ঢাক

গৌতম বিশ্বাস
বাপ ছিল জাত ঢাকি।ঢাক যেন কথা বলতো তার হাতে।কত দূর দূর গাঁ থেকে ডাক আসতো তার।এমনিতে মানুষটা ছিল দিন মজুর।দিন আনি দিন খাই অবস্থা।আজ কাজে না গেলে কাল হাঁড়ি চড়তো না উনুনে।প্রথম প্রথম ঢাক বাজানোটা ছিল সখ।সেই সখই বুঝি একদিন পেশা হয়ে গেল তার।ডাক আসতে লাগলো দূর দূরান্তের গাঁ থেকে।একদিন গাঁয়ের নন্দী বাড়ির পুজোর স্থায়ী ঢাকি হয়ে গেল সে।বর্ষা শেষ হয়ে শরতে পড়তেই নন্দী বাড়ির মেজো ছেলে সুবর্ণ এসে হাজির হত বাড়িতে।আর উঠোনে ঢুকেই হাঁক ছাড়তো,” কই গো কাকা বাড়ি আছো নাকি?”
তখন হয়তো দিন ফুরিয়ে সন্ধে নেমেছে।কিংবা সন্ধে উতরে রাত।শরতের রাত মানে ঝলমলে আকাশের গা থেকে গড়িয়ে নামা জ্যোৎস্না।গা জুড়োনো একটা সিরসিরে বাতাস।হাজারো ফুলের ঘ্রাণ।
দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে হরিনাথ হয়তো তখন আকাশের দিকেই চেয়ে আছে।আচমকা নন্দীবাড়ির ছেলের গলা কানে যেতেই নড়ে চড়ে বসে সাড়া দিত,” হ বাপ আছি তো।”
সুবর্ণ নন্দী নিজেই দাওয়ার এক কোনে থাকা তালপাতার চাটাইটা টেনে নিয়ে পাশে বসতো হরিনাথের।বলতো,” পুজো তো এসে গেল কাকা।”
” হ বাপ,তাই তো।”
” তা এবারও ঢাক যে তোমারই বাঁজাতে হবে কাকা । “
একরাশ খুশি আচমকাই ছলকে উঠতো চোখে মুখে তার।এমন একটা ডাকের অপেক্ষাতেই তো থাকে হরিনাথ।যতটা না টাকার জন্য,তার থেকে বেশি ভেতরের একটা ভালোলাগার জন্য।নন্দীবাড়ির পুজো মানে কত দূর দূর থেকে মানুষ আসে।কত মানুষ শোনে তার বাজানো।
হরিনাথের চোখের সামনে ভেসে উঠতো নন্দীবাড়ির পুজো মন্ডপ।হাজারো মানুষের ভীড়।ধুনোর গন্ধ।সে বলতো,” ঠিকাছে বাপ,সমায় মতন চল্যে যাবানে।”
তো এমনই একদিন হরিনাথ এ কথা বলার পর সুবর্ণ নন্দী বলেছিল,” আর একটা কথা আছে কাকা।”
” কও।”
” নারান তো বড়ো হয়ে গেছে।কাঁসরটা এবার নারানই বাজাক।”
চমকে উঠেছিল বুঝি হরিনাথ,” কও কী বাপ?ও কী পারবে ই সপ?”
” পারবে না মানে?কার ছেলে দেখতে হবে না।যার বাপ এমন নাম করা ঢাকি সে কাঁসর বাজাতে পারবে না – এটা হয় নাকি?শোনো কাকা,বিনে পয়সায় তো আর বাজাবে না নারান।পরেশকে যা দিতাম ওকেও তাই দেবো।আসলে হয়েছে কী কাকা পরেশের শরীরটা ভালো নেই।অত ধকল সে নিতে পারবে না।তাই – “
সেই থেকে নন্দীবাড়িতে বাজানো শুরু নারানের।প্রথম প্রথম কেবল কাঁসরই বাজাতো সে।তবে ফাঁক ফোঁকরে একটু আধটু ঢাক বাজাতে গিয়ে একদিন পুরোপুরি ঢাকি হয়ে গেল সে।ততদিনে বাপের বয়স বেড়েছে।একটুতেই হাঁপিয়ে ওঠে।ঢাক বাজাতে যে সামর্থ্যের প্রয়োজন দিন কে দিন ফুরোতে বসেছে তা।
তো এক সন্ধেবেলায় ঘরের দাওয়ায় বাপের পাশে বসে নারান বলল,” শরীলডারে ইবার জিরেন দেও। সারাজেবন অনেক তো বাজাল্যে।ইবার আমার পর ছাড়ো দেহি।”
” কস কী বাপ?তুই কী পারবি?”
” ঢাকির ছেল্যে ঢাক বাজাতি পারবো না?এ তুমি কেমুন কথা কও?”
