যে ইতিহাস হয়তোবা অতি তুচ্ছ : শর্মিষ্ঠা, বিরানব্বই-পরবর্তী বাম আন্দোলন ও পোষাক-রাজনীতি

নন্দিনী ধর
আমরা তখন প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রী — স্নাতক স্তরের। আমি প্রথম বর্ষে, শর্মিষ্ঠা দ্বিতীয় বর্ষে। আমরা “নেহাই” বলে লিঙ্গ-রাজনীতি বিষয়ক একটি পত্রিকা করি। তো, সেই পত্রিকার তরফ থেকে কানোরিয়া যাবো — সেখানকার জুটমিলের যে শ্রমিক আন্দোলন, তার অন্তর্গত মেয়েদের সাথে কথা বলতে। কথা হচ্ছে যে, যেহেতু শ্রমিক- অঞ্চল, তাই আমাদের শাড়ি পরে হবে। তখনও পর্যন্ত একদিনের জন্যও শাড়ি পরিনি। মানে, এখনো পরি না। চার দশকেরও অধিক সময় কাটিয়ে দিলাম এই পৃথিবীতে। শাড়ি পরেছি হয়তো সাকুল্যে চারদিন। শর্মিষ্ঠাও পরেনি। পরতো না।
তো, শর্মিষ্ঠা বেঁকে বসলো। শাড়ি পরবে না, ওর প্রতিদিনকার পোশাক প্যান্ট-শার্ট পরেই যাবে। ঠিক কি মীমাংসা হয়েছিল সেদিন মনে নেই। তবে, নিশ্চিত শর্মিষ্ঠা শাড়ি পরে যায়নি। আমিও না। এই গল্পটা অতি তুচ্ছ শর্মিষ্ঠার পরবর্তী জীবনের ব্যাপ্তির কাছে। যেখানে আছে লুমটেক্সের আন্দোলন, নারী আন্দোলন, ভাঙ্গর, ইউএপিএ, কারাবাস, আরও কত কি। কিন্তু, তাও এই গল্পটি দিয়েই লেখা শুরু করলাম। কারণ, এক, প্রাত্যহিক রাজনীতি — তা সে প্রগতিশীল হোক, বা বাম বিপ্লবী বা চূড়ান্ত দক্ষিণপন্থী — তো আসলে তুচ্ছ প্রাত্যহিকতার সমাহার। সেখানে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তার ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে লড়াই। এমনকি, বিমূর্ত দর্শনও। এবং, বামপন্থী- কমুনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে যে ইতিহাস লেখা হয়েছে, সে ইতিহাস সচরাচর এই তুচ্ছ প্রাত্যহিকতার নথিবদ্ধকরণ, বা বিচার, এর কোনটা নিয়েই ঠিক স্বচ্ছন্দ নয়। দ্বিতীয় কারণটি আর একটু নির্দিষ্ট। এই যে গত কয়েক সপ্তাহে শর্মিষ্টা সম্পর্কে এতো কথা লেখা হলো, তাতে কতবার করে কতজন লিখলেন শর্মিষ্টার পোশাকের কথা ! ভালোবেসেই লিখলেন। কিন্তু, মজার বিষয় এই যে , গত কয়েকমাসের যে মৃত্য মিছিল, সেখানে পুরুষ কমরেড-বন্ধুদের মৃত্যু-পরবর্তী শ্রদ্ধাঞ্জলিতে তো এতবার করে এলো না তাদের পোশাক-পরিচ্ছদের কথা! তাহলে শর্মিষ্ঠার বেলাতেই বা কেন ?
