ফ্যাসিস্ত ধ্বংসলীলার ভূমিকা ও অসম হত্যাকাণ্ড

অশোক চট্টোপাধ্যায়
হত্যা কখনো মানবিক হয়না। খুন ধর্ষণ কখনো মমতার চিহ্ন রাখেনা। তবু আমরা কী এক অভ্যেসবশত বলে থাকি ‘অমানবিক’ গণহত্যা, নির্মম খুন কিম্বা ধর্ষণ! সম্প্রতি অসমে যে তিনজন মুসলিম অধিবাসীকে সেখানকার বিজেপি শাসকের নির্দেশে পুলিশ খুন করেছে, প্রকাশ্যে সভ্যসমাজকে নির্বাক করে একটি মৃতদেহের ওপরে পদাঘাত করেছে জনৈক পুলিশের ফোটোগ্রাফার—তার প্রতিবাদ করতে গিয়ে যুতসই শব্দ খুঁজে পাওয়া যায়না।
ফ্যাসিস্তরা এভাবেই প্রতিবাদকারীদের দমন করে থাকে, প্রতিবাদকারীদের এভাবেই প্রকাশ্যে হত্যা করে অন্য প্রতিবাদকারীদের সন্ত্রস্ত করার প্রয়াস পেয়ে থাকে। ইতিহাসে এমন নজির তো খুব একটা কম নেই। আসলে ফ্যাসিস্তরা এভাবেই তাদের জাতিদ্বেষের ঘৃণাকে সম্প্রচারে এনে থাকে। কিছুকাল আগে সামাজিক মাধ্যমে একটি শর্ট ফিল্ম দেখেছিলাম। তাতে দেখা যাচ্ছে জনৈকা ভদ্রমহিলাকে (তিনি সম্ভবত ইহুদি) ফ্যাসিস্ত সেনাকর্তারা তাদের সামনেই তাঁকে তার সমস্ত পোশাক খুলে ফেলতে নির্দেশ দেয়। একান্ত বাধ্য হয়েই তিনি সেই নির্দেশ পালন করেন। একে একে সব পোশাক খুলে তিনি তাদের সামনেই দিগম্বরা হন। তখন তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় গ্যাস চেম্বারে। সেখানে তাঁকে আবদ্ধ করে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করা হয়। একটা ছোট্ট ছিদ্রের মধ্যে দিয়ে স্যাডিস্টরা সেই ভদ্রমহিলার মৃত্যুর যন্ত্রণা উপভোগ করছিলেন।—এই ফিল্মটি দেখার অব্যবহিত পরেই সামাজিক মাধ্যমে তা আর দেখানো হয়নি এই যুক্তিতে যে ফিল্মটি নাকি অশ্লীল!
অসমে দু’জন প্রতিবাদীকে হত্যার করার সংবাদ প্রচারিত হলেও এই মৃত্যুসংখ্যা তিন/চার গুণ বেড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে। এদিন পুলিশের আক্রমণ থেকে এমনকি শিশুদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। কেননা এই শিশুরাও ফ্যাসিস্তদের চোখে আগামিদিনের বড়ো শত্রু হয়ে উঠবে তাদের কাছে। ফলে এখন থেকে তাদেরও রেহাই দেওয়া চলবে না। এই হত্যাকাণ্ডের যিনি নায়ক অর্থাৎ এই গণহত্যা যাঁর নেতৃত্বে ‘সুসম্পন্ন’ হয়েছে তিনি হলেন অসমের দারাং জেলার পুলিশ সুপার এবং স্বয়ং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা হিমন্ত বিশ্বশর্মার অনুজ সুশান্ত বিশ্বশর্মা!
উচ্ছেদের নামে এই হত্যাকাণ্ড নির্দিষ্টভাবেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর অনুমোদনেই সংঘটিত হয়েছে। কেননা এই ঘটনা সংঘটনের আগেই মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে অনুপ্রবেশকারীদের নিকেশ করা হবে। তিনি আরও বলেছিলেন যে অসমের আদি বাসিন্দাদের মধ্যে জমির পুনর্বন্টনের লক্ষ্যে অনুপ্রবেশকারীদের উচ্ছেদ করা জরুরি! আমাদের দেশের হিন্দু ধর্মীয় ফ্যাসিস্তদের কাছে প্রতিবেশী দেশ/দেশগুলি থেকে আমাদের দেশের যেকোনো প্রান্তে আশ্রয় নেওয়া ‘হিন্দুরা’ হলেন শরণার্থী এবং ‘মুসলিম’রা হলেন অনুপ্রবেশকারী! হিটলারের ইহুদি-বিদ্বেষের মতোই আমাদের দেশের সংঘপরিবার এবং বিজেপি সহ হিন্দুত্ববাদীদের কাছে মুসলিম-বিদ্বেষ একটি অত্যাবশ্যক পালনীয় ধর্ম হিসেবে গণ্য হয়েছে। বিভিন্ন অজুহাতে আমাদের দেশে মুসলিমদের নানাবিধ প্রক্রিয়ায় হত্যা করতে এই ফ্যাসিস্ত হিন্দুত্ববাদীরা এতটুকু দ্বিধা করেনা। ‘জয় শ্রীরাম’ না-বললে মুসলিমদের হত্যা করা হবে, গরু সমেত তাদের কাউকে দেখলেই গরু-চোর এবং গোহত্যা করছিল প্রচার রেখে প্রকাশ্যে তাদের হত্যা করা হয়। উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তো কবর থেকে মুসলিম মহিলাদের তুলে এনে ধর্ষণের নিদান দিয়েছিলেন!
