শিল্প ও শিল্পী: পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর অঞ্চলের তাঁতী সমাজের এক বাস্তব চিত্র

শ্রীমঞ্জরি গুহ
পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শান্তিপুর ও ফুলিয়া অঞ্চল তাদের তাঁত শিল্পের জন্য বিখ্যাত।তাঁতে বোনা সূক্ষ্ম কাজের আরামদায়ক শাড়ি কলকাতা ও অন্যান্য বড়ো শহরের দোকানে বেশি দামে বিক্রি হলেও অঞ্চলের তাঁত শিল্পীদের অবস্থা ক্রমশ নিম্নগামী।অপ্রতুল সরকারি সাহায্য, গতানুগতিক উৎপাদন ব্যবস্থা, নূন্যতম মজুরি ইত্যাদির পাশাপাশি বিগত তিন বছরের করোনা ও লকডাউন পরিস্থিতি তাঁতিদের দুরাবস্থা আরো বাড়িয়ে তুলেছে।এই সার্ভেটি ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে করা হয়েছিল।শান্তিপুর এলাকার আটটি বাড়ি থেকে তাঁতিদের অবস্থা সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।প্রতিটি বাড়িরই অন্তত একজন প্রাপ্তবয়স্ক সদস্য, তাঁত শিল্পের কোনো না কোনো অংশের সাথে যুক্ত রয়েছেন।
উৎপাদন প্রক্রিয়া
এলাকার এই তাঁতশিল্প সম্পূর্ণভাবে মহাজনদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।তাঁতশিল্পের সাথে জড়িত ড্রামমাস্টার, প্যাটার্ন শিল্পী এবং তাঁতিরা সকলেই মহাজনের হয়ে কাজ করেন।মহাজনরা তাঁত বোনার সুতো, রঙ, ডিজাইন, জ্যাকার্ড মেশিন সংক্রান্ত পরিষেবা সবই মহাজনরা সরবরাহ করে থাকেন।বহু মানুষ এই উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকলেও এই সার্ভেতে মূলত তাঁতিদের অবস্থা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।তাঁতিরা মূলত চুক্তিভিত্তিক ভাবে মহাজনের কাছ থেকে শাড়ি পিছু মজুরি পান।’তারা জানেন বাজারে কি দামে ঠিক শাড়ি বিক্রি হয়……আমরা অতও খেয়াল রাখি না….এমনকি করোনার পর দাম কি রকম তাও জানি না…..’অঞ্চলের উৎপাদন প্রক্রিয়া বর্তমানে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে হস্তচালিত তাঁত(hand – led loom) থেকে বিদ্যুৎচালিত তাঁত(power – loom) ব্যবহারের দিকে এগোচ্ছে।এলাকায় প্রধানত বাড়িতেই তাঁতের কাজ করা হয়।তাঁতযন্ত্র বাড়িগুলিতে মূলত বাড়ির লাগোয়া কোনো ছোট ঘরে বা বাড়ির ভিতরেই কোনো ঘরে বসানো হয়েছে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জায়গার অভাবে এই ঘরগুলি বাড়ির অন্যান্য কাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে(যেমন একটি হচ্ছে, অন্য একটি বাড়িতে তাঁত ঘরেই রান্নার ব্যবস্থা করা হয়েছে)।হস্তচালিত তাঁতের তুলনায় বিদ্যুৎচালিত ব্যবহার বর্তমানে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হল হস্তচালিত তাঁত চালিয়ে যেখানে দিনে সর্বাধিক একটি শাড়ি বোনা সম্ভব, বিদ্যুৎচালিত তাঁতে অনায়াসে দিনে চার-পাঁচটি শাড়ি বোনা যায়।