” আসলে হইছে কী বাপ – আমি জানি তুই পারবি।তবু কেমুন য্যান ডর লাগে।”
” ডর?ক্যান,ডর লাগে ক্যান?”
” এমন তরি তুই তো কুনোদিন বাজাস নেই।তাই – “
” বাজাই নেই তো কী?ইবার থে বাজাবো।”
নন্দী বাড়ি থেকেই ঢাক বাজানো শুরু নারানের।সেও এক শরত কাল।আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘ।হাওয়ায় পুজো পুজো গন্ধ।সকাল-সন্ধে শিশির ঝরে।ঝলমল করে রোদ।
সেবার থেকে নারানই বাজাবে শুনে সুবর্ণ নন্দী বেজায় খুশি।বলেছিল,” বেশ তো।তাছাড়া কাকারও বয়স বেড়েছে। এই বয়সে এত ধকল – “
প্রথম বছরেই ঢাক বাজিয়ে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়েছিল নারান।নন্দী মশাই খুশি হয়ে একশো টাকা বকশিস দিতে দিতে বলেছিলেন,” সত্যি নারান,একেবারে জাত ঢাকি হয়েছিস।তোর হাতের ছোয়ায় ঢাকে যেন বোল তোলে।”
বছর খানেকের মধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল নারানের নাম।ডাক আসতে শুরু করেছিল আশ পাশের গাঁ থেকে।কত রকমের পুজো তখন চারদিক মাইকের চল টাও শুরু হয়নি তেমন করে।পুজো মানেই তখন ঢাকের বাজনা।মন ভরানো বোল।
পুজো এলে মন ভরে যেত নারানেরও।সেইসঙ্গে হাতে আসতো বেশ কিছু টাকাও।তা দিয়ে বৌয়ের নতুন শাড়ি হত। ছেলেমেয়ের জামা হত। আর দিন কয়েক একটু ভালো খাওয়া দাওয়াও হত।বর্ষা গড়িয়ে শরত আসতেই ডাক আসতো নন্দী বাড়ি থেকে।পুজোর দু’দিন আগে থেকে শুরু হত বাজানো।চলতো দশমীর রাত পর্যন্ত।
এবছর সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে নারানের।পুজোর আর মাত্র দিন দুয়েক বাকি।অথচ নন্দীবাড়ি থেকে ডাক এলো না এখনও।কী করে আসবে?পুজোই তো হচ্ছে না সেই বাড়িতে।গিন্নি মা মারা গেছেন বলে এবছর পুজো বন্ধ। সারা গাঁয়ের মন খারাপ।মন খারাপ নারানেরও।
ঘরের দাওয়ায় খেঁজুর পাতার মাদুর পেতে তাতে পা ছড়িয়ে বসে আছে নারান। বিকেলের আলো পড়ে আসছে।তবুও বড়ো ঝলমলে চারিদিক।এখন আশ্বিনের মাঝামাঝি। দু’দিন পর থেকে পুজো।কোথায় আজ নন্দীবাড়িতে থাকার কথা তার।তা না,সে নিজের বাড়িতেই বসে আছে।বসে বসে ভাবছে অতীতের কথা।দুই চোখে ঝাঁক বেঁধে আসছে কত বছরকার নন্দীবাড়িতে ঢাক বাজানোর দৃশ্য।ঘুরে ফিরে আসছে বাপের মুখ।তার ছেলেবেলা।
বড়ো ক্লান্ত লাগছে নারানের।পিঠটাকে তাই এলিয়ে দিয়েছে বাঁশের খুঁটিতে।হালকা একটা সিরসিরে হাওয়া তাকে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে বার বার।উঠোনের আধখানা ছায়ার দখল।বাকি আধখানায় এখনও রোদ ছড়িয়ে আছে।সেই রোদের দিকে তাকিয়ে আছে নারান।খানিক আগে তার বৌ ফুলমালা বসে ছিল পাশেই। মনটা ভালো নেই তারও।ফি বছর যখন নন্দীবাড়ি থেকে ডাক আসে,পিঠে ঢাক নিয়ে বেরিয়ে যায় নারান – তখন কত ভালোই না লাগে তার।রাতের বেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে শোনে ঢাকের আওয়াজ।অথচ এবছর সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল।
ভাবতে গেলেই একরাশ মনখারাপি এসে ঘিরে ধরে তাকে।যেমন ধরেছিল আজও।সেই মনখারাপি নিয়েও ভালো থাকার চেষ্টা করেছিল ওপরে ওপরে।বলেছিল,” মন খারাপ করছো ক্যান?এট্টাবার না হয় না ই বাজাল্যে।তাতে কী হইছে?”
চুপচাপ বসে কেবল উঠোনের দিকে তাকিয়েই ছিল নারান।একরাশ মনখারাপি তখন ছড়িয়ে পড়ছে রোদ মাখা উঠোনে।
ফুলমালা আলতো করে নাড়া দিয়েছিল পিঠে,” কী হল?কথা কও না ক্যান?”
