মমতা সরকারের মাদকাসক্তি

চন্দ্রপ্রকাশ সরকার
একদা ব্রিটিশ শাসকরা এদেশে মাদকাসক্তি বাড়িয়ে ‘নেটিভ’ ইন্ডিয়ানদের ‘আধুনিক’ অর্থাৎ মানুষ করে তুলতে চেয়েছিলেন। তার পিছনে তাদের দু’ধরনের অংক ছিল। প্রথমত, যত বেশি মানুষ মদ্যপানে অভ্যস্ত হবেন তত বেশি সরকারের আবগারি আয় তথা রাজস্ব বাড়বে। দ্বিতীয়ত, মানুষের মধ্যে মাদকাসক্তি যত বাড়বে তদনুপাতে ব্রিটিশবিরোধিতার শক্তি কমবে। বস্তুত এই দ্বিতীয় কারণটির কথা মাথায় রেখেই এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিল মদের দোকানের সামনে পিকেটিং। মাদক বর্জনের ডাক দিয়ে দেশব্যাপী এক ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বয়ং। পরিতাপের কথা, স্বাধীনতা লাভের পর সারা দেশেই মদ ও মাদকের প্রসার বহুগুণ বেড়েছে। বেড়েছে পারিবারিক অশান্তি ও সামাজিক অস্থিরতা। ব্রিটিশ আমলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে মাদকদ্রব্যের যে বিরূপ প্রভাব ছিল, বলাবাহুল্য, তা আজও একই রকম ক্রিয়াশীল। অথচ স্বাধীন দেশের রাজ্যে রাজ্যে রংবেরঙের নানা সরকারগুলি মাদককেই সরকারি কোষাগার ভরানোর প্রধানতম উপায় হিসেবে গণ্য করছে।
ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলা ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রধান পীঠস্থান। তারই অংশ হিসেবে আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গ বহু বছর ধরে মাদক বিরোধী সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতা লাভের পর ছয়ের দশক পর্যন্ত বামপন্থী আন্দোলনেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। ফলত বহু বছর ধরে মদ্যপানে পিছিয়ে ছিল এই রাজ্য। এই পিছিয়ে থাকাটাই এই রাজ্যের এগিয়ে থাকাকে সূচিত করেছিল, গর্বিত করেছিল রাজ্যবাসীকে। বড় বেদনা ও লজ্জার কথা, সাতের দশকে ‘বামফ্রন্ট’ সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর রাজ্যবাসীর গর্বকে খর্ব করার অপপ্রয়াস শুরু হয়। সিপিআইএম নেতা বিমান বসুর মতো সজ্জন মানুষও ২০০৩ সালে বিভিন্ন রাজ্যের আবগারি রাজস্ব আদায়ের খতিয়ান তুলে ধরে এই রাজ্যের ওই আয় কত কম তার জন্য কার্যত আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। তারা গ্রামাঞ্চলে ১৮ হাজার এবং শহরাঞ্চলে ১২ হাজার লোক পিছু মদের দোকান খোলার কঠোর সংগ্রাম করেছিলেন। ২০০১ সালে এই রাজ্যে সরকার অনুমোদিত দেশি মদের দোকান ছিল ৮৫৮ টি। ২০০৩ সালে অর্থাৎ মাত্র দু’বছরে তা বেড়ে হয় ১৫৬৬ টি।
২০১১ সালে ‘পরিবর্তন’-এর ডাক দিয়ে রাজ্যের ক্ষমতা দখলের প্রাক্কালে তৃণমূলের নির্বাচনী ইস্তাহারে লেখা হয়েছিল — “কোথায় সেই পাট শিল্প ? চা শিল্প ? ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প ? টেক্সটাইল শিল্পগুলো কোথায় আজ! শিল্পের থেকে আজ শুঁড়িখানা অনেক বেশি। শিল্প মানে কেন শুধু মদের বন্যা! আর বিষমদে মৃত্যুর কান্না! কেন এসব ভাবব না আমরা! কেন বাংলার ছেলেমেয়েরা বাংলাতে কাজ না পেয়ে চলে যাচ্ছে, লক্ষ লক্ষ জন, বাংলার বাইরে! কেউ বা দিল্লিতে, কেউ বা মুম্বইতে, কেউ বা রাজস্থানে, কেউ বা ইউপি বা বিহারে।”
