ভারতের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে অপপ্রচার

রাধাপদ দাস
পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারত। আর কিছু দিনের মধ্যেই হয়ত চীন কে পিছনে ফেলে ভারত সামনের সারিতে চলে আসবে। আর ভারতের এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির পিছনে অনেকেই মুসলমান সমাজ কে সরাসরি দ্বায়ী করেন। তাদের যুক্তি হল যেহেতু এদের ধর্মীয় কারনে জন্মনিয়ন্ত্রনের নানা বিধি নিষেধ আছে, সেই কারণে “এদের এক এক জন ‘আল্লার নামে’ মুরগীর বাচ্চার মতই ডজন ডজন বাচ্চা পায়দা করে”। এমন ও কথা শোনা যায়, এই একই কারণে আর কিছু দিনের মধ্যেই ভারত নাকি মুসলিম রাষ্ট্রে পরিণত হবে। হিন্দুদের আর অস্থীত্বই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভারতে যত সাম্প্রদায়ীক দাঙ্গা ও ধর্মীয় বিদ্বেষের ঘটনা ঘটে, তার মধ্যে মুসলিম সমাজের বিরুদ্ধে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই প্রচারটাই এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসাবে দেখা দেয়। কিন্তু প্রকৃত সত্য কি এটাই, না অন্য কিছু? হাঁ, ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি, জাতীয় গড়ের থেকে ডজন ও নয় আবার ডবল ও নয়, মাত্র ০.২০% বেশি। তথ্যটা পড়ে অনেকে অবাক হয়ে যাচ্ছেন ত। হাঁ আমিও আপনাদের মতই প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। জনগণের মধ্যে প্রচার আর প্রকৃত সত্যের মধ্যে এই ফারাক দেখে। সমস্ত মৌলবাদী শক্তি হিটলারের মত ফ্যাসিবাদী শক্তির গোয়েলবসীয় প্রচার কে হাতিয়ার করে, ময়দানে তারা মানুষ ক্ষেপাতে থাকে। “মিথ্যা বল, বারে বারে বল, জোর গলায় বল, মিথ্যা সত্যে পরিণত হবে”। গোয়েলবসের এই নীতিকে ভিত্তি করেই, ভারতের মৌলবাদী শক্তিও মুসলিম সমাজের ব্যাপক জনসংখ্যা বৃদ্ধির মিথ্যা প্রচারের যে স্রোত, তা তারা তৈরী করতে পেরেছে। এখন আমরা দেখে নেব এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ভারত সরকারের রিপোর্ট কি বলছে।
ভারত সরকারের (NFHS-5)-National Family Health Survey 2019-2021 সালের রিপোর্ট সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে। সেখানে দেখানো হয়েছে যে ভারতে Total Fertility Rate 2.0 children per women. অর্থাৎ প্রতি মহিলা পিছু মাত্র ২ জন। যেখানে ২০১৫-২০১৬ সালে ছিল ২.২ জন প্রতি মহিলা পিছু। এখন আমাদের দেখে নিতে হবে টোটাল ফার্টিলিটি রেট কি? এক জন মহিলা(স্বামী-স্ত্রী মিলে) গড় যে সন্তান উৎপাদন করেন তাকেই বোঝায়। অর্থাৎ দম্পত্তি পিছু দুটি বাচ্চা। কিন্তু ভারতের জনসংখ্যা বিদরাই ভারতের কাম্য TFR(Total Fertility Rate) নির্ধারণ করেছেন ২.১। এর বেশি ও নয় আবার কম ও নয়। কিন্তু বর্তমানে ভারতের জনসংখ্যার গড়, কাম্য জনসংখ্যার থেকেও অনেকটাই কমে গেছে। অতএব ভারতের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের জন্য ভারত সরকারের যা লক্ষ্য, ইতিমধ্যেই তা অর্জন করেই ফেলেছে। কারণ TFR বেশী হয়ে গেলে জনসংখ্যা বেড়ে যাবে। আবার কম হয়ে গেলে ও বিপদ, কারণ ৩০-৪০ বছর পর আজকের যারা বাচ্চা তারা যখন বুড়ো হয়ে যাবে তাদের ভারবহন করার জন্য নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়ে কমে যাবে । ফলে দেশ তথা সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সমাজের সমগ্র ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রহীন হয়ে যাবে, যা সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া ও সম্ভব নয়।যা পৃথিবীর কোন দেশই চায় না। সেই কারণে চীন, জাপানের মতো বহু দেশ গুলো আবার জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণে সরকারের থেকে জনগণ কে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।

