দেশের স্বার্থ রক্ষার নামে জনগণের স্বার্থ খর্ব করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করুন

কৃষ্ণ প্রামাণিক
সম্প্রতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সীমান্ত সুরক্ষিত করার জন্য কয়েকটি রাজ্যে বিএসএফ-এর ক্ষমতা ১৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করেছে, তারমধ্যে পশ্চিমবাংলা অন্যতম। ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠে গেছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এই ধরনের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় সরকার একতরফাভাবে করে ঠিক করেছে কি ? বিজেপি এরাজ্যে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে যাওয়ার পরে রাজ্যশাসনে কেন্দ্রীয় সরকারের আধিপত্য বিস্তার করবার জন্য কি এই কৌশলের সিদ্ধান্ত? প্রশ্ন যাই থাকুক, এর ফলে রাজ্য সরকার গুলোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা,জনগণের দ্বারা নির্বাচিত পঞ্চায়েত, পৌরসভা গুলো তাদের স্বাধীন সত্তা হারিয়ে যাবে না তো ? এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন? সীমান্ত সুরক্ষিত থাকুক এটা ভারতের নাগরিক হিসেবে সকলেই চায়। পনেরো কিলোমিটারের অভিজ্ঞতা তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর দৃশ্যগুলি।
সারা ভারত কিষান মহাসভার একজন কর্মী হিসেবে নদীয়া জেলার ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্যের কথা আজও ভুলতে পারিনি। নদীয়া জেলার তেহটটো থানার দেবনাথপুর গ্রামটা একদম বাংলাদেশ সীমানা লাগোয়া। এরকম বহু গ্রাম সীমান্ত লাগোয়া। এখানকার কৃষকরা তাদের চাষের বলদ সুরক্ষিত রাখার জন্য শাটার লাগানো পাকা ঘর ব্যবহার করে, আর নিজেরা টালি অথবা টিনের ঘরে বসবাস করেন। প্রায় সারা রাতে সজাগ থাকতে হয় কবে কখন তাদের গরু লুট করে নিয়ে যাবে! যদিও সীমান্তে বিএসএফ পাহারা দিয়ে চলেছে।১৯৯১ সালের ১৭ মার্চ দেবনাথপুর গ্রামে অর্ধেক রাত্রে একজন কৃষকের দুটো বলদ শাটার খুলে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছেএকদল দুষ্কৃতী। আততায়ীরা অস্ত্রে সজ্জিত তাই চিৎকার ছাড়া কৃষকের আর কিছুই করার নেই। ঘরের কাছেই বিএসএফ। কৃষকরা বিএসএফকে বলছে, সর্বনাশ হয়ে গেল আমার গরু নিয়ে যাচ্ছে, ওই দেখুন, আপনি ধরুন না হলে ওদের গুলি করুন।সীমান্তরক্ষী নিশ্চুপ, কিছুই করলেন না। এবার কৃষকের রাগ গিয়ে পরল ওই বিএসএফ এর উপর। কৃষকরা ঘিরে ধরল, ধাক্কাধাক্কি দুই চড় চাপড় দিল সেই বিএসএফকে। তারপর কৃষকরা তাকে আটক করে থানার পুলিশকে জানাল, ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক কে জানাল। বিএসএফকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ব্লক উন্নয়ন আধিকারিক পুলিশি ব্যবস্থা করলেন। খবর পেয়ে বিএসএফ ব্যাটেলিয়ানের পক্ষ থেকে এক গাড়ি বাহিনী এসে পাহারাদার থানার পুলিশকে লাথি মেরে সরিয়ে দিয়ে ঘর থেকে সেই বিএসএফকে উদ্ধার করল। তারপর পাকা রাস্তার পাশে বাজারের দোকান গুলোতে কেনাবেচা ব্যস্ত লোক জনকে অতর্কিতে নির্দ্বিধায় বিএসএফের ব্যাটেলিয়ান গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে ১৭ জন কৃষক গ্রামবাসী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তারমধ্যে ১১ জনের মৃত্যু হয়, ৬ জন গুরুতর আহত হয় হাসপাতালে ভর্তি হয়।