর জমিজমা দখল করে রেখেছে, ওগুলো আমাদের জনগণের স্বার্থে ভালো কাজে লাগাতে হবে। কত যে গির্জা দখল হয়ে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বনে গেল, কতগুলো গির্জায় যে আর্ট মিউজিয়াম বসে গেল—তার ইয়ত্তা নেই।
পরবর্তীকালে অবশ্য অন্যান্য দেশের বুর্জোয়ারা শাসন ক্ষমতায় আসীন হয়ে বুঝেছে, ফ্রান্সের মাটিতে বড্ড বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। ধর্ম জিনিসটা অত খারাপ নয়। একটু সামলে সুমলে রাখতে পারলে ভারি সুন্দর কাজে দেয়! ঈশ্বর বা স্বর্গের নামে শোষণ নির্যাতনকে অনেকাংশে ভুলিয়ে দিতে পারে। একটা আফিম আফিম ভাব আছে। শুধু তেজি ঘোড়ার মতো বেঁধে রেখেই সাবধানে খেলাতে হবে।
এইখানে পাদদেশে না নেমেও একটা পাদটীকা দিয়ে রাখি। ঈশ্বরে বিশ্বাস একটা শক্তিশালী আবেগ, যার বলে আপনি কোন মন্দির মসজিদ গির্জার নাম একবার শুনলেই সে আপনার পকেটে কিংবা হাতব্যাগে হাত ঢুকিয়ে দেবে, টাকাপয়সা বের করে আনবে এবং সামনে রাখা দান-বাক্সের মধ্যে ফেলে দিতে উদ্বুদ্ধ করবে। আর সেই প্রক্রিয়ায় তখন এত টাকা জমে ওঠে যে সেই সেই ভগবানের আধ্যাত্মিক সর্বশক্তির উপর আর ভরসা না করে মনুষ্য নির্মিত তুচ্ছ পার্থিব তালাচাবিকে ডেকে আনতে হয় তাকে রক্ষা করার জন্য।
এ এক ভয়ানক সমস্যা। সমাজের উপর খবরদারি শুধু যে করা যাচ্ছে না তাই নয়, সমাজ এবং রাষ্ট্রের খবরদারি মেনে চলতে হচ্ছে। একেবারে নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার চাইতে এ নিশ্চয় ভালো। কিন্তু এত কাল যে নিজে অন্যদের উপর খবরদারি করে এসেছে, তার পক্ষে অন্যের অভিভাবকত্ব মেনে চলা খুবই অস্বস্তিকর! আর জনসাধারনের একটা অংশের মধ্যে, শিক্ষিত সচেতন যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনস্ক মানুষদের মধ্যে ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার বা ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বরূপ উন্মোচন ক্রমশই শক্তিশালী হচ্ছে। সারা পৃথিবীতেই ধর্মে আস্থাহীন বা নাস্তিকদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। মন্দির মসজিদ গির্জায় যাতায়াতকারী লোকসংখ্যা (কোথাও পরম অঙ্কে, বেশির ভাগ জায়গায় আনুপাতিক হারে) লাগাতার কমে যাচ্ছে। ধর্ম নিয়ে রসিকতা এবং কার্টুন এখন পৃথিবীর অন্যতম উচ্চফলনশীল রসসাহিত্য। টিকি তিলক টুপি দাড়ি—এখন সাধারণ লোকের মনে যতটা সম্ভ্রম জাগায়, তার চেয়ে ঠোঁটে অনেক বেশি হাসির উদ্রেক করে! আপনিও এটা লক্ষ করেছেন, তাই না? তার মানে সঙ্কট কোথায় নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন!