এক বাড়ির সদস্য সাগরিকা নন্দী জানেন মূলত উৎপাদন বাড়ানো এবং বেশি রোজগারের আশায় বন্ধন ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তিনি তার স্বামীর নামে একটি বিদ্যুৎচালিত তাঁত কিনেছেন, তবে বর্তমানে লকডাউনের ফলস্বরূপ শাড়ির চাহিদার ঘাটতি, কম মজুরী এবং ক্রমাগত বেড়ে চলা বিদ্যুতের দামের দরুন তার পক্ষে ঋণের সুদ প্রতিমাসে শোধ করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে উঠেছে।মূলত শাড়ির ডিজাইনের সূক্ষ্মতার ওপর নির্ভর করে প্রতি শাড়ি পিছু মজুরী ৯০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করে।কিন্তু কোভিডকালীন সময়ে তাঁতিদের কথায়, সর্বাধিক মজুরী ১৩০ টাকায় নেমে এসেছে।কোভিড ছাড়াও অন্যান্য সময়ে মাসের প্রতিদিনের জন্য কাজ তাঁতিদের হাতে থাকে না।প্রদীপ ভৌমিক যিনি এখনও হাতে চালানো মেশিনেই তাঁত বোনেন, তিনি মাসে সর্বাধিক ১৬-১৭ টি অর্ডার পান।কিন্তু তাঁতশিল্পী সনৎ ঘোষ যিনি প্রায় পাঁচ বছর আগে বিদ্যুৎচালিত তাঁত কিনেছেন তিনি দিনে প্রায় ৩-৪ টি শাড়ি বুনতে পারেন এবং তার মাসিক অর্ডারের সংখ্যাও প্রায় ৭৫-৮০ টি।তবে সব তাঁতিরাই জানান যে তারা কখনোই তাদের পরিশ্রম ও দক্ষতা অনুযায়ী পারিশ্রমিক পান না।সনৎ ঘোষ বলেন, ‘আমাদের কোনো শ্রমিক সংগঠন নেই, তাই আমাদের কম মজুরী দেওয়া হলেও আমরা সেই বিষয়ে বিশেষ কিছুই করে উঠতে পারি না….মহাজনের মর্জির ওপর নির্ভর করে কেউ বেশি বা কেউ কম মজুরী পায়।’শাড়ির ডিজাইন ক্রেতাদের পছন্দ অনুসারে দ্রুত পরিবর্তিত হতে থাকে।তাঁতিদের কথায় কোনো নতুন ডিজাইনের বাজারে সর্বাধিক ৬ মাস চাহিদা থাকে।তাঁতশিল্পী প্রদীপ ভৌমিক জানান, ‘মূলত এই কারণেই ছোট তাঁতিরা বাজারে পোটিতে(বাজারে নিজেস্ব ছোট দোকান) বসার কথা ভাবতেই পারেন না।কাঁচামাল কেনার জন্য টাকা জোগাড় করা গেলেও শাড়ির ডিজাইনের চাহিদা পড়ে যাওয়ায় যদি তা বিক্রি না হয়, আমাদের আর কিছু করার থাকবে না।’ মহাজন ছাড়াও গত ৭-৮ বছরে অন্য একশ্রেণীর ব্যবসায়ীরা এলাকার তাঁত ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন।এরা তাঁতি ও মহাজন দুই শ্রেণীর কাছ থেকেই শাড়ি কিনে বিভিন্ন ‘অনলাইন প্লাটফর্মের'(ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক ইত্যাদি) মাধ্যমে শহুরে ক্রেতাদের কাছে তা বিক্রি করেন।এলাকার অন্তত ১০০০-১৫০০ মানুষ বর্তমানে এই অনলাইন ব্যবসার সাথে জড়িত আছেন।এমনই এক ব্যবসাদার সঞ্জিত পাল জানান, ওনার অনলাইন ব্যবসায় অন্তত তিন হাজার ক্রেতা আছেন।এই ক্রেতাদের অনেকেই আবার ছোট ব্যবসায়ী।তারা সঞ্জিত পালের মতো ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শাড়ি কিনে শোরুমের থেকে কম দামে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আবার অনলাইনে বিক্রি করেন।