মালদায় মৈথিল জনজাতির সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা পত্র

বাপি সিংহ
মালদা জেলার মৈথিল জনজাতির সংস্কৃতির ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা পত্র আন্তর্জাতিক সেমিনারে উপস্থাপনা করেন বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক ঋষি ঘোষ ও সৌমেন্দু রায। বিহার- ঝাড়খণ্ড সহ মিথিলাঞ্চলের সর্বভারতীয় মৈথিল ঐতিহ্যের সঙ্গে মালদা জেলায় বসবাসকারী মৈথিলদের মধ্যে সংস্কৃতি মেলবন্ধনের দিক গুলি তুলে ধরেছেন এই গবেষণার মধ্যে।
মালদা জেলায় বসবাসকারী মৈথিল জনজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে তাদের গবেষণা পত্রটি উপস্থাপিত হয় জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালে।
২০২১ সালের ২০ জুলাই জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন সেন্টারে অনলাইনে সৌমেন্দু রায় ও অধ্যাপক ঋষি ঘোষ গবেষণাপত্রটি উপস্থাপন করেছেন। গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিভাগের কর্মী সৌমেন্দু মৈথিল জনজাতি নিয়ে তথ্যমূলক গবেষণা করে চলেছেন দীর্ঘদিন।কম্পিউটার সায়েন্স,ম্যানেজমেন্ট এবং লাইব্রেরি সায়েন্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী সৌমেন্দু বাবু । অধ্যাপক ঋষি ঘোষ, গৌড় কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।
গবেষণাপত্রে তাঁরা তুলে ধরেছেন, মালদা জেলার মানিকচক, মোথাবাড়ি রতুয়া ও চাঁচলে মৈথিল জনজাতির বসবাস। মালদা জেলার মানিকচকের ধরমপুর রঘুনাথপুর, নাজিরপুর, মথুরাপুর লালবাথানি, আড়াইডাঙা, রতুয়ার কাহালা দেবীপুর একবর্না, আড়াইডাঙ্গা, সিমলা, বাহারাল,মোথাবাড়ির বাঙ্গীটোলা, দুর্লভপুর,মেহেরাপুর, বালুচর রথবাড়ি ,হারিয়াঘর, ইংলিশবাজারের শোভানগর নগরিয়া ফুলবাড়িয়া মিল্কি, সহ শতাধিক গ্রামে মৈথিলরা বংশ পরম্পরায় বসবাস করেন । তাঁদের অধিকাংশই সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে এদের বেশির ভাগ শহরে বসবাস করেন। অতীত থেকেই জেলার গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও প্রশাসনিক জায়গাতে তাদের আধিপত্য ছিলো। নেতাজির আপ্ত সহায়ক মানিক ঝা, রাজনীতিবিদ ও সমাজসেবী অতুলচন্দ্র কুমার, পশুপতি ঝা বা মনোরঞ্জন মিশ্রর অনবদ্য অবদান এই গবেষণায় উঠে এসেছে। মালদার রূপকার এ বি এ গনি খান চৌধুরী তার রাজনৈতিক জীবনে প্রথমদিকে বাঙ্গীটোলা গ্রামের বাসিন্দা মনোরঞ্জন মিশ্রর কাছে ভোটে পরাজয়ের কাহিনী অনেকেরই অজানা। এছাড়াও
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির বিভাগীয় প্রধান শিবরঞ্জন মিশ্র, বিশিষ্ট চিকিৎসক মনোজ ঝা,দীপক ঝা বা দুলাল কুমার, বিশিষ্ট আইনজীবী তড়িৎ ওঝা-এই তালিকা অনেক দীর্ঘ। কিন্তু তারা সকলেই ঐতিহ্যের প্রতি সচেতন। পূজা-পার্বন ও উৎসব উপলক্ষে তারা সমবেত হয়ে উদযাপন করেন।গবেষণায় উল্লেখ রয়েছে বিহার এবং সংলগ্ন অঞ্চল থেকে মৈথিল ব্রাহ্মণদের গঙ্গার তীর ধরে মালদা সহ পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় সরে আসার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ আছে।