আসলে, পোশাকের মধ্য দিয়ে তো মেয়েদের ওপর একধরনের গভীর সামাজিক পুলিশির বাতাবরণ তৈরী করা হয়। এই কথাটি বলার মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। একইভাবে পুলিশি করা হয় মেয়েদের শরীরী ভঙ্গিমা নিয়ে — কিভাবে তারা বসবে, কিভাবে তারা দাঁড়াবে, কতটা পা ফাঁক করে দাঁড়ানো বা বসা সর্বজনগ্রাহ্য। বা “শালীন”। যে দেশে শ্রেণী নির্বিশেষে পুরুষরা আদুর গায়ে বারমুডা বা গামছা বা লুঙ্গি পরে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে, সে দেশে মেয়েদের পোশাক, আবরণ-আস্তরণ ইত্যাদি নিয়ে এই চূড়ান্ত নেশাগ্রস্ততা দেখলে সাধারণ যুক্তিবোধমাফিক পেট ফেটে হাসি আসে বৈকি।
তো, এই যে মেয়েদের পোশাক নিয়ে অতি-সচেতনতা, অতি পুলিশির সামাজিক সংস্কৃতি, তা কেমনভাবে যেন চলে এলো কমুনিস্ট পার্টি সহ বাম-রাজনীতির চত্বরেও। সেখানে মেয়েদের ওপর চাপানো হলো শালীনতার দ্বায়ভার। মেয়েদের পোশাক নিয়ে তৈরী হলো একধরনের স্পর্শকাতরতা। এবং, সেই স্পর্শকাতরতার কারণ হিসেবে দর্শানো হলো, জনমুখীনতাকে। অর্থাৎ, কমুনিস্ট রাজনীতির যে ভিত্তিগত শ্রেণী রাজনীতি, সেই শ্রেণী রাজনীতির যে গণকাজের আকর, অর্থাৎ জনসংযোগ, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীগুলির সাথে যোগাযোগ, তাদের রাজনীতিকরণ, সেই ধারাবাহিকতায় তৈরী হওয়া রাজনৈতিক বৃত্ত, সেখানে রূপক হয়ে উঠলো পার্টির মধ্যেকার মধ্যবিত্ত মেয়েদের শরীর। এবং, তা হলো, জনগণের কাছে “গ্রহণযোগ্যতার” দোহাই দিয়ে।
তো, যে স্মৃতিচারণ দিয়ে শুরু করেছিলাম, যে শর্মিষ্টা-সহ আমাদের সবাইকে শাড়ি পরে শ্রমিকাঞ্চলে যেতে হবে, সেটা একভাবে যে মেয়েরা বামপন্থী রাজনীতি করেছে, তাদের প্রায় সবার কাছেই পরিচিত দৃশ্য। পরিচিত অভিজ্ঞতা। “শাড়ি” এখানে হয়ে উঠলো সেই শালীনতার প্রতীক, যা গায়ে জড়িয়ে শ্রমিকাঞ্চলে পা ফেললে একটি মধ্যবিত্ত মেয়ে, তার জীবনজাত সমস্ত শ্রেণীবিভেদ, শ্রেণীসংস্কৃতি বিভেদ বাদ দিয়েই, গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে “মাসের” কাছে।
এই যে সরলীকৃত, চালু লিঙ্গায়িত বিশ্লেষণ, তার থেকে বাদ পড়ে গেলো কতই না জটিলতর বোঝাবুঝি। যে “শাড়ি” পোশাকটি ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলায় উদারনৈতিক পুঁজির বিকাশের ইতিহাসের সাথে। সেই ইতিহাসের অন্তর্গত ভদ্রলোক শ্রেণীর উদ্ভব। সেই ভদ্রলোক শ্রেণীর আধ্যিপত্যকারী পৌরুষের চাহনি। যে চাহনি তার নিজের মতো করে গড়েপিটে নিতে চেয়েছিলো বাঙালি নারীর শরীর। কাজেই, শাড়ির প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে, প্রতিটি পরতের মধ্য দিয়ে বাংলার নারী নিজের শরীরে জড়িয়ে নিতে শিখেছে পুঁজি-বাস্তবতাকে। যে পুঁজি-বাস্তবতা আবার চাইলো, মধ্যবিত্ত মেয়েদেরকে একধরনের ঘরসজ্জার দ্রব্য বানিয়ে ফেলতে। অবশ্য, এই যে পুঁজি-বাস্তবতার জটিল ইতিহাস, তার জটিল সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবন, তাকে দেখানো হলো “ঐতিহ্যের” মোড়কে মুড়ে। কোথাও একটা প্রগাঢ়ভাবে থেকে গেলো সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির ছোঁয়া।
