ইয়াস বিধ্বস্ত সুন্দরবন : বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকারের লড়াই

সঞ্চিতা আলি ( মানবাধিকার কর্মী) :- গত ২৬ মে ভোরবেলায় বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড় ইয়াস এবং ভরা কোটালের জোড়া প্রকোপে কার্যত তছনছ হয়ে যায় সুন্দরবন ও পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী অঞ্চল। আতঙ্কে সুন্দরবনের গ্রামবাসীরা আগেরদিন মাটি ফেলে নিজেরাই বাঁধ মেরামত করে গ্রাম বাঁচানোর শেষ চেষ্টা চালালেও বেশিরভাগ জায়গাতেই হয়নি শেষ রক্ষা। ঝড়ের প্রভাব পুরোপুরি শুরু হওয়ার আগেই ভেঙে যায় বকখালি, পাথরপ্রতিমা, শঙ্করপুর, মৌসুনি দ্বীপ, নামখানা সহ সুন্দরবনের বহু নদী বাঁধ। ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ অঞ্চল কুলতলি-মৈপিঠ। দঃ ২৪ পরগণার কুলতলি বিধানসভার অন্তর্ভুক্ত এই অঞ্চলটি এর আগে বার বার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আয়লা, বুলবুল, আম্ফানের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে। আম্ফানের দগদগে ক্ষত এখনো শুকোয়নি। অথচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দরজায় কড়া নাড়ে আরেক ঘূর্ণিঝড় ইয়াস। তছনছ করে দেয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ঝড়ের পরদিন সকালে আমরা পৌঁছাই মৈপিঠ দেউলবাড়ি, ভাসা গুড়গুড়িয়া অঞ্চলে। ইয়াস যে কী মারাত্মক ক্ষতি করেছে সুন্দরবনবাসীর, তা এখানে না এলে বোঝা সম্ভব নয়। এখানকার পরিস্থিতি ভয়াবহ বললেও কম। ভরা কোটালের সাথে ঝড়ের তান্ডবে ভেঙে যায় এই অঞ্চলের একাধিক নদীবাঁধ। বাঁধ ভেঙে মাতলা, ঠাকুরাইন, পেটকুলের তোড়ে ভেসে যায় দেউলবাড়ি, পেটকুলচাঁদ, জর্জের হাট, হালদার ঘেড়ি, ভাসা পূর্ব গুড়গুড়িয়া, ভুবনেশ্বরী সহ বহু এলাকা। হালদার ঘেড়ির কাছে প্রায় ৬০ ফুট নদীবাঁধ ভেঙে যায়। পাশেই পেটকুল নদী। যে নদীতে সারাবছর তেমন জল থাকে না, সেই নদীও কোটালের টানে ফুঁসে ওঠে। ভাসিয়ে দেয় পাশ্ববর্তী চাষের জমি, রাস্তা, পুকুর, ঘরবাড়ি সবকিছু। নোনা জল ঢুকে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পটল ক্ষেত, উচ্ছে ক্ষেত। ভেসে যায় হাস মুরগি গবাদি পশু। নোনা জলে মরে ভেসে ওঠে পুকুরের মাছ। পরদিন ভাটার টানে কোথাও কোথাও জল নামলে দেখা যায় পুকুরের পাড়ে, রাস্তায়, খেঁজুর গাছের গোড়ায় আটকা পড়ে আছে মরা মাছ। সর্বত্র পচা মাছের দুর্গন্ধ। চাষজমিতে জমে থাকা পচা জলে একটা ঘাস পর্যন্ত আর বেঁচে নেই।
ঝড়ের পরদিন পেটকুলচাঁদ বাজারের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে ভাঙা রাস্তা। মাঝখান দিয়ে তীব্র বেগে বয়ে চলেছে মাতলার জল। স্থানীয় গ্রামবাসীরা জানান, ঝড়ের দিন এই রাস্তা ঠিক থাকলেও পরদিন জোয়ারের সাথে সামান্য হাওয়াতেই ভেঙে দু’ টুকরো হয়ে গেছে এই রাস্তা। আশেপাশের বেশ কয়েক জায়গার ছবিটাও একই। চারদিকে থৈ থৈ করছে জল। একটু হাওয়া দিলেই হু হু করে জল বেড়ে