বলাবাহুল্য, তথাকথিত পরিবর্তনের পরেও বহির্মুখী শ্রমিক-স্রোত একটুও কমেনি, বরং আরও বেড়েছে। একইভাবে বেড়েছে মদের স্রোতও। বামফ্রন্টের বিদায়-বর্ষে(২০১০ – ১১) আবগারি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৭৬০ কোটি টাকা, তা ছাপিয়ে সেবছর আয় হয় ১৭৮৩ কোটি টাকা। তৃণমূলের অভিষেক বর্ষে অর্থাৎ ২০১১ – ১২ অর্থবর্ষে এই রাজ্যে মদ বেচে আয় হয়েছিল ২১১৭ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের মার্চ পর্যন্ত পরপর তিনটি অর্থবর্ষে মদ বিক্রি বাবদ আয় হয় যথাক্রমে ৪০১৫ কোটি, ৫২২৬ কোটি এবং ৬০০০ কোটি টাকা। এইভাবে ক্রমান্বয়ে বাড়তে বাড়তে ২০১৯ সালে পৌঁছে যায় ১০ হাজার কোটি টাকায়। তাতেও সরকারের খায়েশ মেটেনি, ওই বছরই প্রায় এক হাজার নতুন মদের দোকানের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। ফলও মিলেছে হাতেনাতে। ২০২০ – ২১ অর্থবর্ষে আবগারি আয় বেড়ে হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা। মমতাময়ীর সরকার আরও উৎসাহিত হয়ে চলতি ২০২১ – ২২ অর্থবর্ষে আবগারি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে ১৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এই রাজ্যে মদ্যপানের বাড়বৃদ্ধির রেকর্ড বলছে এই লক্ষ্যপূরণ কেবলই সময়ের অপেক্ষা। প্রসঙ্গত, বিগত ১০ বছরে এই রাজ্যে মদ বিক্রি বাবদ আয় বেড়েছে ৫৭০ শতাংশ।
গত জুলাই মাসে প্রকাশিত সরকারি তথ্য অনুসারে সারা দেশের মধ্যে মদ্যপানে আমরা দ্বিতীয় স্থানে। প্রথম স্থানটি যোগী-রাজ্য উত্তরপ্রদেশের। সেখানে নিয়মিত মদ্যপায়ীর সংখ্যা ৪ কোটি ২০ লক্ষ। আর আমাদের রাজ্যে ওই সংখ্যাটি হল ১ কোটি ৪০ লক্ষ। তবে দুই রাজ্যের জনসংখ্যা পাশাপাশি রাখলে আমাদের প্রথম হতে না পারার আক্ষেপ বিশেষ থাকবে না! ২০১৯ সালে আমাদের রাজ্য ও যোগী-রাজ্যে জনসংখ্যা (projected) ছিল যথাক্রমে ১০ কোটি ও ২৪.১ কোটি। আরও একটি তথ্য হলো, পশ্চিমবঙ্গ, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে নাবালকদের মধ্যেও মাদকাসক্তি ক্রমবর্ধমান।
২০১৬ সালের এপ্রিল মাস থেকে বিহারে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ হয়। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত এক সমীক্ষা রিপোর্টে দেখা যায় ওই রাজ্যে খাদ্য ও বস্ত্রের বিক্রি বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। অন্যদিকে কমেছে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বিশেষত নারী নির্যাতন। কমেছে পথ দুর্ঘটনাও। আমাদের রাজ্যের নারী মুখ্যমন্ত্রী নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়ার লক্ষ্যে একদিকে লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্প বাস্তবায়নে নেমেছেন কোমর বেঁধে, অন্যদিকে আসন্ন উৎসবের মরশুমে মদের দোকানগুলিকে ২৫ শতাংশ বিক্রি না বাড়ালে লাইসেন্স বাতিলের হুমকি দিয়েছেন। কেন এই দ্বিচারিতা ? মদ্যপ স্বামীরা অতঃপর স্ত্রীদের চুলের মুঠি ধরে বলবে —
ভাঙ ভাঙ, লক্ষীর ভান্ডার ভাঙ,খাব আমি মদ, খাব গাঁজা ভাং!
চন্দ্রপ্রকাশ সরকার :প্রাবন্ধিক ও ঝড়
পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য।
মুর্শিদাবাদ জেলা সাংবাদিক সঙ্ঘের সভাপতি।