কিন্তু, কি অদ্ভুতভাবে যে কমিউনিস্ট পার্টির আধারে এই প্রশ্নগুলো ওঠার প্রয়োজনীয়তা ছিল, সেখানে তা উঠলো না। কাজেই, পুরুষ-কর্মী সংগঠকরা নির্দ্বিধায় প্যান্ট-শার্ট থেকে শুরু করে শ্বেতসফেদ ধুতিপাঞ্জাবি বা লুঙ্গি সবকিছু পরার পরোক্ষ অনুমতি পেলেও, মেয়েদের জন্য “কাম্য” পোশাক ধার্য হলো শাড়ি। তাও আবার বেশি ঝলরমলর নয়, সাদা সাদা, হিন্দুবিধবা কাটিং। তার অর্থ কি হলো ? অর্থ হলো এই যে, ঐতিহাসিকভাবে যে যৌন নীতিবাগীশতা নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজ নারী যৌনতাকে দেখলো, সেই একই নীতিবাগীশতা দিয়ে দেখা হলো কমিউনিস্ট পার্টি তথা সংস্কৃতির ভিতরেও। এবং, এই নীতিবাগীশতা তথা পুলিশি যেহেতু মেয়েদের সামনে হাজির করা হলো আরেকটা মহান কার্যক্রমের মোড়কে — “জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা” র বয়ান খাড়া করে — সেখানে এই পোশাক পুলিশির পরিবেশটি বজায় রাখা গেলো বেশ একটু মেয়েদের মধ্যেকার অপরাধবোধকে উস্কে দিয়ে।
সে যাই হোক, এক্ষেত্রে তো আসলে প্রশ্ন ওঠে কমিউনিস্ট রাজনীতি নিয়েই। “জনসাধারণের” কাছে সর্বদাই “গ্রহণযোগ্য” থেকে কোনো আমূল পরিবর্তনের রাজনীতি করা যায় কি ? বিশেষত:, জাতপাত, ধর্মীয় পরিচয় ও লিঙ্গ প্রশ্নে ? মানে মানে করে বলে রাখি, শ্রেণী বা পুঁজির প্রশ্নেও করা যায় না আসলে। কিন্তু সে অন্য বড়ো গল্প। এ লেখার প্রতিপাদ্য নয়। দ্বিতীয়ত:, গায়ে শাড়ি জড়িয়ে শ্রমিকঅঞ্চলে মধ্যবিত্ত মেয়েরা গেলেই তারা যে খুব “গ্রহণযোগ্য: হবে, এইরকম মাথার দিব্যিই বা কে দিলো? “গ্রহণযোগ্যতা” কি এতটাই বাহ্যিক ? নাকি, আসলে এই “জনসাধরণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা”– র বয়ানের আড়ালে আসলে মুখ ঢেকেছে পার্টির মধ্যবিত্ত পুরুষ নেতৃত্ব? ভিত্তি তৈরী করেছে তাদের নিজেদের রক্ষণশীলতার ?
এতসব কি ভাবতাম আমরা তখন ? না। কিন্তু, শাড়ির সাথে আমরা দেখতাম ঐতিহ্যের নামে অবদমন। যার ভার বহন করতে হয় মেয়েদের অনেক, অনেক বেশি। শাড়ির মধ্য দিয়ে আমরা দেখতাম বাঙালি মধ্যবিত্ত মেয়েদের মেনে নেওয়ার, মানিয়ে নেওয়ার লম্বা ইতিহাস। বাঙালি মেয়ের শরীরকে একইসাথে যৌনায়িত করার ইতিহাস, ও সেই যৌনায়নকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ইতিহাস। আর, পায়ের কাছে জড়িয়ে যাওয়া, লটরপটর করতে থাকার প্রাত্যহিক বিরক্তিটি নাহয় বাদই দিলাম। তো, এই যে শাড়ি না পরা, এর মধ্যে তাই ছিল একটা আধিপত্যকারী বাঙালিয়ানার ধারণাকে প্রশ্ন করার প্রচেষ্টাও।