বড় রাস্তায় উঠছে। জলমগ্ন মৈপিঠ এলাকায় ঝড়ের পর জঙ্গল থেকে গ্রামে ঢুকেছে প্রচুর কেউটে সাপ। স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্ত অ্যান্টিভেনাম নেই। প্রশাসনিক উদ্যোগে প্রায় ২০ কিমি দূরে জামতলা হাসপাতাল থেকে আনানোর চেষ্টা করা হলে জানা যায়, সেখানেও পর্যাপ্ত পরিমাণে নেই অ্যান্টিভেনাম। এব্যাপারে এখনো কোনোরকম পদক্ষেপ নেয়নি প্রশাসন। ঝড়ের দিন জঙ্গল থেকে বাঘ ঢুকেছে বলে গ্রামবাসীরা আশঙ্কা করেন। বাঘের হদিশ না মিললেও দু এক জায়গায় হরিণের দেখা মেলে। গ্রামবাসীরা দায়িত্ব নিয়ে সেগুলি বনদপ্তরের হাতে তুলে দেয়।
দেউলবাড়ির শ্যামনগর আদিবাসী পাড়ায় ঝড়ের আগের রাত থেকে হাঁড়ি চড়েনি কোনো ঘরে। কাছেই ভেঙেছে বাঁধ। পুরো পাড়া জলের তলায়। স্থানীয় সুভাষ হালদার, দেবলা হালদাররা বলছিলেন তাঁদের দীর্ঘ বঞ্চনার কথা। ইয়াস তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছে বছর তেরো আগের আয়লার স্মৃতি। আক্ষেপের সাথে বলছিলেন, ঝড় জলে বছর বছর ঘর ভেসে গেলেও তাঁদের অবস্থা যে কি সেই থাকে। ঝড় মোকাবিলার আগে সরকার ব্যাপক সতর্কতামূলক কর্মসূচির পসরা সাজালেও সারাবছর তাঁদের অবস্থার দিকে একটু নজর দিলে হয়তো এইভাবে সবকিছু হারাতে হয়না, ক্ষোভের সুর তাদের গলায়। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ খেটে খাওয়া প্রান্তিক মানুষের প্রধান জীবিকা কৃষি, নদী থেকে মাছ, চিংড়ি, মিন ধরা, জঙ্গল থেকে শুকনো কাঠ ও মধু সংগ্রহ। দূর্গম এই প্রাকৃতিক পরিবেশে জীবন বাজি রেখে প্রতিদিন রুটিরুজির টানে লড়াই চালিয়ে যেতে হয় তাঁদের। গত লকডাউন আর আম্ফানের চরম ক্ষতি ও লাগামহীন দুর্নীতির আঘাত কাটিয়ে শ্রমজীবী মানুষ যখন শেষ সম্বলটুকু আঁকড়ে একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছিল, সেই সময়ই শুরু হল দ্বিতীয় দফায় লকডাউন। কাজ হারিয়ে ঘরে ফিরেছেন শ’য়ে শ’য়ে প্রবাসী শ্রমিক। কাজ নেই। রোজগার নেই। তার উপর নদীতে মিন ছাড়ার অজুহাতে মাছ কাঁকড়া ধরা তিনমাসের জন্য বন্ধ রেখেছে বনদপ্তর। এই চরম দুর্দিনে সুন্দরবনের যে মানুষগুলো চাষ করে, মাছ ধরে সংসার চালাতো, পেটের ভাত জোগাতো, আগামী কয়েকবছর তাদের রুটিরুজির পথ বলে আর কিছু রইল না। আয়লার স্মৃতি মনে করে স্থানীয়রা বলছিলেন, এর চেয়ে আম্ফানের মতো ঘরের চাল উড়ে গেলে বোধহয় ভালো হত, কষ্ট করে খেটে কোনোমতে সারিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু এবার যা হল তাতে তাঁরা ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছেন না, এরপর তাঁরা ওই জমিতে কী করে চাষ করবেন, পেট চালাবেনই বা কী করে। গাজিপাড়ার ইউনুসদা বলছিলেন, দুবেলা এখন উনুনে হাঁড়ি চড়ানো মুশকিল হয়ে গেছে। অনেকেই এখন অপেক্ষা করে আছেন লকডাউন ওঠার। লকডাউন উঠলেই গ্রাম থেকে একসাথে পাড়ি দেবেন কেউ কেরালায়, কেউ বা অন্য কোনো প্রতিবেশী রাজ্যে। রুটিরুজির টানে। চাষবাস হবে না, সুন্দরবনে থাকলে আগামী বছরগুলোয় হয়তো পেটে খিল দিয়ে থাকতে হবে।