এলাকার এই ব্যবসায়ী শ্রেণীর বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশ বছরের কম এবং পড়াশোনা জানা সত্ত্বেও অন্য কোনো চাকরির সন্ধান না পেয়ে এবং তাঁত বোনার কাজে আগ্রহী হয়েই এই পেশায় যুক্ত হচ্ছেন বলে সঞ্জিত পাল জানান।তিনি জানান, এই ব্যবসায় যুক্ত হতে চাইলে অনলাইন টাকা পয়সা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা প্রয়োজন এবং ক্রেতাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে তাদের ধরে রাখতে পারলে লাভের যথেষ্ট সম্ভবনা আছে।তাঁতিদের এই অনলাইন ব্যবসার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে সাগরিকা নন্দী জানান, ‘আমরা অনলাইন ব্যবসার কথা শুনেছি, কিন্তু কিভাবে কি হয় কিছুই জানি না।আমাদের বাড়িতে তো ইন্টারনেট নেই, আমরা ওখানে বেচতে চাইলেও বেচতে পারবো না।আমাদের অবস্থা এই একই থেকে যাবে।’ এই ব্যবসাদাররা প্রতিবছর তাঁতশিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন হস্তশিল্প মেলায় যেমন পৌষমেলা,ঘাটালের মেলায় উপস্থিত থাকেন।অথচ সরকারি সাহায্যের নানা আশ্বাস পাওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে কিছুই না মেলায় মূলত মূলধনের অভাবে তাঁতশিল্পীরা কখনোই এইসব জায়গায় যেতে পারেন না।শিল্প উপস্থিত থাকলেও স্বীকৃতিও ন্যায্য রোজগার তাঁতশিল্পীদের অধরাই থেকে যায়।
তাঁতশিল্পে মহিলাদের ভূমিকা
প্রতিটি বাড়িতেই মহিলারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার কোনো না কোনো অংশের সাথে জড়িত।তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই কাজকে তারা তাদের গৃহশ্রমের অংশ বলেই মনে করেন এবং মহিলা হিসেবে তাদের স্বাভাবিক কর্তব্য বলেই মনে করেন।৮টি বাড়ির মধ্যে একটি মাত্র বাড়িতে শিবানী দাস হস্তচালিত তাঁতে নিজেই তাঁত বোনেন এবং নিজের পরিচয় তাঁতি হিসেবেই দেন।অন্যান্য বাড়িতে মহিলারা সুতো তৈরির কাজ এবং মাঝে মাঝে তাঁত বোনার কাজে যুক্ত থাকলেও নিজেদের ‘তাঁতশিল্পী’ মনে করেন না।সাগরিকা নন্দীর মেয়ে জানান, ‘আমি বাবাকে সুতো তৈরি করে দিই সময়ে সময়ে… এতো মেয়েদেরই কাজ।’উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে মহিলাদের ভূমিকা থাকা সত্তেও পুরুষ তাঁতশিল্পীরা নিজেদের বাড়ির একমাত্র উপার্জনকারী বলে মনে করেন।যদিও মহিলারা তাঁতের কাজের বাইরেও সংসার চালানোর জন্য ছোটখাটো সেলাইয়ের কাজও নিয়মিত করে থাকেন।এক পুরুষ শিল্পী এও জানান, তার স্ত্রী কে তাঁতের কাজ শিখতে নিষেধ করেছেন।