তো, যাই হোক, সেই দিনই শর্মিষ্ঠা পরতো ঢোলা জিন্স। ছেলেদের। সাথে টি-শার্ট। অথবা শার্ট। তাও ছেলেদের। পরবর্তীসময়ে বয়স বাড়া ও বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনে আরও গভীরভাবে সংযুক্তিকরণের সাথে সাথে, সেই পোশাকের মূল কাঠামোতে এসেছিলো কিছু কিছু পরিবর্তন। কখনো জিনসের সাথে যোগ হতো কুর্তি বা ঢোলা টপ, কখনো শার্টের সাথে রঙিন পাজামা। সেই পোশাক ধারার মধ্যে একধরনের মধ্যে একধরনের সৃষ্টিশীলতা ছিল। আবার, যারা শর্মিষ্ঠাকে কাছের থেকে জানে, তারা এও জানতো যে, প্রাত্যহিক জীবনে পোশাক, চুল আঁচড়ানো, সাজগোজ এসব নিয়ে শর্মিষ্ঠার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। মানে, এসব ব্যাপারে শর্মিষ্ঠার থেকে বড়ো লক্ষ্মীছাড়ার দেখা মেলা ভাঁড়। মানে, একধরণের দ্বৈততা, দ্বন্দ্ব ছিল শর্মিষ্ঠার এই পোশাক নান্দনিকতার ভেতর। যাকে আমি বলবো, একধরনের গভীর রাজনীতি। একধরনের গভীর দ্রোহভাষ্য। যা শুধু রাস্তায় মাইক ফোঁকায় সীমাবদ্ধ থাকে না। ছিল না। আবার মাইক ফোঁকা ব্যাতিরেকেও হয় না।
মানে, শর্মিষ্ঠার মতো মেয়েরা, যারা বামপন্থী/ কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেই কাজ করেছে, এবং কাজ করতে গিয়ে বাম-রক্ষণশীলতার লিঙ্গ-যৌন রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তাদের আরেকটি বিষয়েও গভীরভাবে সচেতন হতে হয়েছে। তা হলো, একদিকে যেমন রক্ষণশীলতার পোশাক-রাজনীতিকে বর্জন করতে হবে, তেমনি নারী-শরীরের অতি-যৌনায়নের যে এক ধরনের বিশেষ নান্দনিকতা, যা ভারতবর্ষে এলো নয়া-উদারনৈতিক পুঁজির হাত ধরে, এলো এবং তড়িৎ গতিতে অধুনা যে “একটিভিস্ট স্পেস”, যার অনেকটাই অধিকার করে থাকে সামাজিক গণমাধ্যম, সেখানকার দৃশ্যমানতার নান্দনিকতা, রাজনীতি — সেখানে জায়গা করে নিলো।
অস্বীকার করবো না, বিষয়টি জটিল। পোশাক বা সাজগোজ বিষয়টি অতীব ব্যক্তিগত। একভাবে দেখলে। যেহেতু ব্যক্তিগত, তাই এক ব্যক্তিমানুষ, ব্যক্তিনারীর পোশাকের নির্বাচন, আসলে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, ব্যক্তিগত অধিকার। “চয়েস।” যে শব্দটির মধ্য দিয়ে বহুক্ষেত্রে আজকের লিঙ্গ-রাজনীতি অন্তর্গত পোশাকের রাজনীতি, যৌনতার রাজনীতি ব্যক্ত হয়, হয়েছে। নি: সন্দেহে, অধিকার আন্দোলনের ক্ষেত্রে, বিশেষত:, নারী আন্দোলনের ক্ষেত্রে, “চয়েস” ব্যাপারটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই নিজের পছন্দের অধিকারটিই তো পিতৃতন্ত্র ঐতিহাসিকভাবে দেয়নি মেয়েদের। তা সে তার যৌনতার ক্ষেত্রেই হোক, অথবা তার পোশাক-নির্বাচনের ক্ষেত্রে, অথবা তার পেশা-নির্বাচনের ক্ষেত্রে। তাই, পোশাক হয়ে উঠতে পারে, ক্ষেত্রবিশেষে, একটি মেয়ের কাছে বড়ো লড়াইয়ের হাতিয়ার। হ্যাঁ, এমনকি যাকে আমি বলছি নয়া-উদারনৈতিকতার অতি নারীত্বের অতি-যৌনায়িত নন্দনতত্ত্ব, সেই নান্দনিকতাও ক্ষেত্রবিশেষে একটি মেয়ের কাছে, বা সমষ্টিগতভাবে মেয়েদের কাছে হতে পারে লড়াইয়ের