অসমে উচ্ছেদের নামে দরিদ্র মুসলিমদের প্রকাশ্যে হত্যা করে মৃতদেহের ওপর উল্লাস নৃত্য সংঘটিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই আমাদের দেশের প্রচারপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপুঞ্জে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছন! যাঁর দল এবং দলের কর্মীরা সারা দেশ জুড়ে ধর্মীয় সন্ত্রাস কায়েম করে চলেছে অহর্নিশ, সেই দল এবং সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি বিশ্বরঙ্গমঞ্চে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে গলা ফাটাচ্ছেন! এর চাইতে নির্মম রসিকতা আর কী হতে পারে? বিশ্বের সবচাইতে বড়ো সন্ত্রাসবাদী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দেশে দেশে গণতন্ত্র রপ্তানির নামে সন্ত্রাস এবং হত্যার প্রকাশ্য প্রদর্শনী খুলে বসে। তারাই আবার দেশে দেশে গণতন্ত্রের বিপর্যয়ে সবচাইতে বেশি উদ্বেগের প্রকাশ ঘটায়। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রাজনৈতিক অনুশীলনকে কাজ লাগাতে বদ্ধপরিকর। প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে সুপ্রতিবেশী হওয়ার বিপ্রতীপে তাদের সঙ্গে শত্রুতার সম্পর্ক সৃষ্টি করে সবসময় তিনি এবং তাঁর সরকার একটা অঘোষিত যুদ্ধের পরিবেশ বজায় রেখে চলেছেন এবং দেশে জুড়ে বিশেষ বিশেষ সময়ে প্রয়োজনমতো উগ্রজাতিয়তাবাদকে তাঁরা ব্যবহার করে থাকেন নিজেদের দলীয় এবং রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণের লক্ষ্যেই।
ভিডিয়ো ফুটেজে দেখা গিয়েছে লাঠিধারী এক ব্যক্তিকে অসম সরকারের পুলিশ একেবারে নিকট-দূরত্ব থেকেই বুকে গুলি করেছে একবারে পরিকল্পিত হত্যার উদ্দেশেই। সেই নিহত ব্যক্তিটির বুকের ওপর উল্লাসে নৃত্য করছেন জনৈক ফোটোগ্রাফার। তাঁর নাম বিজয় বানিয়া। তিনি হলেন অসম পুলিশের ভাড়া-করা ফোটোগ্রাফার। নিহত প্রতিবাদকারীর মৃতদেহের ওপর তাঁর এই উল্লাসনৃত্য পুলিশের মদত ছাড়া সম্ভবই ছিলনা। এই ঘটনা প্রকাশ্য আসতে অবশ্য অসম সরকারের পুলিশ বিজয় বানিয়াকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সরকারি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করা এই ফোটোগাফার কতদিন অন্তরীণ থাকবেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়।
অসমের বিজেপি সরকার, দলীয় নেতৃত্ব এবং পুলিশ একযোগে একসুরে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তথা এই হত্যাকাণ্ড সমর্থন করতে গিয়ে জানিয়েছে যে অসমের দরং জেলার প্রায় সাড়ে চার হাজার বিঘা জমি বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ তথা মুসলিমরা জবর দখল করে রেখেছে! সরকারি নির্দেশে পুলিশ তাদের উচ্ছেদ করতে গেলে সেই সব ‘জবরদখলকারী’দের সঙ্গে সংঘর্ষে এগারো জন পুলিশ কর্মী আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী সরকার ইতিমধ্যে আটশ পরিবারকে উচ্ছেদ করেছে। অর্থাৎ পুলিশের এই অভিযানে প্রায় চারহাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়েছেন। ইতিমধ্যে পুলিশের গুলিতে নিহত এই সরকারি জমি ‘জবরদখলকারী’দের মধ্যে দুজনের নাম জানা গিয়েছে। এঁরা হলেন মইনুল হক এবং শেখ ফরিদ। দীর্ঘকাল এই এলাকার বাসিন্দা মইনুল হক, শেখ ফরিদরা বিজেপি সরকার, দলীয় নেতৃত্ব এবং পুলিশের কাছে বাংলাদেশের ‘অনুপ্রবেশকারী’ এবং এখানকার সরকারি জমির ‘জবরদখলকারী’ হয়ে গিয়েছেন! তাই তাঁদের উচ্ছেদ করতে গিয়েছে অসম সরকারের সশস্ত্র পুলিশ। নিজেদের বসবাসকারী জমি পুলিশ কেড়ে নেবে আর তাঁরা বসে বসে দেখবেন! এটা হয় নাকি। তাঁরা প্রতিবাদ করেছিলেন। আর এই প্রতিবাদের মূল্য তাঁদের পুলিশের গুলিতে জীবন দিয়ে দিতে হয়েছে।
