• March 26, 2023

ফিরে দেখা নারায়ণ দেবনাথ

 ফিরে দেখা নারায়ণ দেবনাথ

স্বপ্ননীল মুখার্জী

মানুষ যত বড় হয় ততই সে যেন তার সেই উপলব্ধির স্তরে গিয়ে পৌঁছায় যেখানে দাঁড়িয়ে সে তার অতীতকে দেখতে শুরু করে। অতীতের মরকে সেই স্মৃতিগুলোই থেকে যায় যেগুলো মস্তিষ্কে এবং হৃদয়ে উভয় জায়গাতেই দাগ কাটে। আজ সেরকমই এক ব্যক্তিত্বের মৃত্যু দিন যিনি প্রতিটি কিশোরের ছোটবেলাকে একাধিক চরিত্র উপহার দিয়েছেন। কখনো তিনি বাটুলের মত ব্যায়ামবীর, বলশালী চরিত্রকে দিয়ে শত্রু সংহারের মতো অদ্ভুত মজার চিত্র বানিয়েছেন, কখনো নন্টে ফন্টে কেল্টু দার খুনসুটি দুষ্টুমির মতো সম্পর্ককে ফুটিয়ে তুলছেন ছবির মাধ্যমে। হ্যাঁ,সেই নারায়ন দেবনাথ এরই মৃত্যু হলো কাল।
নারায়ণ দেবনাথের পরিবার ওপার বাংলার মানুষ হলেও নারায়ণ দেবনাথের জন্ম তাদের শিবপুরের বাড়িতে, তাঁর বাবা কাকার ছিল গয়নার দোকান, বাবা কাকার গয়নার ডিজাইন তৈরি করার প্রক্রিয়া, তার মনে ছবি আঁকার স্পৃহা তৈরি করে। পরবর্তীকালে তিনি ‘ইন্ডিয়ান আর্ট কলেজে’ ছবি নিয়ে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হন। এসবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর ঘটনা। তিরিশ চল্লিশের দশকে আঁকার জিনিসপত্র এত সস্তা ছিল না, সেই সময়ে পেইন্টিংয়ের স্থায়ী রোজগার বলতেও তেমন কিছু ছিল না, স্থায়ী রোজগার সূত্রেও ইলাস্ট্রেশন বইয়ের প্রচ্ছদ ইত্যাদি কাজের শুরু এবং সেই সূত্রেই ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর সাথে তার যোগাযোগ এর সূত্রপাত হয়। শুকতারা তিনি নিয়মিত কাজ দিতে শুরু করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তখন সমাজ জীবনের মোড় একটু একটু করে অন্যদিকে ঘুরছে। তাঁর সমসাময়িক অনেক শিল্পী ইলাস্ট্রেটররা ততদিনে এসে গিয়েছেন। তাঁর সিনিয়রদের মধ্যে প্রতুল চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, বলাইবন্ধু রায়, শৈল চক্রবর্তী, রেবতীভূষণ ঘোষ এঁরা সবাই ছিলেন। নারায়ণ দেবনাথ নিজে একটা পৃথক ধারা তৈরি করে নিয়েছিলেন। প্রতুলবাবু নিজে উনাকে নানাভাবে গাইড করতেন। দেশি-বিদেশি ছবি, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদি বিভিন্ন কিছু দেখাতেন। শুকতারার সম্পাদকমন্ডলী ক্ষিতীশ মজুমদারও তাঁকে যথেষ্ট উৎসাহ দিতেন।
নারায়ণ দেবনাথ এর ইলাস্ট্রেশন ছিল বহুমুখী ধারার অধিকারী। কখনো হাসি কখনো গুরুগম্ভীর ছবি,যেটা ওই সময়ে দাঁড়িয়ে আর কেউ আঁকতেন না। ১৯৬০ এর দশকে ‘বনে-জঙ্গলে’ বলে যে বইটি বেরিয়েছিল তার ইলাস্ট্রেশন ভীষণ খুঁটিয়ে এঁকেছিলেন তিনি। যেকোনো ছবিকে ভীষণ আকর্ষণীয় আর বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দিকে তার নজর থাকতো সারাক্ষণ। সে কারণে তাঁর আঁকাও খুব শক্তিশালী ছিল। এইসবই উনি ধীরে ধীরে অভ্যাস করেছিলেন। আঁকার ক্ষেত্রে স্থান কাল পাত্র চরিত্র তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি নির্ভুলভাবে দেখানোর ওপর খুবই জোর দিতেন তিনি। তিনি নিজেই বলেছেন আমি চেষ্টা করতাম সঠিক রেফারেন্স খুঁজে বার করতে প্রয়োজনে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে জাতীয় গ্রন্থাগার পর্যন্ত পড়তেন ষাটের দশকের গোড়ায় ইলাস্ট্রেশনের পাশাপাশি শুকতারা পত্রিকার সম্পাদক তাকে বলেন কমিকস শুরু করতে সেই কথা মতন 1962 সালে হাঁদা আর ভোঁদা এদুটো চরিত্র নিয়ে শুরু করেননি তিনি এ বিষয়ে তার কোন প্রস্তুতি ছিল না মজার ব্যাপার একজন বাদে দেশে-বিদেশের কমিকস খুব একটা দেখতে এমন নয় তাও কমিকসের কাজ শুরু করে এই ক্ষেত্রটিকে উনি খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন শিবপুরে একটু