এই মাইগ্রেশনের ফলে তাঁরা লোকাচার, সামাজিক রীতি,বিবাহগীত,পূজা-পার্বন সবকিছুকেই ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন।অনেকক্ষেত্রে বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়ে তা এক নতুন চেহারা পেয়েছে।সেই চেহারা মৈথিল সংস্কৃতির একটি সর্বভারতীয় চেহারা দিয়েছে। এই গবেষণাপত্র দেখাচ্ছে বাঙালি মৈথিলরাও সেই সংস্কৃতির বাইরে নন। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়,পদ্মশ্রী শারদা সিনহা বলিউডের চলচ্চিত্রে মৈথিল বিবাহগীতকে যেমন একটা স্থায়ী আসন দিয়েছেন, তেমনি শিলিগুড়ি বেতারকেন্দ্র থেকে নয়ের দশকে রেডিওতে সম্প্রচারিত গানে খ্যাতনামা গায়িকা সেনা মিশ্র এক অন্যরকম গায়কি প্রবর্তন করেছিলেন,যা বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
এটি মূলত ঋষি ও সৌমেন্দু দ্বিতীয় গবেষণা। সৌমেন্দুর এর সঙ্গে অধ্যাপক ঋষি ঘোষের আগের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছিলো বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদিত একটি ন্যাশনাল স্তরের জার্নালে। গৌড় মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ঋষি ঘোষের সঙ্গে যৌথভাবে সেই গবেষণাটিও করেছিলেন তিনি। সেই পেপারটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঋষি বলেন ” মৈথিল জনজাতির ইতিহাসের সঙ্গে প্রায় পাঁচশো বছরের মাইগ্রেশনের ইতিহাস মিশে রয়েছে। এই দীর্ঘ সময় ধরে যে জনজাতির মানুষ দ্বারভাঙ্গা, মধুবনী, সহর্সা,সমস্তিপুর, বেগুসরাই, মুঙ্গের,খাগাড়িয়া,মজঃফরপুর,সীতামারহি,বেগুসরাই,কাটিহার,ভাগলপুর বা মাধেপুরার মতো জায়গা থেকে স্রেফ জীবন জীবিকার নিরাপত্তার খাতিরে প্রায় চারহাজার কিলোমিটার পথ পেরিয়ে এসেছে-তাদের সংস্কৃতির মধ্যে নানা মিশ্রণ কাজ করে গেছে। এটা ভুললে চলবে না-এই জনজাতির মধ্যে উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা সাংঘাতিকভাবে লুকিয়ে রয়েছে।সৌমেন্দু রায় সেই সাংস্কৃতিক মিশ্রণের দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।”
মানিকচকের লালবাথানির আদি বাসিন্দা সৌমেন্দু রায় জানান ” গবেষণাটি এগোতে গিয়ে বুঝলাম, সর্বভারতীয় মৈথিল ঐতিহ্যর সঙ্গে বাংলার যোগ বেশ কম-নতুন প্রজন্ম আগ্রহী না হলে এই যোগটুকুও মুছে যাবে। এই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠানগুলি পশ্চিমবঙ্গের দিকে বা মালদার দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত-কিন্তু কোন সাড়া পান না তারা।মালদার বাঙালি মৈথিল সমাজ নিয়ে তারা আগ্রহী,নয়তো আমাদের গবেষণাপত্র মনোনীত হয় না। সেখানে স্পষ্টভাবে জেলার কথা উল্লেখ করা আছে। ২০১৮ সালে দ্বারভাঙ্গার ললিত নারায়ণ মিথিলা ইউনিভার্সিটি আর কমলেশ্বর সিংহ সংস্কৃত ইউনিভার্সিটিতে মৈথিল ভাষা ও মিথিলাক্ষর লিপি নিয়ে ইউজিসি র উদ্যোগে গবেষণাকেন্দ্র তৈরি হয়েছে সেখানেও রাজ্য বা অঞ্চলভিত্তিক মৈথিল সংস্কৃতি নিয়ে ভালো কাজ হচ্ছে।মৈথিল গীত ও চলচ্চিত্রও আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃতি পেয়েছে।এগুলো সবার জানা দরকার। ঐতিহ্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেউ বাঁচতে পারে না।”