পাপিয়া মাণ্ডির পাশে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ

পূর্বাঞ্চল নিউজ ডেস্ক
পাপিয়া মাণ্ডির লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে ২১ ডিসেম্বর ২০২১ রাজ্যের কয়েকটি জায়গায় বিক্ষোভ কর্মসূচী সংগঠিত হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং ও চন্দ্রকোনা, পূর্ব বর্ধমানে বোহার গদাইতলা বাজার, হুগলির ধনেখালি বিডিও অফিস এবং কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে প্রতিবাদী কর্মসূচী সংগঠিত হয়। পাপিয়া মাণ্ডির পাশে দাঁড়িয়ে জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সুবিচারের জোরালো আওয়াজ তোলা হয়।
মূল বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচীটি ছিল সবংএ। ভারত জাকাত মাঝি পারগাণা মহল (ভাজামাপাম) সবং ও পিংলা মুলুকের ডাকে সবং তেমাথানি মোড়ে কয়েকশ আদিবাসী নরনারী প্রথাগত পোশাকে, তুমদাঃ-টামাক্ ও ঘরোয়া অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে জমায়েত হন এবং প্রতীকী বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে প্রকৃতি আরাধনা করে এক সুশৃঙ্খল মিছিল সমগ্র এলাকা পরিক্রমা করে সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যলয়ের দরজায় হাজির হয়। দরজা বন্ধ দেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন সকলে, বিশেষত মহিলারা। কলেজের সামনে ব্যাস্ত হাইরোড অবরোধ করে বসে পড়েন সবাই। বিশাল পুলিশ বাহিনী দফায় দফায় আলোচনা চালায় নেতৃত্বের সাথে। প্রায় ৪৫ মিনিট অবরোধ চালিয়ে রাস্তা জুড়ে মিছিল করে ফিরে আসা হয় তেমাথানি সভাস্থলে। সভা চলে সন্ধ্যা অবধি। প্রথমে বক্তব্য রাখেন ফুলো-ঝানো তিরলো গাঁওতার নেত্রী স্বরস্বতী হাঁসদা ও সব শেষ বক্তা ছিলেন পাপিয়া মাণ্ডির ছোট ভাই পূর্ণেন্দু মাণ্ডি। তার মাঝে একে একে বক্তব্য রাখেন বিক্ষোভ কর্মসূচীর অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা মিঠুন মুর্মু, বাবলু হাঁসদা, সনাতন হেমব্রম, বিশ্বনাথ হেমব্রম, মনোরঞ্জন মুর্মু, রবি সিং সহ বিভিন্ন নেতৃত্বস্থানীয় পারগাণা মহল। আমন্ত্রিতদের মধ্যে থেকে বক্তব্য রাখেন মলয় তেওয়ারি ও ডিডি মুর্মু। সভাস্থল ও মিছিলকে শ্লোগানে উজ্জীবিত রেখেছিলেন পিংলা মুলুকের গোডেৎ পারগানা বিজয় হেমরম ও করকাই পিড় জগ পারগানা কুমার কিসকু। সভা পরিচালনা করেন খড়গপুর তল্লাটের গোডেৎ পারগানা অলোক বেসরা। আদিবাসী সমাজের মানুষেরা ছাড়াও বহু সাধারণ মানুষ আগ্রহভরে সভায় অংশ নেয় এবং মিছিলের সময়ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সমর্থন লক্ষ্য করা যায়।
তেমাথানীর সভায় বক্তারা যে বিষয়গুলি তুলে ধরেন সেগুলি খুব সংক্ষেপে নিম্নরূপ:
অধ্যাপিকা পাপিয়া মাণ্ডি অনেক দিন ধরে বিভিন্নভাবে হেনস্থা ও অবমানিত হয়েছেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি রুখে দাঁড়িয়ে লিখিত অভিযোগ জানানোর পর থেকে প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু হয়। ভাজামাপাম সবং মুলুকে আন্দোলন শুরু করে। এফআইআর দায়ের হয়। ধারাবাহিক চাপ তৈরী করার ফলে ছোট ছোট জয় আসে। ছুটির পর পাপিয়া মাণ্ডিকে কলেজে বিধিবদ্ধভাবে পুনরায় জয়েন করতে যে বাধা দিচ্ছিল