• March 25, 2023

মুর্শিদাবাদে মহীন

 মুর্শিদাবাদে মহীন

মীর রাকেশ রৌশান

আজ ১ জুন গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন। সঙ্গীত জগতে যিনি মনি দা নামে খ্যাত।ভারতবর্ষের গান পাগল মানুষের মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র।ভারতবর্ষের অন্যতম খ্যাতনামা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলির সদস্য’।মহীন এবং গৌতম চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে বাঙালির আবেগ এখনও বর্তমান।কারণ একমাত্র মহীনের সদস্যরা প্রথাগত সেলিব্রিটিদের মত ভেবে কাজ করতেন না।মানুষের সাথে মিশে মানুষের সাথে থেকেই মহীনের কাজ।মহীন ছাড়াও গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের একটি রাজনৈতিক জীবন ছিলো। তিনি বামপন্থায় বিশ্বাসী একজন মানুষ। এবং তাঁর যাপিত জীবনের ইতিহাস দেখলে ছত্রেছত্রে বামপন্থা খুঁজে পাওয়া যাবে।নকশাল আন্দোলনের সাথে তিনি ওতপ্রতভাবে জড়িয়ে ছিলেন।তিনি নিজে সেলিব্রিটি হননি অনেক শিল্পীকে সেলিব্রিটি করেছেন।আজকের দিনে যারা বাংলার বড় বড় শিল্পী তাদের বড় হয় ওঠার পিছুনে মহীন,গৌতম চট্টোপাধ্যায়, আব্রহাম মজুমদার, তাপস দাস কে অস্বীকার করতে পারবেন না।বিশেষ করে সেই সময় মহীনের সম্পাদনা অনেককেই এগিয়ে দিয়েছিল।যাইহোক এতো গেল গৌরচন্দ্রিকা এবার মূল বিষয়ে আসা যাক।সালটা ১৯৭৯, সেই সময় বহরমপুরের ‘স্পন্দন’ নামক একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার হাত ধরে মহীনের মুর্শিদাবাদে আসা।স্পন্দনের সদস্য ডঃ হর্ষ দাশগুপ্ত, গৌতম নাগ প্রমুখ। মুর্শিদাবাদ নিয়ে মহীনের অন্যতম ঘোড়া তাপস দাস ( বাপিদার) সাথে বেশ কয়েকবার কথা হয়েছিলো।এমনি যখনই দেখা হয়, আমাকে দেখে মুর্শিদাবাদের কথা বলে ফেলেন।আসলে মুর্শিদাবাদে মহীনের ১৯৭৯ সালেই প্রথম এবং শেষ শো।কারণ গৌতম চট্টোপাধ্যায়রা বহরমপুর স্টেশনে নেমে দেখেন ছাত্র পরিষদের ছেলেরা স্টেশনের সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে। মহীনের সদস্যদের দেখে তারা বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে লাগে, তাদের মতে মহীন অপসংস্কৃতি করার জন্য নাকি বহরমপুরের এসেছে।তাই তারা স্লোগান দেয় “অপসংস্কৃতি মানছিনা মানবো”…. ইত্যাদি। আয়োজক বন্ধু সংস্থা স্পন্দনের সদস্যরা সকলকে কোন ক্রমে মডার্ণ হোটেল নিয়ে আসে এবং সেখানেই গৌতম চট্টোপাধ্যায়দের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।কিন্তু তারপর ঠিক দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় আরো মারাত্মক ঘটনা ঘটে।ছাত্র পরিষদের ছেলেরা সংগঠের পতাকা হাতে মিছিল করে মডার্ণ হোটেলের সামনে দিয়ে যায় এবং এমন কি সেই মিছিলে যোগাদান করেছিল সংঠনের পতাকা হাতে ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের(SFI) সদস্যরা। মিছিলে স্লোগান ওঠে” মহীনের ঘোড়াগুলি দুর হটো”, স্লোগান ওঠে “বাংলায় অপসংস্কৃতি মানছি না, মানবো না”। ওই আবহের মধ্যেও সেদিন গ্রান্ট হলে গৌতম চট্টোপাধ্যায়েরা তাঁদের অনুষ্ঠান করেন কিন্তু তারপর আর মহীন মুর্শিদাবাদ আসেনি।আজ গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন একজন মুর্শিদাবাদী হিসেবে এই ঘটনা আমার কাছে অনেক লজ্জার।আর ইতিহাস কোন দিনে মুছে দেওয়া যাইনা,আজ আমি না বললে এই ঘটনা অন্য কেউ তুলে ধরতো। কারণ কোনটা সংস্কৃতি আর কোন অপসংস্কৃতি তা গৌতম চট্টোপাধ্যায় নিজে দেখিয়ে দিয়েগেছেন।তাঁর চলে যাওয়ার পরও তাঁর গান বেঁচে আছে, তিনি বেঁচে আছেন আমাদের মনের মণিকোঠায়।গৌতম চট্টোপাধ্যায় একটা আবেগের নাম।গৌতম চট্টোপাধ্যায় শুধু শিল্পী নন একজন বিপ্লবী।কৃষক,শ্রমিকের লড়াইয়ে সঙ্গ দিয়েছে।মানুষের জন্য জেল খেটেছেন।জেলের ভিতরে মানুষটার উপর অমানবিক অত্যাচার হয়েছে।এজেল থেকে ওজেল টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে।তিনি অনায়াসে পারতেন বিলাসবহুল জীবন,সেলিব্রিটি হয়ে বেঁচে থাকতে কিন্ত তিনি তা করেননি….মহীনের গান ও সম্পাদনাতেও উঠে এসেছে সাধারণ মানুষের কথা… উঠে এসেছে… “ওরা কাজ করে গ্রামে বন্দরে”…ওঠে এসেছে ” মানুষ চেনা দায়”… কারণ সবাই তো আর মানুষ হয়না।আজকের দিনে বেশির ভাগ শিল্পী শুধু টাকা আর খ্যাতি জন্যই শিল্প চর্চা করেন।মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন আসে শিল্পী কি শিল্প করবে নাকি তার সামাজিক দায়বদ্ধতাও থাকবে? আর কোনটা বা সংস্কৃতি আর কোনটা অপসংস্কৃতি? এর মানদণ্ড কি? মুর্শিদাবাদের অলিতে গলিতে ব্যান্ড আর তারা স্টেজে উঠেই মহীনের গান অথবা মহীন সম্পাদিত গান করেই থাকেন।মহীন সবার কাছে আইকন। চায়ের ঠেকে বা গিটার নিয়ে মহীনের গান।কথায় কথায় গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের কথা।কিন্তু আসলে কি আমরা গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের অনুসারী নাকি শুধুই চোয়াঢেকুর তুলি? আমি নিশ্চিত গৌতম চট্টোপাধ্যায় এই মুহুর্তে বেঁচে থাকলে শ্রমিকদের জন্য গিটার হাতে রাস্তায় নামতেন।অনাগরিক করে দেওয়া মানুষদের জন্য ধরনায় বসতেন।কৃষক আন্দোলনে রাস্তায় রাস্তায় গান করতেন,রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করতেন।তাই উনি প্রিয় মণিদা, সবার প্রিয়।গৌতম চট্টোপাধ্যায় একটা অধ্যায়,যা একশো বছর পরে একজন এমন আসে।জানিনা আর এমন মানুষ বাংলা পাবে কি না।আমরা বরং ” কথা দিয়া বন্ধু ফিইর‍্যা না আইলা” গাই, গানের মানেটা নাইবা বুঝলাম ।

মীর রাকেশ রৌশান : কবি,প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published.

Related post