বহরমপুরে গান্ধী মূর্তির পাদদেশ ঘিরে ফেলা নিয়ে প্রতিবাদের ঝড়

পূর্বাঞ্চল নিউজ ডেস্ক : মুর্শিদাবাদ জেলা প্রশাসনিক ভবনের বিপরীতে রাস্তার পাশে গান্ধী মূর্তি।মূর্তি স্থাপনের পর থেকেই সেই জায়গাটি উন্মুক্ত ছিলো। মানুষের অধিকার আন্দোলন থেকে অনশন সবটাই যেখানেই করা হতো। যেহেতু জায়গাটা জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে তাই প্রতিটি লড়াই, আন্দোলন,ধরনা সেখানেই হতো। কিন্তু এই সময় পর্বে বহরমপুরে জলাভূমি রক্ষা কমিটির অনশন উঠিয়ে দেওয়ার পর গান্ধী মূর্তির পাদদেশ বাঁশ দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে।পূর্বাঞ্চলের পক্ষে থেকে জেলার বিশিষ্ট শিক্ষক, সাহিত্যিক,মানবাধিকার কর্মী,সাংবাদিক,নাট্যকর্মী, রাজনৈতিক কর্মীদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদের মতামত নেওয়া হয়।
নির্মল সরকার( অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও পরিবেশ আন্দোলন কর্মী) :মুর্শিদাবাদ জেলার প্রশাসনিক ভবনের দক্ষিনে এবং গান্ধী মূর্তির পাদদেশে গত সাতাশে মার্চ জলাভূমি রক্ষা কমিটির অনশন অবস্থানে অংশগ্রহণকারীদের গ্রেপ্তার করে থানায় আনার পর সন্ধ্যার সময় মঞ্চটি রাত্রের মধ্যে ভেঙে দেওয়া হয়। পরে দেখা গেল ওই এলাকাটা বাঁশ দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে যাতে আগামী দিনে কেউ আন্দোলন না করতে পারে ওই জায়গা থেকে। গণতান্ত্রিক দেশে এটাই স্বাভাবিক যে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রশাসনিক ভবন বা দপ্তরের নিকটস্থ কোন জায়গায় আন্দোলনকারীরা তাদের দাবি জানায়। দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সরকারের নিকট। এতে প্রশাসনিক কাজের ব্যাঘাত ভয় বলে মনে করিনা। স্থায়ীভাবে জায়গাটা ফিরে দেওয়া শুধু অশোভনীয় নয় অগণতান্ত্রিক ও জনস্বার্থ বিরোধী বলে মনে করি।
অনল আবেদিন ( বিশিষ্ট সাংবাদিক) : জলাভূমি রক্ষা কমিটির গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে প্রশাসনের স্বাগত জানানো উচিত ছিলো।এবং যারা জলাভূমি ভরাট করে অবৈধ নির্মাণ কার্য করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিলো। সেটা না করে প্রশাসন জলাভূমি রক্ষা কমিটির নিরস্ত্র, নিরীহ, ও নিরুপায় মানুষগুলোকে সরকার ও প্রশাসন খুব ভয় পেল। তাঁদেরকে রাষ্ট্রের ভয়ানক শত্রু মনে করতে শুরু করল এবং বহরমপুর মহকুমাশাসক শতাধিক পুলিশ নিয়ে এসে গ্রেফতার করলেন অশক্ত, শারীরিক ভাবে অক্ষম, বয়ঃবৃদ্ধ অনশনকারীদের। তারপর জাতির জনক মহাত্মাজিকে নাকাবন্দি করে, বাঁশখুঁটির খোয়াড়ে অনশনস্থল ঘিরে দিল প্রশাসন। তা দেখে মনে পড়ছে ১৯৭৬ সালে দমবন্ধ করা জরুরি অবস্থার সময়ে মনোজ মিত্রের নাটক ‘নরক গুলজার’- এর জন্য বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব দেবাশিস দাশগুপ্তের লেখা সেই কালজয়ী গান, “কথা বোলো না, কেউ শব্দ কোরো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলযোগ সইতে পারন না…!!!”