অধ্যক্ষ, তা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এবং এবার অভিযুক্ত অধ্যাপককে সাসপেণ্ডও করেন তিনি। কিন্তু অধ্যক্ষ নিজেই তো একই অভিযোগে অভিযুক্ত। ওই অধ্যাপকের মতই পোয়া আইনের একই ধারাগুলিতে অধ্যক্ষও অভিযুক্ত। তাহলে অধ্যক্ষকে সাসপেণ্ড করা হচ্ছে না কেন? অধ্যক্ষকে সাসপেণ্ড করে স্বচ্ছ তদন্ত ও সুবিচার পাওয়ার লড়াই চলবে। কলেজের জিবির সভাপতি তথা এলাকার বিধায়ক ও মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া কোন অধিকারে বলতে পারেন যে পাপিয়াকে কেউ অপমান করে নি? তিনি অপরাধীদের আড়াল করতে নামলে তাঁকেও ছেড়ে দেওয়া হবে না। সবে তো কান ধরে টান দেওয়া হয়েছে, এবার মাথা আসবে। সবে ট্রেলার চলছে, পুরো সিনেমা এখনও বাকি আছে। আন্দোলনের নির্দিষ্ট প্রশ্নে এইসব বিষয়গুলির সাথে সাথে বক্তাদের কথায় উঠে আসে এই সমাজে আদিবাসীদের ওপর চলা সুব্যবস্থিত ব্যবস্থাগত বৈষম্য ও অবমাননার নানা দিক। আদিবাসীদের খাটো করে দেখানো ও আদিবাসীদের আত্মপরিচিতিকে হেয় প্রতিপন্ন করার মানসিকতাকে ধিক্কার জানিয়ে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরিখে আদিবাসীদের গৌরবময় ইতিহাস ও প্রথাকে তুলে ধরা হয়। সভ্যতার আদি বনিয়াদের ধারক হিসেবে আদিবাসীদের ইতিহাস উঠে আসে। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীদের সর্বাগ্রগামী গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কথা উঠে আসে। এবং বর্তমান জলবায়ু সংকটের পরিস্থিতিতে ধরতি মাতাকে বাঁচাতে প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে জীবনকে বোঝা ও প্রকৃতি আরাধনায় আদিবাসী ঐতিহ্য থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা আসে। সব মিলিয়ে লড়াইয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার ও আত্মবিশ্বাস নিয়ে সবংএর সভা সমাপ্ত হয়। এছাড়া ভাজামাপামের ডাকে চন্দ্রকোনাতে পথ অবরোধ চলে। কর্মসূচীগুলির আগে দুদিন ধরে বিস্তীর্ণ এলাকায় অটো-মাইক প্রচার করা হয়।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অল ইণ্ডিয়া স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (আইসা) প্রতিবাদসভার ডাক দিয়েছিল। এই পর্বে পাপিয়া মাণ্ডির লড়াইয়ের বিষয়টি তুলে ধরে দুটি প্রচারপত্র বিলি হয়। আইসার পক্ষে বর্ষা বড়াল, রুদ্র প্রভাকর দাস ও সৈকত, সারা ভারত প্রগতিশীল মহিলা সমিতির পক্ষে চন্দ্রাস্মিতা চৌধুরি, ক্যুয়ার/ট্রান্স/ফেমিনিস্ট ফেবুলেশনের উদ্দীপ্ত, প্রাক্তন অধ্যাপক অমিত দাশগুপ্ত সহ বিভিন্ন বক্তারা এরাজ্যের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এসসি-এসটিদের ওপর চলা বিভিন্নরূপ বৈষম্য ও অপমানের কথা তুলে ধরেন। বিভিন্ন আদিবাসি জাতির ভাষাগুলির প্রতি সরকারি বঞ্চনার কথা উঠে আসে। সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতিবিদ্বেষ মোকাবিলায় “রোহিথ আইন” প্রণয়নের দাবি তোলা হয়। সভাটি পরিচালনা করেন সায়নি। প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী অনুপম রায় বড় ক্যানভাসে সভার প্রেক্ষাপট এঁকে দেন। সমবেত সঙ্গীতের মধ্যে দিয়ে রোহিথ বেমুলাকে স্মরণ করে এবং সুবিচারের লড়াই চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে প্রতিবাদসভা সমাপ্ত হয়।