ঘিঞ্জি এলাকায় তার বাড়ি ছিল চারপাশে দোকানপাট লোকজন তিনি খুব ছোটবেলা থেকেই বসে বসে দেখতেন সেই সব চরিত্রদের নিজেদের মধ্যে সারাক্ষণ ঠাট্টা-তামাশা করত। নারায়ন দেবনাথ এর ইলাস্ট্রেশন ছিল বহুমুখী ধারার অধিকারী। কখনো হাসি কখনো গুরুগম্ভীর ছবি,যেটা ওই সময়ে দাঁড়িয়ে আর কেউ আঁকতেন না। ১৯৬০ এর দশকে ‘বনে-জঙ্গলে’ বলে যে বইটি বেরিয়েছিল তার ইলাস্ট্রেশন ভীষণ খুঁটিয়ে এঁকেছিলেন তিনি। যেকোনো ছবিকে ভীষণ আকর্ষণীয় আর বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার দিকে তার নজর থাকতো সারাক্ষণ। সে কারণে তাঁর আঁকাও খুব শক্তিশালী ছিল। এইসবই উনি ধীরে ধীরে অভ্যাস করেছিলেন। আঁকার ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্র-চরিত্র তাদের পোশাক পরিচ্ছদ ইত্যাদি নির্ভুলভাবে দেখানোর ওপর খুবই জোর দিতেন তিনি। তিনি নিজেই বলেছেন, “আমি চেষ্টা করতাম সঠিক রেফারেন্স খুঁজে বার করতে।” প্রয়োজনে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে জাতীয় গ্রন্থাগার পর্যন্ত দৌড়তেন। ষাটের দশকের গোড়ায় শুকতারা পত্রিকার সম্পাদক তাঁকে ইলাস্ট্রেশনের পাশাপাশি কমিকস শুরু করতে বলেন। সেই কথা মতন ১৯৬২ সালে হাঁদা আর ভোঁদা এদুটো চরিত্র নিয়ে শুকতারা পত্রিকায় কাজ শুরু করেন তিনি। এ বিষয়ে তাঁর কোন প্রস্তুতি ছিল না, মজার ব্যাপার এক টারজান বাদে দেশে-বিদেশের কমিকসও যে খুব একটা তিনি দেখতেন এমন নয়। তাও কমিকসের কাজ শুরু করে এই ক্ষেত্রটিকে তিনি খুব তাড়াতাড়ি আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন। শিবপুরে একটু ঘিঞ্জি এলাকায় তাঁর বাড়ি ছিল। তিনি খুব ছোটবেলা থেকেই চারপাশের দোকানপাট লোকজনদের দেখতেন এবং সেই সব চরিত্রদের নিজেদের মধ্যে ঠাট্টা-তামাশা লক্ষ করতেন। সে সব থেকেই হাঁদা-ভোঁদার গল্পের প্লট তৈরি করলেন তিনি। লোকে হাঁদা-ভোঁদা চরিত্র দু’টিকে ভালোবেসে ফেলল। এরপর ১৯৬৫ সাল নাগাদ উনি বাঁটুল দি গ্রেট চরিত্রটি নিয়ে আরও একটি কমিকস শুরু করেন। নতুন একটি চরিত্র, ব্যায়ামবীর মার্কা বাঁটুলের কীর্তিকলাপ পাঠকদের মন কারে। এরপর ‘কিশোর ভারতী’ তাঁর কাছে কমিকস চাইলো নিজেদের জন্য। তখন উনি হাঁদা-ভোঁদার আদলে বানালেন নন্টে-ফন্টে। আদল এক রেখে গল্পগুলি একটু অন্য রকম করে তৈরি হলো নন্টে-ফন্টে। পরের দিকে আরো অনেক কমিকস বানিয়েছিলেন তিনি, তার মধ্যে অন্যতম ‘বাহাদুর বিড়াল’, ‘ডানপিটে খাঁদু ও তার কেমিক্যাল দাদু’, ‘গোয়েন্দা কৌশিক’। এত কমিকস করতে গিয়ে ইলাস্ট্রেশন ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে।
প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি টানা কমিকস করেছেন। এ এক বিশ্বরেকর্ড। সম্ভবত এমন কাজ আর কোনো দেশের চিত্রশিল্পী করেননি। অত্যন্ত সরল সাধাসিধে মানুষ কোনো রকম উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না যার। দেব সাহিত্য কুটিরে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেছেন। কোনোদিনই সেভাবে স্থায়ী চাকরি করেন নি তিনি। এর ফলে একটা সময়ে আর্থিক ভাবে বেশ অসুবিধায় পড়েছিলেন তিনি। তাও নব্বই দশকে যখন আনন্দবাজার থেকে ওখানে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন,রাজি হন নি। অনেকেই তাকে ঐতিহাসিক ভুল বললেন,তিনি তেমন গায়ে মাখেননি সেসব। দুঃখের কথা যে,তাঁর মতো মানী ব্যক্তির যোগ্য সম্মান পেতে অনেকটা দেরি হয়েছিল। আজ তাঁর মৃত্যু সাহিত্য তথা বাংলার কমিকস জগতে এক গভীর ক্ষতর সৃষ্টি করবে কিন্তু তাঁর সৃষ্টি আগামী প্রজন্মের কাছে দিশা হয়ে থেকে যাবে।

স্বপ্ননীল মুখার্জী ঃ রাজনৈতিক কর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published.