গাভী আমাদের মাতা

শামুয়েল আহমদ
উর্দু থেকে বাংলায় তরজমা করেছেন ঃ মবিনুল হক
এখন পিষে মারার রীতি হয়েছে।এখন আর একবারে জবাই করা হয় না।এখন একজন মানুষকে সবাই মিলে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারে।সদাচার,সৌভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা- সবই এখন পিষে মারা হচ্ছে।যখন পহ্লু খানের ‘মব-লিঞ্চিং’ হচ্ছে তখন মন্ত্রী মহোদয়ের চিন্তা হচ্ছে– বাকি মাংস গেল কোথায়?একটি গাভী থেকে কমপক্ষে দেড়মন মাংস পাওয়া যায়।স্বভাবমতো তারা না-হয় খুব বেশি হলে এক কিলো মাংস খেয়ে নিয়েছে।কিন্তু বাকিটা…?মন্ত্রী মহাশয়দের মধ্যে জেদ চাগিয়ে উঠেছিল যে এর তদন্ত হওয়া দরকার।পহ্লু মিয়াঁ গরু চুরি করতে গেল কেন?মন্ত্রী মহোদয়গণ এ বিষয়ে অত্যন্ত অখুশি ছিলেন যে গো-হত্যা,গো-চালানের উপর যখন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে,তখন মিয়াঁজির এমন সাহস হয় কি করে?গো-রক্ষকরা তো এসব অবশ্যই প্রতিরোধ করবে,আটকাতে চাইবে। আর তখন থেকেই দেয়ালের গায়ে সময়ের লিখন গভীর আর উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল– ‘তোমরা গাভী থেকে দূরে থাকো,নাহলে…’ এই দেওয়াললিপি সবচেয়ে আগে পড়েছিলেন মুয়াজ্জম খান।আর তিনি তাই উপহার পাওয়া তাঁর জার্সি গাভী দুটি ফেরত দিয়েছিলেন।সঈফের দাদা(ঠাকুরদা)-র কাছেও একটি জার্সি গাই ছিল,যেটি কৃষনমুরারী তাঁকে দিয়েছিলেন।কৃষনমুরারীর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল অনেক পুরোনো।তিনি কখনও কোনও মুশকিলে পড়লে দুই ভাঁজের টুপি পড়তেন আর দাদার কাছে দোয়ার আবেদন জানাতেন।দাদা জায়নামাজ পেতে বসে পড়তেন কৃষণমুরারী টুপি মাথায় তাঁর পাশে জানু পেতে বসতেন।দাদা সুরা ইউনুস ও অন্যান্য সুরা পড়ে দোয়া চাইতেন, “ইয়া আল্লাহ্ !… যেভাবে তুমি ইউনুস আলাইহেআসল্লমকে মাছের পেট থেকে নিরাপদে বের করে এনেছিলে,সেভাবেই আমার বন্ধুকে বিপদ-আপদের ফাঁস থেকে মুক্ত করে দাও…।”তিনি প্রায়শ কৃষণমুরারীকে তাবিজ আর ক্যালিগ্রাফি নকশা-শৈলীর দোয়া-কবজ ইত্যাদিও দিতেন।কখনও ‘আল-জামা’-র তাবিজ দিতেন তো কখনও হাফিজ সাহেবের নকশাকারী কবজ।একবার আল-গনি-র নকশা-কবজ দেওয়ার পর কৃষ্ণণমুরারী ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি হয়।কৃষণমুরারী বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন।
এখানে ওঁর দেখাশুনা করার মতো কেউ ছিল না।ওঁর ছেলে আমেরিকায় থাকতো।ছেলে বাবাকে নিজের কাছে দেখে নিল।যাওয়ার আগে তিনি তাঁর জার্সি গাইটি দাদাকে উপহার দিয়ে গেলেন। সেই সঙ্গে পনেরো-ষোলো বছরের মিচনাও গাইয়ের সঙ্গে চলে এল।টিংটিঙে ঢ্যাঙা মিচনা ছিল হরিজন জাতির।কালো ভুজঙ্গের মতো চেহারায় তাঁর দাঁতগুলি ছিল ফকফকে সাদা।যখন সে হাসত,তার মুখমণ্ডলের কালোত্ব যেন আরো ছড়িয়ে যেত আর দাঁতগুলি ঝিকমিক করত।কৃষণমুরারী ওকে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করেছেন।গাইটির দেখভাল সেই করত।গাইকে স্নান করাত, চারা দিত আর গোবর তুলে গোহাল পরিষ্কার করত।