• March 26, 2023

অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও মুর্শিদাবাদ

 অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও মুর্শিদাবাদ

নুরজামান শাহ 
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে স্যার উইলিয়াম কেরির উদ্যোগে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে সারা বাংলায় একাধিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হয়।১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে কেরি সাহেবের নির্দেশে ডাক্তার সাটন মুর্শিদাবাদ এলে, দৌলতাবাদে খ্রিস্টান পাদ্রীরা একটি স্কুল চালু করেন।এর মধ্যে রেভারেন্ড মাকাইয়া হিল শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি খ্রিষ্টধর্ম  প্রচারেও এই জেলাতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। হিল সাহেব যদিও শিক্ষা প্রসারের থেকে খ্রিস্টধর্ম প্রচারেই বেশি ব্যস্ত থাকতেন।তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলির মধ্যে ফরাসডাঙার স্কুলে পর্তুগিজ ভাষা শেখানো হতো এবং এখানে অনেক পোর্তুগিজ ছাত্র পড়াশোনা করত। এই স্কুলের অন্যতম ছাত্র ছিলেন বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি। পুরোনো নথিপত্র ঘেঁটে জানা যায় যে, তখন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির বাল্যকাল কাটে কাশিমবাজারের ফরাসডাঙায়। ফরাসিদের বাসস্থান ছিল কাশিমবাজারের ফরাসডাঙা।ফরাসডাঙার পোর্তুগিজ বংশজাত ছিলেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি।অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির জন্ম অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে বলে জানা যায়।তিনি জন্মসূত্রে ছিলেন খ্রিস্টান ধর্মালম্বী পোর্তুগিজ।তিনি এক হিন্দু বাঙালি রমণীকে বিয়ে করেন।তারজন্য তাকে কলকাতার চিৎপুরে পল্লীর বাসভূমি বিক্রি করতে হয়েছিল।তাঁর খাওয়া-দাওয়া, পোশাক – পরিচ্ছেদ বাঙালি চরিত্রের প্রকাশ পায়।তিনি বাংলা ভাষায় চমৎকার সব ছড়া ও গান রচনা কর‍তে পার‍তেন।ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে যখ নবজাগরণের বিকাশ ঘটতে শুরু করে তখনকার সমাজ, ধর্মকেন্দ্রিক বিষয়  বিভিন্ন রচনায় গুরুত্ব পেতে শুরু করে। গ্রাম – বাংলার বাঙালি শিক্ষিত – অশিক্ষিত সমাজে কবিগানকে জনপ্রিয় করে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন কবিয়াল সেই সব বিষয়কে কবিগানের মাধ্যমে তুলে ধরেন।মুর্শিদাবাদের কাশিমবাজারের মহারাজা হরিনাথ রায়বাহাদুর ছিলেন কবিগানের তৎকালীন পৃষ্ঠপোষক। কবিগান তিনি এতটাই ভালোবাসতেন যে কাশিমবাজারের আশেপাশের গ্রামের গানের আসর বসলে তিনি উপস্থিত থাকতেন।আবার কবিগানের জন্য বিপুল অর্থও ব্যয় করতেন।কাশিমবাজারের মহারাজকুমার ঐতিহাসিক ও নাট্যকার ড. সোমেশচন্দ্র নন্দী তাঁর লেখা ” হিস্ট্রি অফ দ্য কাশিমবাজার রাজ ” গ্রন্থের প্রথম খন্ডে কবিগান নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেছেন।রাজবাড়িতে যে কবিগানের আয়োজন হয়েছিল সেখানে উপস্থিত কবিয়াল হিসাবে ভোলা ময়রা, হরু ঠাকুর, রাম বসু প্রমুখ সুবিখ্যাত কবিয়ালদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।ড. নন্দী আরও জানান যে, শারদীয়া দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে কাশিমবাজার প্রাসাদের যে উৎসব হতো সেই উৎসবে কবিগানের আসর বসত।রাজা হরিনাথের সময়ে কাশিমবাজার রাজবাড়িতে একবার যে কবিগানের আসর বসেছিল সেখানে কবিয়াল ভোলা ময়রার সঙ্গে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে লড়াই করেছিলেন। কবিয়াল ভোলা ময়রা তাঁকে ফিরিঙ্গি ও খ্রিস্টধর্মের ভক্ত বলে আক্রমণ করেছিলেন।অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি তার জবাবে অসাধারণ কয়েকটি পদ ব্যক্ত করে মন জয় করে নিয়েছিলেন।তিনি বলেছিলেন – খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কিছু ভেদাভেদ নাই রে নাইশুধু নামের ফেরে মানুষ ফেরে এও তো কোথাও শুনি নাই।আমার খোদা যে হিন্দুর হরি সে ওই দ্যাখ শ্যাম দাঁড়িয়ে আছে আমার মানব জনম সফল হবে যদি তার রাঙা চরণ পাই 
তারপরে ভোলা ময়রা তাঁর খাদ্যাভাস নিয়ে কটাক্ষ করে বলেন -পেদরু ফিরিঙ্গি ব্যাটা পেরু কাটাব্যাটা কি সাহেব ফলিয়েছেব্যাটা ছিল ভাল সাহেব ছিলহলো বাঙ্গালীএখন কবির দলে এসে মিলেব্যাটা পেটের কাঙ্গালীজন্ম যেমন যার, কর্ম তেমন তার এ ব্যাটা ভেড়ের বেড়ে নিমক ছেড়ে কবির ব্যাবসা ধরেছেকেউ বা কচ্ছেন ব্যারিস্টারি ;কেউ বা ম্যাজস্টারি এলেম জোরে কেউ বা কচ্ছেন জজগিরিআর এ ব্যাটা পুজোর সময় ভুজোর লোভে নাচতে এসেছে… এর সমুচিত জবাবে অ্যান্টনি সাহেব গাইলেন – জয়ো যোগেন্দ্র জয়ো মহামায়া মহিমা অসীম তোমার একবার দুর্গা দুর্গা বলে যে ডাকে মা তোমায় তুমি করো তার ভবসিন্ধু পার।অ্যান্টনির এই গান শুনে ভোলা ময়রা মুগ্ধ হয়ে রাজা হরিনাথকে বললেন, সাহেব হয়ে কবির পেশা যখন নিয়েছে তখন ঈশ্বরের কৃপা বলেই এটা সম্ভব হয়েছে।অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ভোলা ময়রা ছাড়াও কবিয়াল হোসেন খাঁর সঙ্গে কবিগানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন।হোসেন খাঁ ছিলেন মুর্শিদাবাদের বারোশত বঙ্গাব্দের প্রথম সারির কবিয়াল।তরজা কবিগানে বিশেষ খ্যাতি ছিল।অ্যান্টনি ফিরিঙ্গিকে যখন ব্রাহ্মণ রমণী বিয়ে করার জন্য কলকাতায় চিৎপুরের বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল তখন কাশিমবাজারের রাজা হরিনাথ তাঁকে তাঁর এই উদ্যানবাটি ক্রয় করার জন্য অর্থ সাহায্য করেছিলেন। কলকাতার অ্যান্টনি বাগান আজও রাজা হরিনাথের এই সাহায্যের স্মৃতি বহন করে চলেছে।মুর্শিদাবাদের সঙ্গে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির সম্পর্ক নিঃসন্দেহে অতি মধুর ছিল। সে সময়ের কবিগানের সমৃদ্ধি তাঁরই হাতে হয়েছিল।১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে প্রয়াত হলেও আজও তাঁর কবিগানেত অবদান অনস্বীকার্য। 

প্রন্ধে ব্যবহৃত ছবিটি একটি সিনামের দৃশ্য, এটা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির ছবি নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post