আমাদের দেশের বিজেপি সরকারের দু’নম্বর কর্তা তথা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তো আগে অসমে এনআরসি এবং সিএএ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মুসলিম জনসাধারণকে ‘উইপোকা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এর নির্গলিতার্থ হচ্ছে এইসব উইপোকাদের আঙুলের নখে টিপে হত্যা করা দরকার। আর এই নিদানই অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে অসমের বিজেপি সরকারের পুলিশ। আর এই উইপোকা নিধনের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রীর অনুজ পুলিশ সুপার স্বয়ং।
ফ্যাসিস্তরা এভাবেই তাদের রাজনৈতিক অনুশীলনের পরিচয় রেখে থাকে। আজ থেকে তিয়াত্তর বছর আগে ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর হিটলারের ফ্যাসিস্ত বাহিনীর লোকেরা এক রাত্রেই ইহুদিদের সাড়ে সাত হাজার দোকান ধুলিসাৎ করে দিয়েছিল, ধ্বংস করেছিল শতাধিক উপাসনালয়। আর সেইসব ধ্বংসস্তূপের দখল নিয়েছিল জর্মনির ফ্যাসিস্ত যুববাহিনী। সেসময় স্কুল, কলেজ এবং সরকারি চাকরি থেকে ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। সেদিন এই ফ্যাসিস্ত হামলার বিরুদ্ধে সেখানে কোনও প্রতিবাদ-আন্দোলন সংঘটিত হয়নি। ভীতিবিহ্বল বুদ্ধিজীবীদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ বিদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রখ্যাত লেখক-বুদ্ধিজীবী স্তেফান জাইগ হিটলারি ফ্যাসিবাদের তীব্র বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও সরাসরি প্রতিবাদের রাস্তায় নামার সাহস অর্জন করতে পারেন নি, এবং ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী আক্রমণের সময় লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
আমাদের দেশে অবশ্য এখনো দেশের মানুষ প্রতিবাদের রাস্তা ছেড়ে দেননি। একথা সত্য প্রতিবাদ যেভাবে যতখানি হওয়া দরকার তা হচ্ছেনা, প্রতিরোধ গড়ে তোলা তো অনেক পরের কথা। আর এরই সুযোগ নিয়ে চলেছে আরএসএস-বিজেপির ফ্যাসিস্ত সরকার। কিছুদিন আগে ত্রিপুরায় বেশকিছু বামপন্থী রাজনৈতিক দল সহ বিরোধীদের অর্ধশতাধিক কার্যালয় ধ্বংস করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এই ফ্যাসিস্তরা। গোটা পাঁচেক সংবাদপত্র অফিসে ভাঙচুর করেছে।বিরোধীদের মিটিং মিছিলের অনুমতি দেয়নি। অর্থাৎ ফ্যাসিস্তরা চিরাচরিতভাবে যা করে থাকে, তাই তারা করেছে। এর প্রতিবাদ হয়েছে সন্দেহ নেই। কবি রঞ্জিত গুপ্তের একটি কবিতার লাইন মনে পড়ে : ‘এ মিছিল প্রাণের মিছিল না’। বাস্তবিক এই ফ্যাসিস্ত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা দেশ জুড়ে সমাবেশ মিছিল যা হচ্ছে তা প্রাণস্পর্শী নয়। একটা নিয়মতান্ত্রিকতার আধারেই এইসব ছেঁড়া ছেঁড়া আন্দোলন প্রতিবাদ সংঘটিত হচ্ছে। অসমে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংঘটিত হয়েছে বটে তবে তা নিয়মতান্ত্রিকতার নিগড়াবদ্ধ হয়েই। পশ্চিমবঙ্গে কলকাতায়ও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে সেই নিয়মতান্ত্রিক রীতি পদ্ধতি মেনেই। এই ধরনের নিয়মতান্তিরক প্রতিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলনকে বিড়ম্বিত করে মাত্র। প্রতিবাদী আন্দোলনের তীব্রতা, জঙ্গিপনাই তো প্রতিরোধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
মনে রাখা দরকার অসমের এই সাম্প্রতিক ঘটনা অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের, ধ্বংসলীলার ভূমিকা মাত্র। স্বভাবতই ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিছক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন নয়, আন্দোলনকে প্রাণস্পসর্শী করে তুলতে হবে, এই প্রতিবাদী আন্দোলনের তীব্রতা এবং এর জঙ্গিপনা ব্যতিরেকে ফ্যাসিবাদের চোখে চোখে রেখে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এবং ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধ জারি রাখা সম্ভব নয়।
অশোক চট্টোপাধ্যায় : বিশিষ্ট কবি ও প্রাবন্ধিক।