হাতিয়ার। রাষ্ট্রীয় পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। বিশেষত:, ভারতবর্ষের মতো সামাজিক রক্ষণশীলতার দেশে। বিশেষত:, ভারতবর্ষের হিন্দুত্ব- ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। তালিবানি রাজনীতির বিরুদ্ধে। অন্যান্য ধর্মীয় মৌলবাদের ক্ষেত্রেও এই বয়ানটির অন্যথা বড়ো একটা অন্যথা ঘটবে না। এবং, সাম্প্রতিকতম বাংলার যে তরুণতর “এক্টিভিস্ট স্পেস”, সেখানে যে এই যাকে আমি বলছি অতি-যৌনায়িত, অতি-নারীত্বের নয়া-উদারনৈতিকতার নান্দনিকতা, তা আসলে বাংলার আধ্যিপত্যকারী, রক্ষণশীল বাম রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরূদ্ধে একধরনের প্রতিবাদ, প্রতিক্রিয়া। কিন্তু, তারপরেও তো থেকে যায় একাধিক প্রশ্ন।
কে, কি এবং/ কিংবা নির্ধারণ করে আমাদের “চয়েস” সমূহ ? আমার “চয়েস” কি শুধুই আমার ? আমার “পছন্দ”, বা “চয়েস” বা এমনকি “অধিকার” বললেই কি থেমে যায় সমস্ত মতাদর্শগত আলোচনা বা বিতর্ক ? আমার “চয়েস” — এর মতাদর্শটি ঠিক কি ? আচ্ছা, পাদগন্ধযুক্ত একটি “চয়েস” আর পচনগন্ধাবৃত একটি “চয়েস” — এই দুইয়ের মধ্যেই যদি থেমে থাকে আমার চলাফেরা — থুড়ি, “এজেন্সি” — তাহলে আসলে ঘটলো কি কোনো রাজনৈতিক বা সামাজিক বিবর্তন ? আচ্ছা, প্রায় – বাধ্যতামূলকভাবে শাড়ি পরানো যদি হয় পিতৃতান্ত্রিক পুলিশির প্রতীক, পোঁদ-খিমচানো সরু স্কার্ট, মাই-খিমচানো টপ আর খোঁড়া করে দেওয়া হিলতোলা জুতো, যা একইভাবে প্রায়-বাধ্যতামূলক কর্পোরেট পোশাক মেয়েদের জন্য, তা কেন হবে আধুনিকতা, অতএব মুক্তির, প্রতীক ? পিতৃতান্ত্রিক পুলিশির প্রতীক নয় ? কিন্তু, ঠিক সেইভাবে আওয়াজ উঠলো না তো দ্বিতীয়টির বিরূদ্ধে এদেশের নারী-আন্দোলনের মধ্য হতে ?
শর্মিষ্ঠা জানতো, “চয়েস”, অথবা পছন্দ বা, ক্ষেত্রবিশেষে অধিকার ঠিক সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তি বা “লিবারেশন” নয়। “চয়েস” বা “অধিকার” কোনো ইতিহাস বা সামাজিক পরিকাঠামো বিচ্ছিন্নভাবে আসে না। শর্মিষ্ঠা জানতো, “চয়েস”– এরও থাকে মতাদর্শ। তাই, অনেকাংশেই শর্মিষ্ঠার যে ব্যক্তিগত পোশাক রাজনীতি। শাড়ির উদারনৈতিক পুঁজির সুললিত যৌনায়নের প্রত্যাখ্যান, আবার নয়া-উদারনৈতিকতার আর একটু আগ্রাসী যৌনায়নের অতি-নারীত্বের প্রতিচ্ছবিরও প্রত্যাখ্যান। এই যুগ্ম প্রত্যাখানের মধ্য থেকে শর্মিষ্ঠাকে ঘাড়ে নিতে হয়েছিল একধরনের ব্যক্তিগত\
সৃজনশীলতার দায়ভারও। কারণ, কোনো প্রত্যাখ্যানই তো আসলে শুধু প্রত্যাখ্যান হয়না, থাকে না। প্রত্যাখানেরও থাকে কিছু দায়িত্ব। এবং, যে ধরনের দায়ভার কাঁধে তুলেছিল শর্মিষ্ঠা, ঐতিহাসিকভাবে বামপন্থী আন্দোলনে তা বহন করতে হয়েছে শুধু মেয়েদেরই। তো, সেই দায়ভার কাঁধে নিয়ে শর্মিষ্ঠা নিজের জন্য তৈরী করেছিল এক অন্য ধরনের শরীরভাষ্য। যার মধ্যে পোষাক বিষয়টিও একটি ভূমিকা পালন করেছিল।