আরও এক জ্বালা এই যে এক কালে ধর্ম যাকে আটকাতে গিয়েছিল, আজ প্রতি পদক্ষেপে তার কাছে হাত পেতে বহু জিনিস নিতে হচ্ছে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি। ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট গরু বা ঘোড়ার গাড়ির বদলে বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট রেলগাড়িতে এখন ঠাকুর মশাই, বড় ইমাম সাহেব কিংবা স্বয়ং পোপ মহাজনকেও চেপে ঘুরতে হয়। ধর্ম মানুষকে কী দিতে পারে তা এত দিনে জানা হয়ে গেছে। বিপদে আপদে সান্ত্বনা বা স্তোক বাক্য শোনানো ছাড়া তার পক্ষে আর কিছু যে দেওয়া সম্ভব নয়, তা সকলেই জানে। সকলেই মানে কিনা অবশ্য বলা মুশকিল। তা মানুক চাই না মানুক, অসুখ বিসুখ হলে পবিত্র জর্ডন নদীর জলের ঝাপটা, কিংবা জমজমের পানির ছিটে, অথবা মা গঙ্গার জলের স্পর্শ কতটা কী করতে পারে আপনিও জানেন, আমিও জানি। বিষধর সাপে মন প্রাণ ঢেলে কামড় দিলে মা মনসার সামনে হত্যে দিয়ে পড়েই থাকুন, আর মাজারের ফুলের রেণুই ছড়িয়ে দিন, ফলাফল কাউকেই বলে দিতে হবে না। বিজ্ঞান এই সব জায়গায় ম্যাজিকের মতো কাজ করে থাকে। বসন্ত কলেরা ম্যালেরিয়া—এক কালে কত গ্রাম কে গ্রাম উজার করে দিত। একশ বছর আগেকার গল্প উপন্যাসে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ ছড়িয়ে আছে। আজ সেই সব ঘটনা ইশপ বা পঞ্চতন্ত্রের গল্প বলে মনে হয়। বিজ্ঞান রোজ রোজ এত রকমের খেল দেখাচ্ছে যে আজকাল পাণ্ডা পুরুত ইমাম পাদ্রিকেও সেই সব খেলা দেখতে এবং দেখাতে হচ্ছে। অলৌকিক অপ্রাকৃতিক অতিপ্রাকৃতিক যত রকমের ঘটনার কথা জানা যেত—ভূত, দত্যি দানো, রাক্ষস, জ্বিন, পরী, ফেরেস্তা, দেবদূতদের আনাগোনা—সকলেই এখন বিজ্ঞানের তাড়া খেয়ে খেয়ে লোকালয়ের বাইরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। যে ধার্মিক ভূত বা অপদেবতার ভরে বিশ্বাস করে, সেও তার নিজের মেয়ের উপর কেউ ভর করেছে জানলে মনোচিকিৎসকের কাছেই আগে দৌড়য়। যে সত্যিই বিশ্বাস করে, রামকৃষ্ণের ভাব সমাধি হত, সেও নিজের ছেলের ওরকম সমাধিভাব দেখলে স্নায়ুচিকিৎসকের কাছে গিয়ে এপিলেপসির নিদান চায়!
বিজ্ঞানের কাছে প্রতি পদক্ষেপে এই পরাজয় আর মেনে নেওয়া যাচ্ছে না! বাইবেল থেকে শুরু করে সমস্ত ধর্মগ্রন্থে কত সুন্দর করে সাজানো ছিল এই বিশ্ব সংসার। সেই পৃথিবীকে মহাবিশ্বের কেন্দ্র থেকে হঠিয়ে দিল বিজ্ঞান! মানুষ ছিল ভগবানের শ্রেষ্ঠ কীর্তি। বিজ্ঞান এসে বলে দিল, সেও নাকি বানর গরিলা শিম্পাঞ্জির মতো প্রাণীদের মতোই কোনো এক প্রাচীন পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের পথে ধাপে ধাপে আবির্ভূত হয়েছে। অন্য সব কিছু বাদ দিলেও বস্তুজগত সৃষ্টির দায়িত্ব থেকে ঈশ্বরকে সরানো যাবে না বলেই ভেবেছিলেন ওনারা। ও হরি, বিজ্ঞান দেখিয়ে দিয়েছে, বস্তুজগত সৃষ্টির কোনো প্রশ্নই ওঠে না। সে নিজেই অনাদি অনন্ত দেশে কালে বিদ্যমান। এবং তার সমস্ত অংশই গতিময়, পরিবর্তনশীল।