‘আমি মেয়েদের কাজ করা পছন্দ করি না।’ দেখা যাচ্ছে মেয়েরা তাঁতের কাজে শ্রমদান করলেও তা মূলত অদৃশ্যই থেকে যাচ্ছে।তাঁত শিল্পী শিবানী দাস জানান মহিলারা এখনও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হস্তচালিত তাঁতই ব্যবহার করছেন।তাই বর্তমানে বিদ্যুৎচালিত তাঁতের ব্যবহার অত্যন্ত বেড়ে যাওয়ায় মহিলা শিল্পীরা ক্রমাগত প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন।সাগরিকা নন্দী জানান, ‘আজকাল বাড়িতে বাড়িতে বিদ্যুৎচালিত তাঁত হলেও আমরা(মহিলারা) ওতো বড়ো মেশিন চালাতে ভয় পাই।আমি আমার নামে ঋণ নিয়ে মেশিন কিনলেও তা আমার স্বামীই চালান।’উৎপাদন প্রক্রিয়ার এই পরিবর্তন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্যে আছে এক অন্তর্নিহিত লিঙ্গ বৈষম্য, যা মহিলা তাঁত শিল্পীদের পিছিয়ে পড়ার এক অন্যতম কারণ হয়ে উঠেছে।

সরকারের ভূমিকা এবং করোনাকালীন পরিস্থিতি
শান্তিপুরের শাড়ির ‘GI Tag’ থাকা সত্ত্বেও তাঁতশিল্পীরা নামমাত্র সরকারী সাহায্য পেয়ে থাকেন।এলাকার হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী সরকারের কাছ থেকে হস্তচালিত তাঁত পেয়েছিলেন।কিন্তু বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত বিদ্যুৎচালিত তাঁত কেনার জন্য কোনো সাহায্য মেলেনি।এমনই এক শিল্পী প্রদীপ ভৌমিক জানান, ‘কয়েক বছর আগে আমি সরকারের থেকে হাতে চালানো তাঁত পাই, কিন্তু তাঁতের কাঠ পুরো ঘুন ধরা এবং তাঁত ব্যবহার করা যায় না।তার চেয়ে আমায় টাকা দিলে আমি নিজেই কিনে নিতাম।’শিল্পীদের কার্ড থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়ার জন্য কোনো রকম সরকারী সাহায্য পান না।করোনাকালীন সময়ে সমস্ত ব্যবসা প্রায় বন্ধের মুখে এসে দাঁড়ালে সরকারের কাছ থেকে শিল্পী হিসেবে কোনো সাহায্যই তারা পাননি।করোনাকালীন সময়ে অধিকাংশই কাজ হারিয়ে বাড়ি ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন।এলাকার অনেকেই জানান সংসার চালানো এক প্রকার অসম্ভব হয়ে উঠেছে।তারা আরো বলেন ‘এমনিই তাঁতের কাজ না থাকায় আমাদের ছেলে-মেয়েরা এ কাজ করতে চায় না।অন্য রাজ্যে যা কাজ পাচ্ছে তাতে চলে যাচ্ছে।এইভাবে সরকার কোনো সাহায্য না করলে তাঁতশিল্প আমাগী পঞ্চাশ বছর টিকবে কিনা সন্দেহ’কোভিডকালীন সময়ে অনলাইন ব্যবসার দ্রুত প্রসার মহাজন ও ব্যবসাদারদের জন্য লাভজনক এবং শহরের ক্রেতাদের ঘরে বসেই শৌখিন ও নান্দনিক শাড়ির চাহিদা পূরণে সহায়ক হলেও তাঁতিদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে উঠেছে।এলাকার এক তাঁতশিল্পীর উক্তি ‘শহরের বাবুরা বড় বড় ব্যবসা আর চাকরি করে, আমাদের মানুষ বলে মনে করে না।যাই হোক আমাদের অবস্থা বদলাবে না’।তাঁত সমাজের দুরাবস্থা এবং তার প্রতি আমাদের উদাসীনতাকেই প্রকট করে তোলে।
সমস্তরকম সহযোগিতা ও সাহায্যের জন্য আমি শান্তিপুরের তাঁতি সমাজের মানুষজন ও তৃষা অধিকারীকে ধন্যবাদ জানাই।
শ্রীমঞ্জরি গুহ: CDS এ গবেষণারত ছাত্রী ।