না, এ বিষয়ে শর্মিষ্ঠা একক ছিল না। একভাবে দেখতে গেলে বামপন্থী- প্রগতিশীল শিবিরে শর্মিষ্ঠার এই ব্যক্তিগত নান্দনিকতা অনেক মেয়েরই নান্দনিকতা। বিশেষত:, আমাদের প্রজন্ম বা তার পরবর্তী প্রজন্মগুলিতে। কিন্তু, শর্মিষ্ঠা এই নান্দনিকতাকে ধারণ করেছিল একধরনের আত্মবিশ্বাসের সাথে। শ্রমিক আন্দোলন হয়ে ভাঙ্গর হয়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াইয়ে নিজের প্রাণপাত অংশগ্রহণের মধ্যে দিয়ে প্রমাণ করে দেখিয়েছিলো, পোশাক বা চুলের মাপ বা ছাঁট, কোনোটাই আসলে জনসমর্থনের পরিপন্থী হয়ে দাঁড়ায় না।
তো, এই বিষয়ে কথা হচ্ছিলো এক অনুজপ্রতিম বন্ধু/ কমরেডের সাথে। আমাদের থেকে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। তো, তার বক্তব্য — “আসলে দেখো, শর্মিষ্ঠাদি কিন্তু সারাজীবন ডি-সেক্সুয়ালাইজড ভাবেই নিজেকে হাজির করেছে সারাজীবন।” হেসে ফেলি। “ডি-সেক্সুয়ালাইজ্ড” অর্থাৎ, বি-যৌনায়িত। আমার এই বন্ধুটি কোনো নতুন কথা বলেনি। কথাটি বাজারচলতি কথা। যাকে আজ নতুন করে জনসমক্ষে হাজির করেছে সামাজিক গণমাধ্যমজাত লিঙ্গ রাজনীতি ও নারীবাদ সম্বন্ধীয় আলোচনা। যদিও, বহু প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণাতেও আসতে শুরু করেছে এই বক্তব্য।
আসলে, শর্মিষ্ঠা “ডি-সেক্সুলাইজড” বা “বি-যৌনায়িত” কিনা আমরা জানি না। ওর শোবার ঘরে আমরা কেউই মশা হয়ে বসে দেওয়ালে বসে থাকি নি। যেমন, বসে থাকিনি যে মেয়েরা “সেক্সুয়ালাইজড” হয়ে ঘুরে বেড়ায়, তাদের সবার ঘরের দেওয়ালে। অর্থাৎ, “বি-যৌনায়িত” বা “যৌনায়িত”, এই দুটোর কোনোটাই আসলে এই আলোচনায় বাস্তবিক যৌনক্রিয়া ও তন্মধ্যে সক্রিয়তা দিয়ে নির্ধারিত হলো না। হলো একধরনের দৃশ্যমান নান্দনিকতা দিয়ে , একধরনের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি দিয়ে। কাজেই, ভেবে দেখতে গেলে, বিষয়টি অনেক, অনেক জটিল। এই প্রতিবেদনের আওতার বাইরে। আর, এই প্রতিবেদনের বিষয় তো আদতে ছিল শর্মিষ্ঠা।
আসলে, আরও অনেক অনেক কিছুর সাথে বিদ্রোহের পাশাপাশি শর্মিষ্ঠার জীবনে একটি গভীরতর বিদ্রোহ আসলে ছিল। একধরনের লিঙ্গায়িত লিলিপুটায়নের বিরূদ্ধে। যে সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই সমাজ মধ্যবিত্ত, বাঙালি মেয়েদের লিলিপুট বানায়, তার বিরূদ্ধে। যে সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টিও ঐতিহাসিকভাবে মেয়েদের বিপুল পরিমাণ মুক্তির পথ দেখানো সত্ত্বেও, লিলিপুট বানিয়েছে, তার বিরূদ্ধে। এবং, সেই লিলিপুটায়নের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে গিয়ে, শর্মিষ্ঠা সমাজের দাগিয়ে দেওয়া মধ্যবিত্ত নারীত্বের যে কাঁটাতারের বর্ডার, তা পেরিয়ে যেতে দ্বিধা করেনি।