পূর্ব বর্ধমানের বোহার গদাইতলা বাজারে অল্প সময়ের জন্য পথ অবরোধ করে তারপর প্রতিবাদ সভা সংগঠিত করে দিশম আদিবাসী সুসৌর গাঁওতা ও ফুলোঝানো সাঁওতা সুসৌর গাঁওতা। মেমারি২ ও কালনা ব্লকের নেতৃত্ব বিপিন মাণ্ডি, সনাতন হাঁসদা, দিলীপ হাঁসদা ও রাজ্য সভাপতি লবান হাঁসদা সহ কর্মীসমর্থকেরা অংশ নেন। প্রতিবাদী সভা বাজারের বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। লবান হাঁসদা বলেন, অধ্যাপক, স্কুল শিক্ষক হোন বা সরকারী কর্মচারী — সর্বত্র আদিবাসীকে বহুবিধ হয়রানি, হেনস্থা ও অপমান সহ্য করতে হচ্ছে কেন? এরাজ্যে পরপর এরকম ঘটনা সামনে আসছে। অবিলম্বে সবং কলেজের দুই অপরাধী অধ্যক্ষ তপন দত্ত ও অধ্যাপক নির্মল বেরাকে গ্রেপ্তার ও বহিস্কারের দাবি তুলে ধরা হয়। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে বিষয়টি পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানানো হয়। জাতিবিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইএর আহ্বান নিয়ে সভা সমাপ্ত হয়।
হুগলির ধনেখালি ব্লকে “আদিবাসী অধিকার ও বিকাশ মঞ্চ” সুপরিচিত সংগঠন। হাসা-ভাষা-লায়লাকচার প্রশ্নে ও গরিব শ্রমজীবি আদিবাসীদের কাজ ও মজুরির প্রশ্নে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন তাঁরা। ২১ ডিসেম্বর তাঁরা বিডিও অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখান পাপিয়া মাণ্ডির জন্য সুবিচার চেয়ে। প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারে দাবিগুলি তুলে ধরে শ্লোগান ও বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সমগ্র বিষয়টি মানুষের মাঝে তুলে ধরা হয়।
এই সবক’টি কর্মসূচী পারস্পরিক কথাবার্তার ভিত্তিতে একইদিনে সংগঠিত করা হয়েছিল জাতিবিদ্বেষ ও আদিবাসী বিদ্বেষের বিরুদ্ধে সর্বস্তরে ঐক্যের বার্তা দিতে এবং পাপিয়া মাণ্ডির পাশে দাঁড়িয়ে এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এই সমস্ত প্রতিবাদ সভাগুলি থেকে পাপিয়া মাণ্ডিকে অভিনন্দন জানানো হয় দৃঢ়ভাবে তাঁর রুখে দাঁড়ানোর জন্য। বহু ক্ষেত্রেই এই দৈনন্দিন অপমানগুলি অনেকেই মুখ বুজে সহ্য করে নেন। পাপিয়ার লড়াই তাঁদের প্রতিবাদ করতে সাহস জোগাবে। ইতিমধ্যেই ওই সবং কলেজেরই আরও একজন অধ্যাপিকা, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সম্পা পাত্র, অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন তাঁর ওপর চলা দীর্ঘ দৈনন্দিন হয়রানির বর্ণনা দিয়ে।
জেলা আদালতের বিশেষ বেঞ্চে পাপিয়া মাণ্ডির জন্য সুবিচারের আইনি লড়াই শুরু হয়েছে। আন্দোলনের ফলে প্রশাসনও কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে। আগামি ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ আদালতে শুনানি আছে। মন্ত্রী ও বিদ্যমান ক্ষমতাতন্ত্রের সমস্ত বাধাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এই লড়াই আরও বহু মানুষকে জাতিবিদ্বেষ ও আদিবাসী-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করুক এবং হাসা-ভাষা, লায়-লাকচার, অরণ্যের অধিকার ও পঞ্চম তপশিল সহ সংবিধানস্বীকৃত স্বায়ত্তশাসনের বুনিয়াদি প্রশ্নগুলিকে জোরালোভাবে সামনে আনুক।