পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত মানবাধিকার কর্মীদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

আশিস গুপ্ত
বর্তমান সময়ে সারা দেশ জুড়ে এক অঘোষিত জরুরি অবস্থা চালু রয়েছে।প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে নাগরিক অধিকার পদদলিত। দল,পতাকার রঙ,মতাদর্শ নির্বিশেষে সমস্ত সরকার আজ দানবীয় আইনগুলি প্রয়োগ করে মানুষের অধিকারগুলিকে পদদলিত করছেন। ভীমা কোঁরেগাও থেকে পশ্চিমবঙ্গে গণ আন্দোলনের কর্মী টিপু সুলতান বা বাম শাসিত কেরল — ছবিটা একই রকম।এই পরিস্থিতি দাবি করে অধিকার কর্মীদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য ও জোটবদ্ধ লড়াই।কিন্তু গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি দেশের বৃহত্তম অধিকার সংগঠন এপিডিআর -এর আসন্ন কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে একশ্রেণির ‘ মানবাধিকার ‘ কর্মী একে অপরকে গালিগালাজ, কুৎসা,হুমকি প্রদর্শনের এক জঘন্য খেলায় নেমেছে। নিজেদের ব্যক্তি ও গোষ্টী স্বার্থকে চরিতার্থ করতে এই ধরনের ইতরামি আমরা ইতিপূর্বে কখনো দেখি নি।কিছু অর্বাচীন এই আচরণকে মতবাদিক ও আদর্শগত সংগ্রাম আখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।কিন্তু সংগঠনের বিভিন্ন অভ্যন্তরীন সভায় সদস্যদের বক্তব্য, মিনিটস সোসাল মিডিয়ায় ছেড়ে দেওয়া আর যাই হোক না কেন,আদর্শগত লড়াই হতে পারে না।এই আচরণ আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে ক্ষমতার আকচা আকচির কথা।এই খেলায় যারা মত্ত রয়েছেন তারা বুঝতে পারছেন না, তাদের আত্মঘাতী আচরণ আখেরে রাষ্ট্রের হাতকেই শক্তি জুগিয়ে চলেছে।
একথা সর্বজনবিদিত যে রাজ্যের প্রায় সমস্ত জেলায় এপিডিআর – এর শাখা রয়েছে এবং তার সদস্য সংখ্যাও অনেক।অধিকার সংগঠন কোন রেজিমেন্টেড সংগঠন নয় তাই এটা আশা করা বাতুলতা যে সমস্ত সদস্য এক সুরে কথা বলবে।মতের ভিন্নতা সেখানে থাকবেই এবং সেটাই গণতন্ত্রের চালিকা শক্তি।বিগত সময়ে এপিডিআর নেতৃত্বের কৃতিত্ব হল এই ভিন্ন মতকে সমন্বিত করে সে পথ চলেছে ও হয়ে উঠেছে অধিকার আন্দোলনের অগ্রণী সংগঠন।ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের সদস্য হিসাবে যখনই কেন্দ্রীয় সম্মেলনের প্রথম সেশনে উপস্থিত থেকেছি,চমৎকৃত হয়েছি সদস্যদের দায়বদ্ধতা ও উদ্দীপনা দেখে।আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি।গত তিন দশক ধরে যৌথ কাজের অংশীদার হিসাবে বিভিন্ন নেতৃত্বকে দেখেছি যেমন অমিতদুত্যি কুমার,সুজাত ভদ্র, দেবপ্রসাদ দা,ডাকু, তাপসদা,ধীরাজ সেনগুপ্ত — তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে এপিডিআর এর কোনো কোনো সদস্য বা সদস্যদের মতবিরোধের কথা শুনেছি, কিন্তু কখনো ভাবিনি সাম্প্রতিক সময়ের চলমান নোংরামি দেখতে হবে।
আজ এই সব সুযোগ সন্ধানী ‘ মানবাধিকার ‘ কর্মীরা কবর খুঁড়ে কঙ্কাল বার করার খেলায় মেতেছেন। এই আহাম্মকের দল আজ ভারতসভা,পানিহাটি,চন্দননগর — কোন সম্মেলনে কি কি ‘ অগণতান্ত্রিক ‘ কাজ হয়েছিল তার সবিস্তার বয়ান সোসাল মিডিয়ায় পোস্ট করছেন।এমন কি এ অভিযোগ করা হয়েছে নেতৃত্বের এক অংশের চক্রান্তের কারণে এক প্রবীণ সদস্য ( বাপি সেনগুপ্ত) মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছেন।আজ এ প্রশ্নটা ওঠা স্বাভাবিক কার স্বার্থে দু বছর আগের ঘটনায় আপনারা এতদিন ঘাপটি মেরে বসেছিলেন, আর আজ সম্মেলনের ঠিক আগে আপনাদের বিবেক জাগ্রত হয়ে উঠলো !