ভারতের TFR আমরা পেয়ে গেলাম। যা আমরা ইতিমধ্যে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে ফেলেছি। কিন্তু এখন আমাদের দেখার বিষয় হিন্দু ও মুসলিমদের এই TFR বা কেমন। যদি হিন্দুদের TFR দেখি তাহলে দেখতে পাবো বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের TFR হল ১.৯৪(NFHS-5-2019-21), যেখানে ২০১৫-১৬ সালে ছিল ২.১ (NFHS-4), আর ১৯৯২-৯৩ সালে ছিল ৩.৩ (NFHS-1) । হিন্দুদের এই জনসংখ্যা জাতীয় গড়ের থেকে সামান্য পরিমানে কম। বর্তমানে ভারতের জানসংখ্যার জাতীয় গড় যেখানে প্রতি স্বামী-স্ত্রী পিছু ২ জন। সেখানে হিন্দুদের জনসংখ্যার গড় ১.৯৪। অর্থাৎ জাতীয় গড়ের থেকে ০.০৬% কম।
আর মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা TFR কেমন। বাজারে আমরা যেখানে শুনতে পাই তারা নাকি মুরগীর বাচ্চার মতই ডজন ডজন বাচ্চা পায়দা করে। তারাই ভারতের জনসংখ্যা ব্যপক পরিমাণে বৃদ্ধি করেছে। বর্তমানে ভারতে মুসলিম সমাজের জনসংখ্যা বৃদ্ধির গড় বা TFR হল ২.৩ (NFHS-5 , 2019-21), অর্থাৎ প্রতি মহিলা (স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি দম্পতী ধরলে) পিছু ২.৩ জন। বর্তমানে ভারতের জাতীয় গড় যেখানে প্রতি মহিলা পিছু ২ জন। সেখানে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার জাতীয় গড়ের থেকে মাত্র ০.৩০% বেশী। যেখানে ২০১৫-১৬ সালে ছিল ২.৬(NFHS-4)। আবার ১৯৯২-৯৩ সালে ছিল ৪.৪(NFHS-1)।
১৯৯২-৯৩ সালে NFHS-1 অনুষারে ভারতের জাতীয় জনসংখ্যার গড় (TFR) মুসলিমদের যেখানে ছিল ৪.৪, আর হিন্দুদের ছিল ৩.৩। অর্থাৎ হিন্দুদের থেকে মুসলিমদের বৃদ্ধির হার ছিল ১.১ বেশি। আবার ২০১৯-২১ সালে NFHS-5 অনুষারে মুসলিমদের ২.৩। আর হিন্দুদের ১.৯৪। অতএব বর্তমানে হিন্দু মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বা TFR এর পার্থক্য মাত্র ০.৪০ এর ও কম। আবার ভারতের যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রা ২.১। তার থেকে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি মাত্র ০.২০ বেশি। এই হিন্দুদের থেক ০.৪০% বেশী বা ভারতের জাতীয় গড়ের থেকে ০.২০% বেশিকেই ডজন ডজন বাচ্চা পায়দা বলে প্রচার করা হচ্ছে। বা আগামী দিনে ভারত নাকি পাকিস্থান রাষ্ট্র বা মুসলিম কান্ট্রি হয়ে যাবে বলে জোরসে প্রচার চলছে। অথচ আমি আমার পরিচিত জনদের মধ্যে এই তথ্যটা দেওয়ার পর তাদের মধ্যে বেশিরভাগই প্রথমে মানতেই চান নি। আমাকে মুসলীম তোষনকারী বলে এক স্ট্যাম্প লাগিয়ে দিলেন। তার পর গুগুল সার্চ করে যখন সরকারি তথ্য দেখালাম তার পর ও তারা বলছেন ‘এটা ভূল তথ্য। এটা হতেই পারে না’। সবথেকে অদ্ভুত ব্যাপার হল, এই তথ্য মানতে না পারার দলের মধ্যে আবার কয়েকজন শিক্ষকও আছেন। অতএব ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির মিথ্যা প্রচার, কি শিক্ষিত বা অশিক্ষিত, উভই মানুষের উপর এর ব্যপক প্রভাব বিস্তার করে আছে।
হিন্দু-মুসলিম ছাড়াও অনান্য সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির TFR কেমন, সেটাও আমাদের একবার দেখে নিতে হবে।
যেমন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের হার বা TFR হল ১.৮৮, সিখ সম্প্রদায়ের TFR হল ১.৬১, এবং জৈন সম্প্রদায়ের – ১.৬ ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের- ১.৩৯। এই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অনুপাত হল ভারতের সব থেকে কম অনুপাত।
এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল শিক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নতী। সেই শিক্ষার অবস্থাটা কোন সম্প্রদায়ের কেমন সেটাই এখন আমরা দেখে নেবো। যেমন ২০১৫-২০১৬ সালের NFHS-4 এর রিপোর্ট অনুষারে মুসলিম সমাজের প্রায় ৩২% মহিলা স্কুলে যেত না বর্তমানে তা কমতে কমতে ২০১৯-২০২১ সালের NFHS-5 রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ২১.৯% হয়েছে। অর্থাৎ আগের থেকে প্রায় ১০% কমেছে। কিন্তু হিন্দুদের ক্ষেত্রে ২০১৫-২০১৬ সালে স্কুলে না যাওয়ার মহিলার সংখ্যা ছিল ৩১%, আর ২০১৯-২০২১ সালে তা সামান্য কমে হয়েছে ২৮.৫%(NFHS-5) । অর্থাৎ আগের থেকে প্রায় ২.৫% কমেছে। যদিও এই হার মুসলিমদের থেকে অনেকটাই কম। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে হিন্দুদের থেকে মুসলিম সমাজের মহিলাদের শিক্ষার হার বেশি হয়েছে, তুলনা মুলক ভাবে।
