রাজনীতি যখন ধর্মের দাস

গৌতম বসুমল্লিক
গত শতকের একেবারে গোড়ার দিকের কথা। দেশজুড়ে তখন বঙ্গভঙ্গ বিরোধী প্রতিরোধ আন্দোলন চলছে। লর্ড কার্জনের বঙ্গদেশকে ভেঙে দু’টুকরো করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে যুক্ত ছাত্রদের সরকারি ইস্কুল-কলেজ থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে। বহিষ্কৃত ছাত্রদের বিকল্প শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তৈরি হল ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’। অধ্যক্ষ হয়ে এলেন অরবিন্দ ঘোষ। ১৯১ বউবাজার স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে অরবিন্দ ঘোষের অধ্যক্ষতায় স্থাপিত হল ‘জাতীয় শিক্ষা পরিষদ’। কিন্তু না, অরবিন্দ বেশি দিন আর শিক্ষকতার মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলেন না। তাঁরই নেতৃত্বে বাংলায় গড়ে উঠল সশস্ত্র বিপ্লবের দল। মুরারিপুকুরে তৈরি হল বোমা তৈরির কারখানা। বাইরে থেকে দেখলে অবশ্য তাকে ধর্মশিক্ষার কেন্দ্র বলেই মনে হত। তেমনই ছিল তার গড়ন। যুগান্তর, অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীদের নিয়ে তৈরি সেই বোমার কারখানায় রীতিমতো হিন্দু-ধর্মশিক্ষাই দেওয়া হত। ১৪-১৫ বছরের তরতাজা ছেলেদের গীতা ছুঁইয়ে দেশের জন্য আত্মবলিদান দেওয়ার প্রতিজ্ঞা করানো হত। আধুনিক যুগে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে দেওয়ার সূচনা তখন থেকেই।
প্রাচীন ভারতে অবশ্য তার নমুনা কম নেই। সম্রাট অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের পর তাঁর শাসনাধীন সমগ্র সাম্রাজ্যের অধিকাংশ প্রজাকে বৌদ্ধ ধর্ম নিতে বাধ্য করেন। সাধারণাব্দের ষষ্ঠ-সপ্তম শতক থেকে যে নব্য হিন্দু পুনর্জাগরণ আরম্ভ হয়েছিল, সেখানেও রাজধর্মকে লোকসাধারণের ধর্মে রূপান্তরিত করাই ছিল মূল লক্ষ্য। বরং প্রায় ছ’শো বছরের ইসলাম যুগে সেই প্রবণতা অনেকটাই কমে এসেছিল। তা না হলে গত শতকের মাঝামাঝি স্বাধীনতার সময়কালে ভারতীয় উপমহাদেশে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকত না।
‘কালান্তর’ গ্রন্থের ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘অল্পদিন হইল এ-সম্বন্ধে আমাদের একটা শিক্ষা হইয়া গেছে। যে কারণেই হউক যেদিন স্বদেশী নিমকের প্রতি হঠাৎ আমাদের অত্যন্ত একটা টান হইয়াছিল সেদিন আমরা দেশের মুসলমানদের কিছু অস্বাভাবিক উচ্চস্বরেই আত্মীয় বলিয়া ভাই বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিয়াছিলাম। সেই স্নেহের ডাকে যখন তাহারা অশ্রুগদগদ কণ্ঠে সাড়া দিল না তখন আমরা তাহাদের উপর ভারি রাগ করিয়াছিলাম। ভাবিয়াছিলাম এটা নিতান্তই ওদের শয়তানি। একদিনের জন্যও ভাবি নাই আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না।’
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী স্বদেশি আন্দোলনে বাংলার মুসলিম সমাজ যে আগ্রহ দেখায়নি তার অন্যতম কারণ ছিল রাজনীতির সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলার প্রবণতা, যা মূলত হয়েছিল বাংলার বিপ্লববাদের জনক অরবিন্দ ঘোষের উদ্যোগে। আলিপুর ষড়যন্ত্র মামলায় ‘বেকসুর’ খালাস পাওয়ার বছর খানেকের মধ্যে তিনি ‘ঋষি’ হয়ে পণ্ডিচেরিতে ঘাঁটি গাড়লেন বটে কিন্তু রেখে গেলেন তাঁরই তৈরি করা ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’। সেই মৌলবাদী ধর্মকে আশ্রয় করেই ‘হিন্দু মহাসভা’, ‘জনসংঘ’দের পথচলা।
স্বাধীনতা পূর্ব বা আরও স্পষ্ট করে বললে, দেশভাগ-পূর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। রাজনৈতিক দিক থেকে অন্য যত দোষই থাক গান্ধী কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। এবং সেই কারণেই তিনি ক্রমে জনসংঘের শত্রু হয়ে উঠেছিলেন এবং সেটাই তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মৃত্যুর পঁচাত্তর বছর পরেও গান্ধীর আত্মা জনসংঘীদের তাড়া করে বেড়ায়। তারই ফল রুবি পার্কের দুর্গা প্রতিমার অসুররূপী গান্ধীর উপস্থিতি। আশার কথা, স্যোশাল মিডিয়ার চাপের কাছে হার স্বীকার করে পুজোর উদ্যোক্তারা অসুরের রূপ পালটাতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মিশিয়ে যে নোংরা রাজনৈতিক খেলা ভারতীয় উপমহাদেশে যুগ যুগে ধরে চলে আসছে, সেটা বন্ধ করা সহজ কাজ নয়। সাধারণ মানুষ যদি একত্রিত হয়ে এ সবের প্রতিবাদ না করেন, সেই ট্র্যাডিশন সমানেই চলতে থাকবে।
গৌতম বসুমল্লিক : বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

1 Comments
লজ্জাও মুখ লুকিয়েছে, হিন্দুত্বের ঘৃন্য নির্মমতায়, দেবীকে দায়ভাগ দিয়ে, নিজেকে কোথায় লুকায়?