কিন্তু সেই গাইয়ের দুধ দুইতো অন্যজন– যে জাতিতে হরিজন নয়।মিচনার মনের বাসনা ছিল যেন সেও কখনো দুধ দোহাতে পায়।সরসর আওয়াজের সঙ্গে দুধের ধারা বালতিতে পড়ত আর ফেনায় ভরে যেত,তখন মিচনার মনে নেশা ধরে যেত আর সে বড়োই বিচলিত হয়ে ভাবত– যদি কখনও…। বিদায় গ্রহণের সময় কৃষণমুরারীজি মিচনার হাত দাদার হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন, ‘এর প্রতি খেয়াল রেখো… এ হল আমার নয়নের মণি…’। তারপর দাদার কাঁধে গলা লাগিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। দাদা উঠোনের এককোনায় গোহালঘর বানিয়ে দিলেন।মিচনার জন্যও ছোটো একটি কুঠরি বানিয়ে দিলেন।আর তাকে দুধ দুইবার অধিকার দিলেন।খুশিতে মিচনার চোখে জল এসে গেল।কেউ তাকে এমন সম্মান দেয়নি।সে দাদার পায়ের কাছে বসে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল।সে গাভীটিকে ‘মাতা’ বলত।দাদাও মাতা বলতে শুরু করলেন।মিচনা বাড়ির অন্যান্য কাজও করতে লাগল।আর খুব শীঘ্রই সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠল।কিন্তু দাদা ওকে নিজের জন্য বহাল করে নিলেন।ওর খাট একই বারান্দার কোনে পাতিয়ে নিলেন।তিনি নিজে ওই বারান্দাতেই শুতেন।রোদ আর বৃষ্টি থেকে বাঁচতে উপরের কড়ি-বর্গা থেকে বর্ষাতি লাগিয়ে রেখেছিলেন।সব ঋতুতেই ওঁর খাট এখানেই পড়ে থাকত আর তিনি সারাদিন ওই খাটে বসে হুঁকোয় গড়গড় আওয়াজ তুলতেন।মাঝেমধ্যে উঠে গিয়ে উঠোনের ফুলবাগানের পরিচর্যা করাতেন।মাতাকে গুড় খাওয়াতেন গুনগুনিয়ে একটি শের আওড়াতেন– “রব কা শুকর আদা কর ভাই জিসনে হামারি গাই বানায়ি উস মালিক কো কিঁউ না পুকারে জিস নে পিলায়ি দুধ কি ধারে।”মিচনা ওই শের শুনে মাথা নাড়ত।মাতাজিও ঘাড় দোলাত।
মিচনা অনেক চেষ্টা করত যদি ওই শের সে মুখস্ত করতে পারে!কিন্তু কয়েকটি শব্দের প্রয়োগে গড়বড় হয়ে যেত।দাদা তখন সেই শব্দগুলি স্থানীয় ভাষায় মুখস্ত করিয়েছিলেন
— “রব কা শুকর মানাওহ্ ভৈয়া
জিসনে হামারা গাই বানায়া…”
মিচনা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে শের পড়ত আর দুধ দোহাত… সরসর… সরসর…।
মনে মনে বলত, ‘হামারা মাতা কি ধার তো দেখো!’ মাতা রোজ দশ কিলো দুধ দিত।একদিন দেখল, মশামাছিতে মাতাকে খুব জ্বালাচ্ছে।দাদা তৎক্ষণাৎ গোহালঘরে টেবিলফ্যান লাগিয়ে দিলেন। বুড়োর কাছে ভবিষ্যৎ বলে কিছু ছিল না।তাঁর পাশে বসে পড়ো তো গুরু হয়ে যায় অতীতের কাহিনি।কিন্তু দাদার সেই অতীতে মাতাজিদের উপস্থিতি অবশ্যই থাকত।সন্ধ্যায় যখন তিনি বিছানায় শুয়ে হুঁকোয় গড়গড় আওয়াজ তুলতেন আর মিচনা ওঁর পা টিপে দিত ,তখন তিনি ওকে অতীত ইতিহাসের ঘটনা শোনাতেন– ১৯৬৬ সালে কীভাবে বিনোভা ভাবে সারা দেশে গো-হত্যার বিরুদ্ধে আইন তৈরির জন্য দাবি তুলেছিলেন আর ইন্দিরা গান্ধী কীভাবে গোরক্ষা আন্দোলনে গুলি চালানোর ব্যবস্থা করেছিলেন! দাদা মিচনাকে বোঝাতেন যে কীভাবে মাতাজি বিজেপিওয়ালাদের কাছে বিশেষ বিষয় হয়ে উঠেছিলেন।