এই কুৎসার ধারাবাহিকতায় যথারীতি মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্রের নাম এসেছে।মানবাধিকার কর্মী হিসাবে তার কাজের মূল্যায়ণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়।শুধু তথ্যের খাতিরে মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন সুজাতবাবু শুধু এপিডিআরের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের সাধারণ সম্পাদক নন,এখনো তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাউন্সিল মেম্বার।একই সঙ্গে তিনি সিআরপিপি,বন্দীমুক্তি কমিটি, এনএপিএমের মত গুরুত্বপূর্ণ অধিকার সংগঠন গুলির নেতৃত্ব। একই সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন তার বক্তব্য, কার্যপদ্ধতি,নির্বাচন পর্বে তার রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কারোর বা অনেকের ভিন্নমত বা বিরোধিতা থাকতে পারে।এবং আমারও আছে। দেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের মুখোশটা আছে বলেই সেই মুখোশটা আমাকেও পরে নিতে এবং ‘কিছু একটা করতে হবে’ গোছের ভদ্র তত্বে আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু সমস্যা হল মাঝে মাঝেই তার বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগ বাজারে ভাসিয়ে দেওয়া হয় যার চূড়ান্ত ফয়সালা হওয়া প্রয়োজন। সুজাত ভদ্রের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সোসাল মিডিয়ায় করা হয়েছে তা আলোচনার স্বার্থে উদ্ধৃত করছি– ” সুজাত ভদ্র ও আরো কয়েকজন সমস্ত মানবাধিকার কর্মীদের কাছে এসএমএস পাঠিয়ে বলেন,’এই মিছিলটা হচ্ছে না কারণ এই তৃণমূল সরকার অত্যন্ত মানবিক সরকার , এদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা নেই’।দ্বিতীয়টি হল — ” এই ব্যক্তি জেলে গিয়ে রাজবন্দীদের বোঝান তারা যেন জেলের ভেতর কোন আন্দোলন না করেন কারণ এ সরকার মানবিক সরকার,সরকারের সাথে বন্দীমুক্তির চুক্তি হয়েছে, খুব শীঘ্রই সমস্ত রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া হবে”।এই অভিযোগগুলো গুরুতর কারণ কে মিছিলে যাবে বা আন্দোলন করবে তা ঠিক করার কোন এক্তিয়ার সুজাত বাবুর নেই।কিন্তু সত্য হল সুজাতবাবু তার বইতে ( ভিন্নমতের অধিকার) এবং এবারো দ্ব্যর্থহীন ভাষায় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এবং অভিযোগকারীদের প্রমাণ উপস্থিত করার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। এখানে স্বাভাবিক যুক্তিবোধ দাবি করে অভিযোগকারীরা( কুৎসাকারীরা?) এখনো পর্যন্ত সুজাতবাবুর নামাঙ্কিত সেই মেসেজ ও সেই রাজবন্দিদের বয়ান বা সাক্ষ্য উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদি এসএমএস থাকে তবে দেখাতে বাধা কোথায়? আর ২০১১ পরবর্তী সময়ে মহামান্য আদালতের নির্দেশে বহু রাজনৈতিক বন্দী হয় মুক্তি পেয়েছেন বা জামিনে বাইরে আছেন। তাহলে প্রমাণ পেশে অসুবিধা কোথায়? এই বিষয়টার চূড়ান্ত ফয়সালার জন্য আমার প্রস্তাব সুজাত বাবু ও যারা এই অভিযোগ প্রমাণ ছাড়া ধারাবাহিক ভাবে করে আসছেন তারা সন্মতি দিলে এক পাবলিক ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা হোক।
আমি মনে করি পেটি বুর্জোয়া মানসিকতায় লালিত যে কোন মূল্যে নেতা হবার আকাঙ্খায় মত্ত এই ‘ মানবাধিকার কর্মী’ রা সংখ্যায় কম।শুভবুদ্ধি সম্পন্ন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এপিডিআর কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি।আজ সময় এসেছে তাদের সক্রিয় হওয়া ও এইসব কুচক্রী, নির্বোধ,অগণতান্ত্রিক, আত্মঘাতী সদস্যদের বিচ্ছিন্ন করার।আর তা যদি না করা হয় তাহলে শুধু এপিডিআর নয় সমগ্র অধিকার আন্দোলনে চরম দুর্দিন নেমে আসবে। ফেসবুক কে যাঁরা সজ্ঞানে বর্তমান সময়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রধান মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করছেন তাঁরা কার্যত অধিকার আন্দোলনের পেছনে ছুরি মারছেন।
আশিস গুপ্ত : সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
1 Comments
একটা সংগঠনের আভ্যন্তরীণ সমস্যা নিয়ে সেই সংগঠনের এক কথিত বন্ধুর চিঠি এখানে প্রকাশ করে দিলে রাকেশ! আগে একটু আলোচনা করা কি যেত না?