আর এই শিক্ষাই যে দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনে এক বড় ভূমিকা পালন করেছে তা এখন আমরা দেখে নেবো। যেমন যেসমস্ত মহিলা কখনো স্কুলে যায় নি তাদের মধ্যে TFR হল ২.৮। আবার দ্বাদশ শ্রেণি বা তার বেশি পড়াশুনা করা মহিলাদের TFR হল ১.৮(NFHS-5). উপরের এই তথ্য থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি শিক্ষার উন্নতীর সাথে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের এক সরা সরি যোগ বা প্রভাব আছে। একই ভাবে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া বা দরিদ্র মহিলাদের থেকে আর্থিকভাবে এগিয়ে বা সম্পদশালী মহিলাদের মধ্যে TFR এর পার্থক্য ১% কম। অতএব গরীব ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও চেতনার মানের কারনেই জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ও একটু বেশি।
আবার এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গ্রাম ও শহরের ভূমিকা কেমন সেটাই এখন দেখে নেবো। যেমন ১৯৯২-৯৩ সালের NFHS-1 অনুষারে গ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বা TFR হল ৩.৭। আর শহরের হল ২.৭। আবার ২০১৯-২০২১ সালের NFHS-5 অনুষারে গ্রামের TFR ২.১ আর শহরের TFR হল ১.৬। অতএব এই তথ্য থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে গ্রামের মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি, সেই তুলনায় শহরের মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অনেকটাই কম। আর NFHS-5 অনুষারে শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গ্রামের থেকে প্রায় ০.০৫% কম।
ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির মিথ্যা তথ্যের ব্যপক প্রচার আজ যে আমরা দেখতে পাচ্ছি তা হঠাৎ করেই দু এক বছরের মধ্যেই শুরু হয়েছে ব্যপারটা এমন নয়। এর সূত্রপাত বহু আগে থেকেই। যেমন ১৯০৯ সালে কলকাতার ইউ. এন. মুখার্জি ‘হিন্দুজঃ এ ডায়িং রেস’ নামক এক পুস্তিকা প্রকাশ করে সমগ্র জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দুদের ক্রমহ্রাসমান অবস্থা দেখালেন। ১৯১২ সালে আর্যসমাজের নেতা স্বামী শ্রদ্ধানন্দের সাথে এক স্বাক্ষাতকারে তিনি বললেন, যে হারে হিন্দু হ্রাস পাচ্ছে, তার ফলে নাকি আগামী ৪২০ বছরের মধ্যে হিন্দুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সেই সময় থেকে আমরা ১১০ বছর অতিক্রম করে এসেছি। ভারত সরকারের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের যে তথ্য আমরা দেখলাম তাতে কি ভারত থেকে হিন্দুরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার মতই কোন তথ্য উঠে এল, না অন্য কিছু। আবার মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বা TFR সবথেকে বেশি। সেই সংখ্যা ক্রমশ নিম্ন মুখি। যা ভারতের কাম্য জাতীয় গড়ের থেকে মাত্র ০.২০ বেশি। তা দিয়েই কি হিন্দু দের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মুসলিমরাই জনসংখ্যার দিক দিয়ে সমগ্র ভারত দখল করে নেবে? তার কি সামান্য তম কোন ইঙ্গিত আছে? আমাদের এই মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদী যুগে বসে এই বিষয়টিকে মাথায় রেখে ভাবতে হবে। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে যত প্রচার হয়, ভারত সরকারের এই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রনের প্রকৃত তথ্য নিয়ে কেন সমস্ত মিডিয়া প্রায় নিরব?
তথ্যসূত্র-
১। সংঘ পরিবার ও হিন্দুত্ববাদ- আপডেট স্টাডি গ্রুপ।
২। Indian Express- 10th may- Esha Roy Article
3.National Family health servey(NFSH-5, 2019-2021) report
৪। ভারতে ধর্ম, গোষ্ঠী ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ- সুমিতা দাস। অনীক পত্রিকা -নভেম্বর-২০২১।
রাধাপদ : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।