তারা মাতাজির নামে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছে।১৮৮২ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী ‘গো-রক্ষনী সভার’- ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন।তার কিছুদিন পর আজিমগঢ় আর মুম্বাইয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছিল।তারপর ১৯২৫ সালে আরএসএস স্থাপিত হয়। আরএসএস পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাঁর মুখ থেকে হুঁকোর নল খসে যেত।দাদার নাক ডাকতে শুরু করত আর মিচনা দাদার পা টিপতে টিপতে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ত। তারপর হঠাৎ একদিন যোগী মহেশ কশাইখানাগুলি বন্ধ করিয়ে দিলেন।প্রশাসনও পশু কেনা-বেচা আর চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করল।এতে মহেন্দর আচারিয়া অখুশি হলেন একারণে যে গরুর ব্যবসায় জড়িত আশি শতাংশ লোকজনই হল হিন্দু সম্প্রদায়ের… তাহলে কেন একটি মাত্র সম্প্রদায়কে নিশানা বানানো হচ্ছে? তারপর একদিন ঘরে ঢুকে পড়ল এক ষাঁড়! এবং দাদার কোমর ভেঙে দিল। দেওয়ালের লিখন আরও স্পষ্ট হয়ে গেল।দাদা গভীর নিদ্রায় ছিলেন।হঠাৎ ষাঁড়ের গর্জনে ঘুম ভেঙে গেল।সঈফও জেগে গেল।ষাঁড় দেখে তার ক্যামেরা নিয়ে এল।দাদা দেখলেন, ষাঁড়টি মাতাজির সঙ্গে লাফালাফি করছে।দাদা লাঠি নিয়ে তেড়ে গেলেন।ষাঁড়টি জোরে লাফিয়ে উঠল।ফুলের কেয়ারি ডিঙিয়ে বারান্দায় উঠে এল আর দাদার খাট উল্টে দিল।দাদাও এগিয়ে গেল এবং ষাঁড়ের পিঠে সপাটে লাঠি মারল।দাদা পেয়ারা গাছে ধাক্কা খেয়ে নিচে পড়লেন।কোমরের হাড় ভেঙে গেল।তিনি চিৎকার করে উঠলেন।তাঁর চিৎকার শুনে বাড়ির লোকজন দৌড়ে এল।সবাই মিলে কোনওক্রমে ষাঁড়টিকে তাড়িয়ে দিল।দাদাকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করতে হল।তাঁর সুস্থ হতে দু-মাস লেগে গেল।
এই ঘটনার সমস্ত দৃশ্য সঈফ ভিডিও বন্দি করেছিল।দু-দিন ধরে সে ভাবতে লাগল যে এই দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে কি না! শেষপর্যন্ত সে ফেক আইডি তৈরি করে ভিডিওটি লঞ্চ করে দিল।কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রতিক্রিয়া আসতে লাগল।দ্বিতীয় দিন সঈফ কোনও এক বিনোদ ভাস্করের ভিডিও দেখতে পেল।ভাস্কর চিৎকার করে বলছিল, “এখন তো শুধু ষাঁড় ছাড়া হয়েছে, তাতেই তোমাদের হাড় ভেঙে গেছে! এরকম লাখ লাখ ষাঁড় রয়েছে, যদি ছেড়ে দিই তো কুচলে মারবে।গাভী আমাদের মাতা হয়… আর তোমরা তাকে খাও! শালা… হারামি…” সঈফ ভিডিও দেখে প্রসন্ন হল।সে একথা ভেবে খুশি হল যে ওই আরএসএস-ভক্ত তার আইডি কে কোনও হিন্দুর আইডি ভেবেছে।কিন্তু দাদা ভয় পেলেন।তিনি অনুভব করলেন, এখন গাভী থেকে দূরে থাকাই মঙ্গলজনক।তিনি আখলাক আর পহ্লু খানের নিপীড়নের ভিডিও দেখেছিলেন।চারিদিক থেকে লাঠি,তরোয়াল আর বল্লম বর্ষিত হচ্ছিল।কেউ কোমরে আঘাত করছিল তো কেউ মাথায়, কেউ পায়ে কেউ বুকে।মরে যাওয়ার পরও নিপীড়ন সামনে জারি ছিল।দাদা কেঁপে উঠেছিলেন।সেসময় একথা কারও ভাবনাতে আসেনি যে সেটি ছিল তাদের সম্প্রদায়ের প্রতি চেতাবনি–‘গাই থেকে দূরে থাকো’।