এই চূড়ান্ত সংকটে নিজেদের সাধ্যমত উদ্যোগ আমরা দক্ষিণ ২৪ পরগনা এপিডিআরের পক্ষ থেকে প্রথমদিন থেকে নিয়ে চলেছি। এমুহূর্তে দেউলবাড়ির হালদার পাড়া, নাইয়া পাড়া, কাঁটামারি আদিবাসী পাড়া ও শ্যামনগর আদিবাসী পাড়া মিলিয়ে এপিডিআর এর উদ্যোগে চারটি কমিউনিটি কিচেন চলছে। তার মধ্যে দেউলবাড়ির হালদারপাড়া, নাইয়া পাড়া এবং কাঁটামারি আদিবাসী পাড়ায় গত ১১ তারিখ থেকে শুরু হয়েছে, পরদিন শুরু হয় শ্যামনগর আদিবাসী পাড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় হাজার খানেক গ্রামবাসীর প্রতিদিনের খাবারের আয়োজন করছেন তাঁরা নিজেরাই। এর আগে জর্জের হাট, ভুবনেশ্বরী পয়লা ঘেড়ি, চিতুরি গাজিপাড়া, নূতন পাড়া, দেউলবাড়ি ঢালিপাড়া, উঃ দেবিপুর, উঃ দেবিপুর আদিবাসী পাড়া – এই ৭টি জায়গায় কিছুদিন করে কমিউনিটি কিচেন চলেছে। এছাড়াও বেশ কিছু এলাকায়, পাশাপাশি সাগরের বেশ কয়েকটি গ্রামে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে শুকনো খাবার। দেউলবাড়ির জর্জের হাট ও শিকারিপাড়ায় শ্রমজীবী স্বাস্থ্য উদ্যোগের সহায়তায় মেডিকেল ক্যাম্প হয়েছে। সামনের সপ্তাহে আরো চারটি মেডিকেল ক্যাম্প হবে। কুলতলি-মৈপিঠ ছাড়াও নামখানার পাতিবুনিয়া গ্রামে চলছে আর একটি কমিউনিটি কিচেন। এই সবটাই চলছে গ্রামবাসীদের ব্যবস্থাপনায়। তবে এটাই এমুহুর্তের একমাত্র কাজ বলে আমরা মনে করছিনা, ক্ষতিপূরণ সহ মানুষের জীবন জীবিকার দাবিতে আওয়াজ ওঠানো, প্রশাসনকে মানুষের দাবিদাওয়া, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্য করা, সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে গণউদ্যোগ গড়ে তোলাই আমাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য। তাই এই সমস্ত জরুরিকালীন উদ্যোগের সাথেই চলছে মেহনতি মানুষের ন্যায্য দাবি, খাদ্য-স্বাস্থ্য-কাজের অধিকার নিয়ে এলাকায় এলাকায় অধিকার আন্দোলনের প্রস্তুতি।
শাসক বিরোধী ও লড়াই আন্দোলনের জমি হিসেবে পরিচিত এই কুলতলি বিধানসভা কেন্দ্র বামেদের পুরানো দূর্গও বটে। দীর্ঘদিন SUCI, পরে গত ১০ বছর CPIM ক্ষমতায় থাকার পর এবছর রাজ্যের শাসক দল বিধানসভা নির্বাচনে এই বিধানসভা থেকে জয়লাভ করে। কিন্তু শাসকের পরিবর্তন হলেও সময়ের সাথে সাথে সাধারণ মানুষের দূর্দশা বিন্দুমাত্র কমেনি। ক্রমেই বেড়েছে। একদিকে দীর্ঘদিন ধরে নদীর চরগুলো বেআইনিভাবে দখল হয়েছে। স্থানীয় নেতাদের মদতে যথেচ্ছভাবে ম্যানগ্রোভের বন কেটে তৈরি হয়েছে বেআইনি ফিসারি। যার ফলস্বরূপ বাঁধের মাটি আলগা হয়ে সহজেই ভেঙেছে কোটালে। অন্যদিকে সুন্দরবন বাঁচানোর নাম করে মৌলে, মৎস্যজীবীদের বন থেকে উৎখাতের গভীর চক্রান্ত চালাচ্ছে সরকার। মৎস্যজীবী লুতফর রহমান বলছিলেন, নদীতে মাছ কাঁকড়া ধরতে গেলে বনদপ্তর তাদের আইনের ভয় দেখিয়ে কারণে অকারণে নৌকা আটকে রাখে, দেয় না মৎস্যজীবী পাস। মৌলেদের দেয় না মহুল পাস। কয়েকমাস