অনেকক্ষণ ধরে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বেরিয়ে এসেছিল ভেতর থেকে।উঠোনের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বৌয়ের দিকে তাকিয়েছিল নারান। ধরে আসা গলায় বলেছিল,” মন ডা ভালো নাই গো।কুথায় আমি অহন নন্দীবাড়ি থাকপো।ঢাক বাজাবো।তা না – “
” যা হবার তা তো হইয়েই গেছে।এট্টাবার বাবুগের কথাডা ভাবো দেহি।ফি বচ্ছর এই সমায় কত হৈ চৈ।কত মানষের আনাগোনা।আর ইবার?সারা বাড়ি কেমুন ঝিম মাইরে আছে।”
আরও কি কি যেন বলেছিল ফুলমালা।সবটা কানে ঢোকেনি নারানের।তার কানে কেবল বাজছিলো ঢাকের আওয়াজ।মানুষের হৈ কোলাহল।চুপচাপ বসে ছিল নারান।
এখনও সে বসে আছে তেমনি করেই।আকাশের গা গড়িয়ে নামছে দিন শেষের বিষণ্ণতা। ঘোলাটে হয়ে আসছে চারিদিক।কেমন একটা ঝিমিয়ে আসা ভাব চারপাশে।
আচমকা মোটর সাইকেলের আওয়াজ কানে যেতেই ঘুরে তাকালো নারান।দু’টো মোটর সাইকেলে তিনজন মানুষ ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে তার উঠোনে।যা দেখে অনেকটাই অবাক হল সে।এমন সময় এমনি করে কেউ কোনওদিন আসেনি তার বাড়িতে।
কি করবে বুঝে ওঠার আগেই লোকগুলো বাইক থেকে নেমে এগিয়ে এলো তার দিকে।নারানকে দেখে যেন খুশিই হয়েছে তারা।তাদের মধ্যে একজন বলল,” যাক, ভালোই হল।”
অবাক হল নারান,” ইজ্ঞে – “
” এবছর তাহলে আর যাওনি কোথাও?”
” ইজ্ঞে না বাবু।”
” তাহলে আর কী,আমাদের সাথেই চলো।”
ঈষৎ চমকে উঠলো নারান,” কুথায় যাতি কচ্ছেন বাবু?”
” আজ্ঞে আমরা শিমূলতলা সর্বজনীন থেকে আসছি।আসলে আমাদের ওখানে যার ঢাক বাজানোর কথা ছিল কাল থেকে তার ধুম জ্বর।এবছর আর সে পারবে না।এদিকে খবর পেলাম নন্দী বাড়িতে পুজো হচ্ছে না তাই ভাবলাম – “
একরাশ খুশি আচমকাই ছলকে উঠলো নারানের চোখেমুখে। গলা তুলে ডাক ছাড়লো,” শোনছো?কই গেলা?”
উঠোন ঝাটানো শেষ করে কলতলায় কি একটা করছিল ফুলমালা।মানুষগুলোর সঙ্গে নারানের কথার অনেকটাই কানে গেছে তার।নারান ডাকতেই পড়িমরি ছুটে এলো সে,” হঃ,কও।”
” বাবু রা অত দূরির থে আইছে,চাড্ডি মুড়ি জল দেও।আমি ততক্ষণে সবকিছু গোছায়ে নেই।শিমূলতলা যাতি হবে।”
হৈ হৈ করে উঠলো মানুষগুলো,” না না,কিছু খাবো না আমরা।বরং তুমি একটু তাড়াতাড়ি যদি বেরোও – “
কে শোনে কার কথা।একপ্রকার ছুটেই ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল ফুলমালা।তারপর বাটিতে করে মুড়ি,দু’টো নারকোল নাড়ু,আর একঢেলা করে গুড় এনে এগিয়ে দিল মানুষগুলোর সামনে।
ওদিকে নারান যেন তৈরী হয়েই ছিল।ঘর থেকে বেরোতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগলো তার।পরনে ধুতি।গায়ে গেঞ্জি। কাঁধে ঢাক।দেখে বুঝি চমকে উঠলো লোকগুলো।কেউ একজন বললো,” বেশ মানিয়েছে তো তোমাকে।”
কথা বলে আর সময় নষ্ট করতে চায় না নারান।সে বলল,” চল্যেন বাবু,এমনিতি দেরি হইয়ে গেছে।”
বাটিতে এখনও কিছু মুড়ি রয়ে গেছে।লোকগুলো উঠে পড়লো,” হ্যাঁ,হ্যাঁ,চলো।”
দাওয়া থেকে নামতে গিয়ে এক পলক পেছনে ঘুরে তাকালো নারান।ফুলমালার চোখেমুখে উথলে ওঠা খুশির ঝিলিক হঠাৎ করেই যেন আনমনা করে দিল নারানকে।