তাই মাতাজি এখন তাঁর কাছে ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছিল।তাঁর বিশ্বাস ছিল যে ষাঁড় আবার ঘরে ঢুকবে।তিনি মন্ত্রীজির ওই বয়ানে আরও শঙ্কিত হয়ে পড়লেন– ‘গাভী চুরি করা বেআইনি কাজ।লোকেরা একথা ভুলে যায় কেন যে সেসব আটকানোর জন্যই গোরক্ষক সমিতি বানানো হয়েছে।অর্থাৎ যাকে মারা হল সে অপরাধী ছিল আর খুনিরা অবশ্যই সত্যসন্ধানী।’ ষাঁড় সকলের কাছেই সমস্যা হয়ে উঠেছিল।সে সকলের ফসল ধ্বংস করছিল।ওকে আটকানোর সামর্থ কারো ছিল না।পশু ক্রয়-বিক্রয় ও চালান বন্ধ ছিল।আর পশুহাট তো অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।যেসব পশু কোনোকিছুরই যোগ্য ছিল না, তাদের বিক্রি করা যাচ্ছিল না।লোকেরা ওদের খোলামেলা ছেড়ে দিচ্ছিল।সেসব পশু ক্ষেত নষ্ট করত।অসুস্থ মাতাজিরা ইস্কুল ঘরের বারান্দায় দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা সারত।বারান্দা গোবরে ভরে যেত।বাচ্চারা গোবর পরিষ্কার করার পর পড়াশুনা শুরু করত।গ্রামের লোকজন আগে একেবারে ভোরে উঠে নিজেদের কাজকাম সেরে নিত।কিন্তু এখন সকালে উঠে হাতে ডান্ডা নিয়ে খেতে যেতে হয়।কেননা সকলেরই আশঙ্কা থাকে মাতাজিরা যদি খেতে ঢুকে পড়ে!হাজার পাহারা দাও,কোনো না কোনও পশু ঠিক ঢুকে পড়ে।সকলেই অপেক্ষায় ছিল ষাঁড়টি কবে মারা পড়ে! নিজেরা মেরে ফেলতে পারে না, কেননা তাহলে গোহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হতে হবে। দাদার অতীত থেকে এরপর মাতাজিরা বিদায় নিল।হুঁকোয় গড়গড় আওয়াজ তুলতে তুলতে তিনি এখন মিচনার সঙ্গে এমন গল্প আর করেন না যে নেহরুর সময়ে এসব সমস্যা ছিল না।আর বিজেপি যখন ‘জনসংঘ’ ছিল,তখন ওরা গাভীকে রাজনৈতিক ইস্যু বানিয়েছিল…।
দাদার চিন্তা ছিল কীভাবে মাতাজি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।গ্রামেরই কাউকে গোদান করে দেওয়া উচিত হবে না বলে মনে হল তাঁর।কেননা তাঁরা একথাই ভাবত যে মাতাজি আসবে মিঁয়াজির বাড়ি থেকে! দাদা একবার ভাবলেন যে থানায় বেঁধে দিয়ে চলে আসবেন।পুলিশের যা ভালো মনে হয় করবে।কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঘটনা সেরকম কিছু হল না। সঈফের কলেজের এক অ্যাকাউন্ট্যান্ট রমেশ রজক গাইটি কিনতে রাজি হলেন।একথা শুনে মিচনা ছটফট করতে লাগল।মাতাজি চলে গেলে সে কার সেবা করবে?সে উদাস হয়ে গেল।তার ক্ষুধা তৃষ্ণা চলে গেল।এককোনায় গুমসুম হয়ে বসে মাতাজির দিকে অশ্রুনত চোখে তাকিয়ে থাকল সে।দাদা ওকে ভরসা দিয়ে বলল যে ছাগল পালন করবে সে।ছাগলের সঙ্গে হিন্দুদের ধর্মীয় কোনও সম্পর্ক নেই।তাছাড়া ছাগল পালন করা সুন্নত।কেননা পয়গম্বর ছাগল ভেড়া চরাতেন।কিন্তু মিচনা অসুস্থ হয়ে পড়ল।আর ‘মাতাজি মাতাজি’ বলে বিড়বিড় করতে লাগল।তখন দাদা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি মিচনাকে মাতাজির সঙ্গে পাঠাবেন।সে মাতার সঙ্গে এসেছিল আর মাতার সঙ্গেই নিজের সমাজে ফিরে যাবে। সঈফ কোর্ট থেকে গাভীটির ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কাগজ তৈরি করিয়ে নিল।