শর্মিষ্ঠা আজ নেই। মনে পড়ছে কত কথা। সাম্প্রতিক সময়ে ফ্যাসিবাদবিরোধী মিছিলে একসাথে পথ হাঁটা। শর্মিষ্ঠা জননেত্রী। আমি নই। ওর থেকে অনেক, অনেক দায়িত্বজ্ঞানহীন আমার জীবন। তবু, একসাথে মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি। কখনো সস্নেহে এখনকার তরুণ কর্মীদের নিয়ে। কখনো আন্দোলনের ক্ষেত্রের “ব্যাটাছেলেদের” নির্বুদ্ধিতা নিয়ে। কথা বলছি আমরা আজকের ম্রিয়মাণ নারী আন্দোলন তথা আজকের সামাজিক গণমাধ্যমের সমস্যাকীর্ণ “নারীবাদ” নিয়ে। কিংবা ব্রিগেডের প্রাক্কালে সিপিএমের মেয়েদের রাঁধতে বসানো নিয়ে। পরিকল্পনা করছিলো শর্মিষ্ঠা কিছু কিছু জিনিস লেখার। তারপর নির্বাচন। তারপর অসুস্থতা। মধ্যে মধ্যে সামাজিক গণমাধ্যমে ওর হতাশাপূর্ণ কথাবার্তা। আমাদের অনেকেরই ধমক। গভীর রাত পর্যন্ত ওর জেগে থাকা। ঘুমোতে যেতে বললে ওর এক কথা, “জ্ঞান দিবি না।”
সত্যি বলতে কি, এখনো ঠিক বিশ্বাস হয় না যে শর্মিষ্ঠা নেই। গত সপ্তাহে ওর স্মরণসভা আর ইয়া বড়ো কাট-আউটে ওর থোবড়ার এত্তো এত্তো ছবি দেখার পরেও নয়। মনের ভেতরে আমাদের কলেজবেলার কতো কতো ছবি — প্রেসিডেন্সি কলেজের পোর্টিকোতে ফিল্টার উইলস হাতে শর্মিষ্ঠা, আমাদের গড়িয়া স্টেশনের বাড়ির মেঝেতে বসে পোস্টার লিখছে শর্মিষ্ঠা। পরবর্তী সময়ের মিটিং-মিছিলের শর্মিষ্ঠা। মানে, ওই যে বললাম না, এখনো ঠিক ভেতর থেকে বিশ্বাস করি না যে শর্মিষ্ঠা নেই। তাই যে লেখাটা শুরু করেছিলাম শর্মিষ্ঠাকে দিয়ে, ওর স্মৃতিচারণায়, তা হয়ে গেলো আরও অনেক কিছুর কথা। আসলে, শর্মিষ্ঠার জীবনটাও তো ছিল অমনিই। একাধিক সামাজিক স্রোতের সংমিশ্রণ, সেসবের আঘাতে একভাবে নিজেকে গড়েপিটে নেওয়া। আশা রাখবো, যে পরবর্তী প্রজন্ম যারা আন্দোলনের ক্ষেত্রে আসবে, তারা শর্মিষ্ঠাকে মনে রাখবে, যথাযথ ঐতিহাসিকতা দিয়ে বিচার করবে শর্মিষ্ঠার ভাবনাচিন্তা, কাজকর্ম, ফেলে যাওয়া লেখালেখিসমূহকে।
নন্দিনী ধর: পেশাগতভাবে শিক্ষিকা। বিকল্প গণমাধ্যম আন্দোলনের কর্মী ও লেখিকা।
1 Comments
মূল্যবান লেখা। তবে কিছু অবান্তর কথা আছে বলে মনে হয়েছে।
“”অর্থাৎ, “বি-যৌনায়িত” বা “যৌনায়িত”, এই দুটোর কোনোটাই আসলে এই আলোচনায় বাস্তবিক যৌনক্রিয়া ও তন্মধ্যে সক্রিয়তা দিয়ে নির্ধারিত হলো না। হলো একধরনের দৃশ্যমান নান্দনিকতা দিয়ে , একধরনের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি দিয়ে।” কী অর্থ হয় এখানে এই কথার?
”শাড়ির উদারনৈতিক পুঁজির সুললিত যৌনায়নের প্রত্যাখ্যান, আবার নয়া-উদারনৈতিকতার আর একটু আগ্রাসী যৌনায়নের অতি-নারীত্বের প্রতিচ্ছবিরও প্রত্যাখ্যান”। ভালো লাগলো।
“আসলে দেখো, শর্মিষ্ঠাদি কিন্তু সারাজীবন ডি-সেক্সুয়ালাইজড ভাবেই নিজেকে হাজির করেছে সারাজীবন।”
এর উত্তরে শর্মিষ্ঠা “ডি-সেক্সুলাইজড” বা “বি-যৌনায়িত” কিনা, একথা আসে কি করে? সেই তরুণ তো শর্মিষ্ঠা কেমন তা বলেননি, তার পোশাক প্রসঙ্গে বলেছেন সে কিভাবে “নিজেকে হাজির করেছে”।
সব মিলিয়ে ভালো লেখা, প্রয়োজনীয় লেখা।