উঃ, গতিকেই শেষ অবধি আঁকড়ে ধরেছিলেন তাঁরা। এই স্থাণু বিশ্বের সমগ্র বস্তুনিচয় গতি পেল কোত্থেকে? বল, বল! তোমাদের বিজ্ঞানেই তো বলেছে, স্থির বস্তু তো আর কোনো বাহ্যিক বলের ধাক্কা ছাড়া গতিশীল হতে পারে না। তাহলে এই স্থির বিশ্ব গতিশীল হওয়ার মতো উপযুক্ত ধাক্কা পেল কার কাছ থেকে? প্রশ্নটা এক কালে খুবই জটিল প্রশ্ন ছিল। নিউটনের মতো পণ্ডিত মানুষও এই প্রশ্নের সামনে পড়ে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। কোনো সমাধান পাননি। আরিস্ততল যে সমাধান দিয়েছিলেন সেটাও তাঁর পছন্দ হয়নি। ভগবান রোজই একবার করে গ্রহ নক্ষত্রগুলোকে ধাক্কা দেন। আর তারা চলতে থাকে। নিউটনের গতিসূত্রের সঙ্গে এই দৈনন্দিন ধাক্কার তত্ত্বকে মেলান যায় না। সেই জন্য তিনি শেষ অবধি বলেছিলেন, ঈশ্বরই বিশ্ব সৃষ্টির গোড়াতে এক রাম ধাক্কা দিয়ে ফেলেছিলেন। তারই ঠেলায় দুনিয়ার সমস্ত কিছুই নিত্য চলমান। যে যার নিয়ম মেনে নিজ নিজ কক্ষ পথে।
ফ্রান্সের অষ্টাদশ শতাব্দের বস্তুবাদীরা অবশ্য বিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই এই তত্ত্বকে খারিজ করে দিয়েছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, গতি বস্তুরই নিহিত স্বধর্ম। তা আবার বাইরে থেকে যোগান দিতে হবে কেন? তা এমনিতেই বস্তুর মধ্যে নিজে থেকেই গোড়া থেকেই আছে। অতএব ভগবানের এই ব্যাপারে গোড়ায়ও কিছু করার ছিল না, রোজ রোজও কিচ্ছুটি করার নেই! যাচ্চলে। শেষ পর্যন্ত গতিও হাতছাড়া হয়ে গেল ঈশ্বরের।
হ্যাঁ, সেও ঠিক। উনিশ শতক থেকে বিজ্ঞান যত এগোতে লাগল, ততই বস্তুর নতুন নতুন গতির খবর আসতে লাগল। গ্যাসীয় পদার্থে, জলীয় দ্রবণে অণুগুলি সদাই চঞ্চল। কঠিন পদার্থেও অণুগুলি স্পন্দমান। আকাশের যত দূরেই তাকাই, দেখি কেউ থেমে নেই। পরমাণুর ভেতরে তাকানো শুরু হল বিশ শতকের গোড়ায়। সেখানেও ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, গ্লুওন, কোয়ার্ক—কারোরই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার খবর পাওয়া যাচ্ছে না! তাহলে এই বিশ্ব সংসারে স্থির ছিল কে, যাকে শ্রীশ্রীভগবান রাম ধাক্কা দিয়ে চালু করে দিয়েছিল? ফলে শুধু দর্শন নয়, বিজ্ঞানও জানিয়ে দিল, বস্তু জগত সৃষ্টির মতোই গতি সৃষ্টির জন্যও কোনো ঈশ্বর জাতীয় কাউকে আর লাগছে না! এক কথায় বলতে গেলে, ভগবানজির শেষ আশ্রয় স্থলটুকুও ধর্মীয় বিশ্বাসের আওতার বাইরে চলে গেছে!
তারপর থেকেই মন্দিরে মসজিদে মাইকের তারস্বরে চিৎকার বেড়ে গেছে। ভগবান রেগে নিয়ে সেই যে স্বর্গোদ্যানের চিলেকোঠায় দরজা বন্ধ করে মুখ লুকিয়ে বসে আছে, ভক্তরা দেখছে, ডাকলে সে কিছুতেই সাড়া দিচ্ছে না, হয়ত বিশ্বাসীদের আর্তনাদ শুনতেও পাচ্ছে না। আর ভক্তরা ভাবছে, জোরে জোরে মাইক বাজিয়ে মন্ত্র পড়লে বা আজানের আওয়াজ দিলে যদি ঈশ্বর বা আল্লাহ্ শুনতে পায়!
পাচ্ছে কি? মনে তো হয় না।
কী ভয়ানক এই ত্রি-সঙ্কট! এর হাত থেকে আজ আর বিশ্বের কোনো ধর্মেরই পরিত্রাণ নেই। তাদের বেঁচে থাকার এখন একমাত্র উপায় মৃত্যুর দিনক্ষণকে কোনো রকমে আরও কিছু দিন পিছিয়ে দেওয়া। তার জন্য প্রয়োজনে যারা যুক্তি তথ্যের ভিত্তিতে সত্যের পতাকা হাতে এগিয়ে চলেছে, তাদের হাতের মশাল কেড়ে নিয়ে সেই অভিযান মাঝপথে বা পথের এক একটা মোড়ে থামিয়ে দেওয়া।
অশোক মুখোপাধ্যায়: মার্ক্সীয় প্রাবন্ধিক, মানবাধিকার কর্মী ও সাধারণ সম্পাদক, সেস্টাস।
ReplyForward |