সেই কাগজে গাভীর ছবিও সংলগ্ন করে দেওয়া হল যাতে চুরির অপবাদ না ওঠে।এখন বাকি রইল গাইটি নিয়ে যাওয়া।রমেশ গাভীটি তার গ্রামে পাঠাতে চায়।রমেশের সেই গ্রাম ছিল দাদার গ্রাম থেকে দুশো কিলোমিটার দূরে।রমেশ একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করল।দরজায় ট্রাক দাঁড়াতেই গ্রামের লোকজন কৌতুহলী হয়ে দাঁড়িয়ে গেল দেখার জন্য যে কি বস্তু যাবে ওই ট্রাকে! কয়েক মিনিটেই একথা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল যে দাদা গাভী বিক্রি করে দিয়েছে।গ্রামের সরপঞ্চ ছিলেন ব্রাহ্মণ।তিনি ভাবলেন,গাভী কিনল কে? যখন জানতে পারলেন যে কোনও এক রমেশ রজক গাভীটি কিনেছে, তখন তার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল।শূদ্র কিনেছে গাভী…?রমেশের কাছে গাভী কেনার কাগজপত্র ছিল।সে গাভীটি ট্রাকে তুলিয়ে মিচনাকেও সঙ্গে নিল।নিজেও ট্রাকে উঠে বসল আর যাত্রা শুরু করল।ইতিমধ্যে সরপঞ্চ গোরক্ষক বাহিনীকে ফোন করে বলে দিলেন যে এক শূদ্র জার্সি গাই চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।ট্রাক বিলুয়াচকের আগে আর যেতে পারল না।গোরক্ষকরা অস্ত্র সমেত সেখানে দাঁড়িয়েছিল।হাল্লাগোল্লা পাকিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।রমেশ জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কাগজপত্র দেখাল। “বাইরে আয় শালা…” কাগজ দেখার বদলে কেউ ওকে টেনে নিচে নামিয়ে আনল।’ভারত মাতা কি জয়’- স্লোগানে আশপাশ মুখরিত হয়ে উঠল।রমেশ হাতজোর করে বিড়বিড় করতে লাগল, “আমি মুসলমান নই দাদা… আমি মুসলমান নই…” মাথায় সজোরে লাঠি পড়ল।”চুপ শালা দলিত…” গণধোলাই শুরু হয়ে গেল।রমেশ চিৎকার করে বলতে লাগল– “আমি মুসলমান নই দাদা… আমি মুসলমান নই…।” এবং শেষবার সে আরও জোরে চিৎকার করে উঠল– “আমি হিন্দু… আমি হিন্দু…।” এভাবে চিৎকার করতে করতে সে ভুলে গিয়েছিল যে সে এক দলিত এবং ব্রহ্মার পা থেকে তার জন্ম।গাভী রাখার অধিকার তার নেই।সে মরা গাভীর চামড়া ছাড়াতে পারে, কিন্তু দুধ দুইতে পারে না…। এবং দেওয়ালে নতুন লেখা ফুটে উঠেছিল– “স্লেচ্ছদের সহযোগী হলে তো…”
শামুয়েল আহমদ ঃ প্রখ্যাত উর্দু গল্পকার, তাঁরা জন্ম ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে বিহারের পাটনায়।লেখকের পাঁচটি গল্পগ্রন্থ, পাঁচটি উপন্যাস এবং একটি অনুবাদগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।এছাড়াও তাঁর কাহিনি নিয়ে তিনটি টেলিফিল্ম তৈরি হয়েছে।লেখক বর্তমানে হায়দ্রাবাদে থাকেন।এখানে অনুদিত গল্পটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত উর্দু দ্বিমাসিক ‘ইনশা’ পত্রিকায় সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে ২০১৮ সংখ্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে- অনুবাদক
1 Comments
অসাধারণ লেখা। বাংলায় পড়েও শিউরে উঠলাম। উর্দু না জানার জন্য মাঝেমাঝে আফসোস হয়।