মিলন মালাকার (মানবাধিকার কর্মী) :গত ২৭ অক্টোবর বহরমপুরে জেলা প্রশাসনিক ভবনের সামনে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে জলসেনারা বসেছিলেন। প্রায় শব্দহীন। চেয়েছিলেন, জলাভূমি ভরাট বন্ধ কর, মজে যাওয়া বা ভরাট হয়ে যাওয়া জলাশয়কে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দাও, জল ভালো রাখ। পুলিশ তুলে দিল বলতে গেলে গোড়াতেই। তারপর ভেঙে দিল অস্থায়ী শিবির। ঘিরে দিল বাঁশ দিয়ে জায়গাটা। আর কাউকেই ওখানে বসতে দেবে না, জমতে দেবে না। প্রশাসনকে শত কণ্ঠে বিক্ষোভ বার্তা শোনানোর আর জায়গা থাকল কই? জেলায়, জেলা সদরে? বিরোধীদের বলতে দেওয়া যে গণতন্ত্রের সর্ত। মরমে মরে যাই। রাগ রাখি কোথায়? এ কেমন শাসক! জনাদেশ মানে বলে শোনায় কেবল ভোটের সময়। অন্য সময় সে শুধুই শাসক!
ডঃ নজরুল ইসলাম (প্রাক্তন আই জি ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক): বিষয়টি আমি ঠিক জানিনা।তবে এইটুকু বলতে পারি, দেশের সর্বচ্চ আদালতও বলেছে নাগরিকদের প্রতিবাদ করার অধিকার আছে।প্রতিবাদ বন্ধ করে দিতে না পারে তার জন্য তারা (দিল্লিতে যেমন বোট ক্লাবে,কলকাতায় আর আর এভিনিউ) জায়গা ঠিক করে দিয়েছে।এখন জেলার ক্ষেত্রে যদি নিদিষ্ট স্থান ঠিক না করে দিয়ে, যে জায়গায় মানুষ প্রতিবাদ করছে সেই জায়গাকে ঘিরে দিলে মানুষের প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করে দেওয়া হচ্ছে বলে মনে হবে।
দীপক বিশ্বাস (নাট্যকর্মী): দীর্ঘদিন থেকে দেখে আসছি গান্ধী মূর্তির পাদদেশ হলো এমন একটা জায়গা যেখানে প্রতিবাদ নির্গত হবার প্রতীকী ক্ষেত্র। সেটাকে অবরুদ্ধ করার অর্থ হলো কন্ঠকে স্তব্ধ করার প্রচেষ্টা। এও এক ফ্যাসিস্ট নিদর্শন। কোন প্রতিবাদী কন্ঠস্বর রাখবো না। হতে পারতো জলাভূমি রক্ষা কমিটির অনশন- অবস্হান তুলে দেওয়া। কিন্তু ঘিরে দিয়ে কাউকেই ওখানে কোন অনুষ্ঠান না-করতে অর্থ ফ্যাসিস্ট ক্ষমতা প্রদর্শন। দল মত নির্বিশেষে গর্জে ওঠা উচিত।
ডাঃ আলি হাসান (সামাজকর্মী ও বিশিষ্ট চিকিৎসক): পরিবেশ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদ জেলার প্রশাসন ভবনের সামনে গান্ধী মূর্তির পাদদেশকে ঘিরে ফেলা চরম অন্যায় কাজ।এই ভাবে কোন আন্দোলনকে আঁটকে রাখা যায়না। একজন নাগরিকের আন্দোলন, অনশন করার অধিকার আছে।এই ভাবে গান্ধী মূর্তির পাদদেশ ঘিরে ফেলে কোন গণআন্দোলনকে আঁটকে রাখা যায়না। প্রশাসনের এই কাজের তীব্র নিন্দা করছি।
বিপ্লব বিশ্বাস (সম্পাদক,মুর্শিদাবাদ জেলা সাংবাদিক সংঘ): গান্ধী মূর্তির পাদদেশ ঘিরে দেওয়া চরম অন্যায় কাজ।এখানে সরকার বা প্রশাসনের আপত্তি কিসের?গান্ধী মূর্তির সামনে অনশন আন্দোলন করবেনা তো কোথায় করবে?মহাত্মা গান্ধীই ভারতবর্ষের আন্দোলন, অনশনের প্রতীক।এই কাজের তীব্র নিন্দা করছি।
মুর্শিদা খাতুন( শিক্ষাবিদ): এই সময় পর্বে দেখছি যে কোন প্রতিবাদ আন্দোলন তৈরি হলেই প্রথমেই সরকারি ভাবে কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে।জলাভূমি রক্ষা কমিটির আন্দোলন উঠিয়ে দিয়ে সেই জায়গাটা বাঁশ দিয়ে ঘিরে ফেলা গণতান্ত্রিক অধিকারের কণ্ঠরোধের চাক্ষুস প্রমাণ।এই ব্যারিকেড এটাই প্রমাণ করছে, যে কোন ধরনের আন্দোলন করতে গেলে এই ধরনের প্রতীকের সম্মুখীন হতে হবে।