আগে মহুল পাস, মৎস্যজীবী পাসের দাবিতে গ্রামবাসীদের সাথে নিয়ে চিতুরি ফরেস্ট অফিসে বিক্ষোভ দেখালে কয়েকদিন পর চালু হয় মহুল পাস। এছাড়াও এ অঞ্চলে সাম্প্রতিক কালে বেড়েছে বাঘে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। পরিবারগুলি চিকিৎসা পরিষেবা, ন্যায্য ক্ষতিপূরণটুকু পাননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। এপিডিআর এর তরফে লাগাতার প্রশাসনিক দপ্তরে দৌড়ঝাপ করে কিছুক্ষেত্রে ব্যবস্থা করা হয়।
একদিকে লকডাউন, তার উপর ইয়াস – দুইয়ে মিলে সুন্দরবনের মানুষের আজ প্রয়োজন অনেক। বেঁচে থাকতে প্রয়োজন খাবার, পানীয় জল, চিকিৎসা ও জীবিকা। প্রতিটি মানুষের এই ন্যূনতম প্রয়োজনটুকু মেটাতে প্রশাসন দায়বদ্ধ। এগুলি প্রতিটি মানুষের অধিকার। যা থেকে বঞ্চিত সুন্দরবনবাসী। আর সে সুযোগেই আরএসএস ফিল্ডে নেমে সমাজ সেবা ভারতী ও বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি নামে ত্রাণের কাজ করছে কয়েকটি গ্রামে। আরএসএস এর হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি নিয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন, প্রয়োজন নিজের শ্রেণি রাজনীতি নিয়ে সচেতন থাকার। হাত পেতে ত্রাণ নিতে হচ্ছে মানেই তারা সেটাই চায় বা আমরা বিরাট বড় ত্রাতা বা তাঁরা সম্মানের সাথে লড়তে ভুলে গেছে এমন কোনটাই না। এমনটা আমরা যারা ভাবি তারা আসলে ‘খিদে’ জিনিসটাই বুঝিনা, শ্রেণি রাজনীতি তো অনেক পরের ব্যাপার। ফাঁকা পেট যেমন হাত পেতে দেয়, তেমনি মুষ্টিবদ্ধ শত শত হাত নিজেদের অধিকার কেড়ে নিতে জানে। ত্রাণ যে ক্ষণিকের সেটা সুন্দরবনবাসী খুব ভালো করেই জানেন। কদিন পরে ত্রাণ ফুরোবে, কিন্তু অভাব ফুরোবে না – এই চরম সত্যিটা তারা জীবন সংগ্রাম দিয়ে বোঝেন। আর বোঝেন বলেই নিজেদের হকের লড়াই লড়ে নিতে জানেন।
ঝড়ের পর কেটে গেছে পনেরোদিন। এখনো অবধি পচা জল জমে আছে চাষের জমিতে। পুকুরগুলোয়ও নোনা জল। প্রশাসন এখনো অবধি জল নিকাশির কোনোরকম ব্যবস্থা নেয়নি। সামনে বর্ষা। পচা জল ছড়িয়ে রোগ ছড়ানোর প্রবল আশঙ্কা। এই রকম ভয়ঙ্কর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে সুন্দরবনবাসী। তার উপর বেশিরভাগ পাণীয় জলের কল খারাপ হয়ে পড়ে আছে। জলের পাউচ আসা বন্ধ হলে জলের হাহাকার আবার বাড়বে। জমা জল নিকাশি, অকেজো পাণীয় জলের কল সারাই, আগামী কয়েকবছর জীবিকা হারানো কৃষিজীবী, মৎস্যজীবী সহ সকল মানুষের রুটিরুজির স্বার্থে মাসিক টাকা, পরিবেশ রক্ষায় নারেগা আইনের মধ্য দিয়ে ১০০ দিনের কাজে প্রচুর ম্যানগ্রোভ লাগানো, প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্য, খাদ্য ও উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ সহ সুন্দরবন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে কুলতলি মৈপিঠের পয়লা ঘেড়ি, উঃ দেবিপুর আদিবাসী পাড়া, শ্যামনগর আদিবাসী পাড়া, জর্জের হাট, চিতুরি গাজিপাড়া সহ আরো বহু ইয়াস বিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে মিছিল করে শ’য়ে শ’য়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ গত সোমবার (৭/৬/২১) বিক্ষোভ দেখান কুলতলি বিডিও অফিসের সামনে। প্রবল তর্কাতর্কির পর বিডিও বাধ্য হয় গ্রামবাসীদের বারো দফা দাবিসহ ডেপুটেশন জমা নিতে। হুমকি দেয় এপিডিআরের প্রতিনিধি সহ বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীদের বিরুদ্ধে ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টে মামলা দেওয়ার। ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি আগামী দিনগুলোয় তাদের জীবন জীবিকার অধিকার সুনিশ্চিত করা এবং সকল সুন্দরবনবাসীকে আলোচনায় রেখে অবিলম্বে পরিবেশ বান্ধব নদী বাঁধ সহ সুন্দরবন সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে, বিডিও অফিসে বিক্ষোভ কর্মসূচি নিয়ে বিগত দিনগুলোয় যখন আমরা লাগাতার অধিকার সচেতনতার প্রচার চালাচ্ছিলাম এলাকায় এলাকায়, বেশিরভাগ মানুষই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এসেছেন, জানিয়েছেন, নিজেদের অধিকার আদায়ের এই লড়াই তারা একসাথে লড়বেন। তবে কয়েক জায়গায় এসেছে সরাসরি বাধা। শাসকদলের নেতাদের কাছ থেকে এসছে হুমকি। বিডিও অফিসে যাওয়ার দিন সকালে কোথাও স্থানীয় নেতাদের হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে গ্রামবাসীদের। কোথাও ভ্যান আটকে দেওয়া হয়েছে। বহু গ্রামবাসী আসতে পারেননি। তা সত্ত্বেও শ’য়ে শ’য়ে গ্রামবাসী জোট বেঁধে সেদিন বেরোন নিজেদের হকের লড়াই লড়তে। একদিকে কুলতলি অঞ্চলে যেমন চলছে মেহনতী মানুষের অধিকার, পরিবেশ রক্ষার সচেতনতা, প্রশাসনকে বাধ্য করে দাবি আদায়ের কাজ, তেমনি কুলতলির বাইরে নামখানা, রায়দিঘীর মত ব্লকেও নেওয়া হচ্ছে গ্রামবাসীদের সংগঠিত করে পথে নামার উদ্যোগ। গ্রামে গ্রামে অধিকার সচেতনতা গড়ে তুলে শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার এই লড়াই হামলা করে, মামলা দিয়ে রোখা যাবেনা।
আয়লা, আমফান, ইয়াস এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের অধিকার, পরিবেশবান্ধব নদীবাঁধ নিয়ে আওয়াজ তোলার পাশাপাশি আমাদের যেতে হবে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূলে। বুঝতে হবে সুন্দরবনের প্রকৃতি ও পরিবেশকে। জীবনানন্দের ভাষায় “অধিক নিবিড়ভাবে প্রকৃতিকে অনুভব” করতে হবে। খাদ্য, স্বাস্থ্য, জীবিকার পাশাপাশি সুন্দরবনের মানুষের অন্যতম মূল সমস্যা নদী বাঁধ। এর সমাধান কখনই কংক্রিট বাঁধ নয়, বরং বলার অপেক্ষা রাখেনা তা আরো ভয়ানক ক্ষতির মুখে ঠেলে দেবে গোটা বনাঞ্চলকে। ব্যাপক পরিমাণ ম্যানগ্রোভ প্রাচীর, রক্ষণাবেক্ষণ, স্থানীয় জনমানুষ ও পরিবেশ কর্মীদের মতামত নিয়ে পরিবেশ বান্ধব নদী বাঁধের পাশাপাশি প্রয়োজন জীবিকা সংক্রান্ত আরো বিকল্প ভাবনার। দেশজুড়ে পরিবেশ আন্দোলনের যে দীর্ঘ ইতিহাস তাতে এক নজর দিলেই আমরা দেখবো প্রতিটিই শ্রমজীবী