খবর পেয়ে আশেপাশের গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষ ছুটি আসেন, প্রতিবাদে সামিল হবেন রাস্তা অবরোধ করেন। অবশেষে জেলার পুলিশ সুপার বাহিনী নিয়ে ঘটনা পরিদর্শন করেন। জনগণের দাবি ছিল হত্যাকারী বিএসএফ এর শাস্তি চাই। নিহত ও আহত পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে ইত্যাদি। পুলিশ সুপার সমস্ত কিছু দেখে মর্মাহত হন। দায়িত্ব নিয়ে বিএসএফ ব্যাটেলিয়নের কর্মকর্তাকে ডাকেন। জনগণের সামনে অপরাধী বিএসএফের বিচার হবে, শাস্তি হবে, ক্ষতি পূরণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে অপরাধীদের কি হলো জনগণ জানে না। তবে কয়েকটা পরিবারের যুবককে চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছিল বলে জানা যায়। এই ঘটনা শিক্ষা দেয় যারাই রক্ষক, তারাই ভক্ষক। আর রক্ষকদের বিচার করার ব্যবস্থা থাকলেও বিচার করা হবে না।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বাগদা সীমান্ত এলাকা। বহু বছর আগের ঘটনা। বনগাঁ থেকে সীমান্ত পর্যন্ত বাস চলাচল করে। বিএসএফ সন্দেহজনক হলে বাসে খানাতল্লাশি করে। তল্লাশির সময় বিএসএফের অমানবিক অসামাজিক আচরণগুলো অনেকের কাছেই খারাপ লাগে কিন্তু বলার উপায় নেই। একদিন একজন কৃষক বাসের মধ্যে বিএসএফের এই ধরনের খানাতল্লাশির প্রতিবাদ জানালে তাকে বাস থেকে নামিয়ে সরাসরি বুকে রাইফেল দিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তীব্র প্রতিবাদ হয়। রাজ্যের পুলিশ থানা থেকে আসে। অভিযোগ শুনে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে। প্রতিবাদী মানুষ সেই ভরসায় তাদের প্রতিবাদকে সেই সময়ের জন্য তুলে নেয়। অবশেষে কিছুই হয়নি। সবাই বলে দেশের সুরক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই ধোপে টেকে না। কারণ তারা যা করেন তা দেশকে সুরক্ষিত রাখার জন্য! সুরক্ষার নামে দেশের সাধারণ নাগরিককে হত্যা করার অধিকার সংবিধানে নেই। অথচ ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ক্ষমতার স্বার্থে জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে জলাঞ্জলি দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। ৫০ কিলোমিটারের আইন যারা পাস করেছে তারা জনগণের সুরক্ষার নামে নিজেদের ক্ষমতার সুরক্ষা করবেন, সে কথা নির্দ্বিধায় মানুষ তাদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারছেন।
বিদেশে গরুর মাংস বিক্রি করার জন্য কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এই বাংলার সীমানা দিয়ে গরু পাচার হতে দেখেছেন অনেকেই। ভারতের তাবড় তাবড় এই মাংস ব্যবসায়ীদের চোখে না দেখলেও খবরের কাগজে তাদের নাম বেরিয়েছে। আধুনিক চাষে বলদ এর ব্যবহার প্রায় উঠে গেছে। ঘাস বিচালি দিয়ে এই বলদ পুষে কৃষির এই দুর্দিনে কৃষকরা বাজারে বলদ বিক্রি করে দিচ্ছে। কিনছে সেই মাংস ব্যবসায়ী। উত্তরপ্রদেশ হরিয়ানা থেকে বড় বড় লরিতে গরু পাচার হয়েছে পশ্চিম বাংলার সমস্ত সীমান্ত এলাকা দিয়ে। এই গরু পাচারের ফলে সীমান্ত এলাকায় কৃষকের ফসল ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। এই কাজে গ্রামীণ কৃষি মজুরদের ব্যবহার করা হতো। থানার পুলিশ, বিএসএফ উভয়ের নাকের ডগা দিয়ে এ কাজ হতো। এলাকায় এলাকায় কৃষকের প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। দেখা গেছে কৃষকরা এই সমস্ত বলদ আটকে রেখে বিএসএফকে খবর দিয়েছে। বিএসএফ আটক করেছে। গ্রামের মানুষ আপাতত স্বস্তি পেল। কিন্তু সেই পাচার করা আটক বলদ গুলো বিএসএফের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে। আমরা কৃষকসভার পক্ষ থেকে জেলাশাসক দপ্তরের কাছে অভিযোগ জানিয়েছি। তাদের বক্তব্য বিএসএফ সীমান্তে কেন আটকাচ্ছে না? সরূপনগর সীমান্তে গিয়ে দেখা গেছে কাঁটাতারের বেড়া প্রায় খানিকটা জায়গা থেকে উঠে গেছে। ওইখান দিয়ে গরু পাচার হয়। প্রতিবাদ করতে ভয় লাগে, যদি গুলি চালিয়ে হত্যা করে দেয় তাহলে কি হবে? এখানে সেই রক্ষক, ভক্ষক হিসাবে অবতীর্ণ হয়ে আছে। যত সমস্ত অপরাধী আছে তাদের সাথে এই রক্ষকদের গোপন আঁতাত আছে। একথা মানুষের মুখে মুখে ফেরে কিন্তু কোনো প্রমাণ নেই। গরু পাচারের এই ব্যবস্থাটাকে পাল্টানোর জন্য প্রকৃত বড় বড় ব্যবসায়ীদের কেন্দ্রীয় সরকার আজও গ্রেপ্তার করতে পারেনি তাদের বিচার হয়নি। অথচ সীমান্তে মজুর খাটা পাচারকারী সীমান্তরক্ষীর গুলিতে মারা গেছে।
সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়ার ওপাশে চূড়ান্ত সীমান্তের মাঝে যে কৃষি জমি আছে সেখানে কৃষকের চাষ, কোথাও বসবাসের ছোট গ্রাম আছে। স্বাধীন ভারতের নাগরিক হয়েও অন্নদাতা এই কৃষকরা অর্ধেক স্বাধীনতা ভোগ করেন বললে ভুল হবে না। সীমান্তরক্ষীর কথায় উঠতে হয়, বসতে হয়।
সীমান্ত পার হয়ে ওপার থেকে শ্রমজীবী মানুষ বউ-বাচ্চা সঙ্গে নিয়ে কাজের তাগিদে বিনা পাসপোর্টে হাঁটাপথে কোথাও নদী পার হয়ে ভারতে কাজ করতে আসে। কখনো বিএসএফ সঠিকভাবে তাদের আটক করে আবার কোথাও কোথাও তারা উৎকোচ গ্রহণ করে ছেড়ে দেয়। এই ঘটনা শুধু যাবার বেলায় নয়, ভোর বছর কাজ করে ফিরে এসে সীমান্ত পারে বিএসএফ এর হাতে ধরা পড়ে আর জেলখানায় তাদের আস্তানা হয়। এক, দুই বছর জেল খেটে ছাড়া পেলেও তাদের দেশে ফেরা হয় না। মাসের পর মাস বছরের পর বছর কাটে তাদের বিনা কারণে জেলের গারদে। বিএসএফ তাদের পুশ ব্যাক করে দেওয়ার কাজটা ঠিকমতো করতে পারেনা।
দেশের সংবিধান সম্মতভাবে আইন কে কার্যকরী রূপ দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র বিএসএফ নয়, নির্বাচিত গ্রাম শহরের সংস্থাগুলো জনগণের কাছে দায়বদ্ধ, তেমনি থানার পুলিশ। কিন্তু বাস্তবে এই সুরক্ষা বাহিনী যেমন জনগণের চোখের মনি, তাই বলে সুরক্ষা বাহিনী সংবিধানের ঊর্ধ্বে, আইনের ঊর্ধ্বে
হতে পারে না। আজকে মোদী সরকার “আইনের ঊর্ধ্বে” এই ব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করে নিজের পরাজিত হবার ক্ষোভকে প্রশমিত করার জন্য করে ১৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার করছেন কি? আদতে এটা কি বাংলায় জরুরি অবস্থার বিকল্প পথ?
কৃষ্ণ প্রামাণিক : প্রাবন্ধিক ও রাজনৈতিক কর্মী।
2 Comments
শুধু কৃষকরাই বিপদে পড়বে তাদের কৃষিজমি নিয়ে, বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। পঞ্চাশ কিলোমিটার পর্যন্ত বিএসএফ সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের কাগজপত্র চাইবে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য।
Such great website
Amazing blog thanks for sharing today on this blog