প্রমথেশ মুখার্জি (অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রাক্তন সাংসদ):এটা চরম অন্যায় কাজ।মানুষের গণতান্ত্রিক কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করছে এই সরকার।
জিনাত রেহানা ইসলাম ( শিক্ষিকা ও নারী অধিকার রক্ষা আন্দোলনের কর্মী): ওই জায়গাটা ঘিরে দেওয়ার পিছুনে দুটি কারণ হতে পারে।এক, আমি যেখানে কমব্যাট করতে পারবোনা। আর দুই, আমার ইচ্ছা।আমার ইচ্ছা তাই আমি ওই জায়গায় আন্দোলন করতে দেবোনা। তাহলে সরকার বা রাষ্ট্রের ইচ্ছের উপর যদি অধিকার আন্দোলন থেমে থাকে তবে সেটা মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়।
দেবজ্যোতি বিশ্বাস (শিক্ষক): প্রশাসনিক ভবনের সামনে কেন সভা সমিতি করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো , জানিনা। অতীতে ঐ স্থানে বহু সভা হয়েছে। তাতে কোনও অসুবিধা হয়েছে বলে জানা নেই। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন এ আঘাত হানতে গিয়ে সরকার এই যে সিদ্ধান্ত নিলো তা প্রশসনের মুখেই চুনকালি দিল।
নৃপেন চৌধুরী (সম্পাদক, মুর্শিদাবাদ জেলা সিপিআইএম) :মানুষের একটা সুযোগ ছিলো একজন ব্যক্তিত্বের মূর্তির সামনে প্রতিবাদ, অনশন করার। সেটা আর থাকলো না।এই কাজটি যে বা যারা করেছেন ঠিক করেননি।
জয়ন্ত দাস(মুখপাত্র,মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস) :ভারতবর্ষের লড়াই, অহিংস আন্দোলনের প্রতীক গান্ধীজি।বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু যারা যারা গান্ধীজি কে ভালোবাসেন সকলে লড়াই,আন্দোলন শুরু করেন গান্ধী মূর্তির পাদদেশ থেকে।বর্তমান মহকুমা শাসক ক্ষনিকের পরিযায়ী পাখি। তিনি এই জেলার ভূমিপুত্রও নয়, এই জেলা সম্পর্কে কোন ধারণাও নেই।ফলে ওই জায়গাটার প্রতি যে আবেগ,ওই জায়গার প্রতি চেতনার তাঁর নেই।ওই জায়গাটি ঘিরে ফেলা গণতান্ত্রিক মানুষের কণ্ঠরোধ করা ছাড়া আর কিছুই নয়।জলাভূমি রক্ষা কমিটি যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলো, প্রশাসনের উচিত ছিলো সেই দাবিকে স্বাগত জানিয়ে সেই দাবি পূরণ করা।কিন্তু প্রশাসন সেটার পরিবর্তে আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করল এবং যাতে কোন ওই জায়গায় আন্দোলন করতে না পারে তার জন্য জায়গাটা ঘিরে ফেললো। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়।
রাজিব রায় ( আইনজীবী ও জেলা সম্পাদক সিপিআইএমএল লিবারেশন): মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে এই ভাবে আঁটকে রাখা যায় না। মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ বহুদিন ধরেই গান্ধী মূর্তির পাদদেশে আন্দোলন অনশন করে আসছে।অতীতের NRC, CAA আন্দোলন থেকে আজকের জলাভূমি রক্ষার আন্দোলন হয়েছে।প্রশাসনের উচিত বাঁশ দিয়ে ঘিরে ফেলা জায়গাটি পুনরায় উন্মুক্ত করে দেওয়া।এই কাজের আমরা তীব্র নিন্দা করছি।
বিভাষ চক্রবর্তী (মুর্শিদাবাদ জেলা সম্পাদক ফরোয়ার্ড ব্লক) :এই ভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করা যায় না।কিন্তু বর্তমান সরকার এই ভাবেই প্রতিটি সভা, সমিতি, আন্দোলনকে আঁটকিয়ে রাখতে চাইছে। কোন বিরোধী মতকে তারা রাখতে চাইছে না।এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় বিষয়।