মানুষের জীবন জীবিকার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। তা চিপকো আন্দোলন হোক কি নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন বা নিয়মগিরি, বস্তারের কর্পোরেট মুনাফার বিরুদ্ধে লড়াই। পুঁজি শুধুমাত্র শ্রমকেই শোষণ করেনা একই সঙ্গে ধ্বংস করে চলে প্রকৃতিকেও। তাই পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন, শ্রমিক শ্রেণিই এই আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি। সুন্দরবনকে বাঁচাতে হলে বাঁচাতে হবে তার প্রতিটি প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ। আর তা একমাত্র পারে সুন্দরবন জুড়ে শ্রমজীবী মানুষের সচেতন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ। মার্ক্সের “human essence of nature and natural essence of man” প্রকৃতির সাথে মানুষের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে উপলব্ধির মধ্যে দিয়ে। ব্যাপক প্রকৃতি ধ্বংস করে তার উপর ‘প্রভুত্ব’ স্থাপন কত বড় ভুল তা বলতে গিয়ে এঙ্গেলস উদাহরণ এনেছেন আল্গসের ইতালীয়দের, যাদের দক্ষিণ ঢালুতে পাইনের অরণ্য নিঃশেষ করে ফেলার সময় একটুও ধারণা ছিলনা যে তারা এইভাবে পার্বত্য পশুপালনের মূলেই কুঠারাঘাত করছে। এঙ্গেলস আমাদের সতর্ক করেছেন “প্রকৃতির উপর মানুষের এই জয়লাভে আমরা যেন খুব বেশি আত্মপ্রসাদ লাভ না করি। কারণ এইরকম প্রতিটি জয়লাভের জন্যই প্রকৃতি আমাদের উপর প্রতিহিংসা নেয়।.. বিজয়ী যেমন পরাজিত জাতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে আমরা কোনও অর্থেই সেভাবে প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করিনা, প্রকৃতির বাইরে থেকে। বরং রক্ত, মাংস, মস্তিস্ক দিয়ে আমরা প্রকৃতিরই অন্তর্গত এবং প্রকৃতির মধ্যেই আমাদের অস্তিত্ব।.. অন্য সকল জীবের মধ্যে আমাদের সুবিধা এই, আমরা প্রকৃতির নিয়ম আয়ত্ত করতে এবং তার নির্ভুল প্রয়োগ করতে সক্ষম”। প্রকৃতির এই ‘প্রতিহিংসা’র জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দায়ী আমরা সবাই, তাই দায়িত্বও আমাদের অনেক। সারাবছর উদাসীন থেকে শুধু বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন দিয়ে একে রোখা যাবেনা, পরিবেশ রক্ষার প্রশ্নটিকে আনতে হবে মূল রাজনৈতিক কর্মসূচিতে। সুন্দরবনের শ্রমজীবী মানুষকে শিক্ষা স্বাস্থ্য কাজের অধিকারের পাশাপাশি ‘প্রকৃতির নিয়ম’কে উপলব্ধি করে, পরিবেশ নিয়ে আরো সচেতন হয়ে কাঠ মাফিয়া থেকে অবৈধ মাছের ভেড়ি, শাসক শ্রেণির মুনাফার বিরুদ্ধে লড়াই করে সুন্দরবনের প্রাণ প্রকৃতি পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে। কারণ বনবাসীরাই পারে বনকে আগলে রাখতে, দীর্ঘদিনের শোষণ, বঞ্চনা ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ অধিকারের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদকে রক্ষা করে সুন্দরবনকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে।