সুদীপ্ত সেন: এক প্রকৃত মানবদরদীর চলে যাওয়া।।

সুব্রত দাস
কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে গত ৬ ই মে রাতে এপিডিআর-এর সহ সভাপতি এবং পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিন দশকের অধিক সময় ধরে এক অক্লান্ত ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মী সুদীপ্ত সেনের জীবনাবসান হল । দীর্ঘ ১৭ দিন ধরে আইসিইউ এবং ভেন্টিলেশনে থাকাকালীন কোভিড-১৯ এর সংক্রমণে ফুসফুসের ক্রিয়াক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায় প্রায় । তা সত্ত্বেও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন সুদীপ্ত সেন । তবে অবশেষে জীবনযুদ্ধে হার মানলেন ৬ তারিখ ।
সুদীপ্ত সেনকে আমরা এপিডিআর-এর একজন প্রথম সারির সংগঠক হিসেবে চিনলেও, তার রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয় ছাত্র বয়সে, নকশালপন্থী যুব সংগঠন বিপ্লবী যুব লিগ (আর ওয়াই এল) র একজন কর্মী হিসেবে। তারপর তিনি ছাত্র সংগঠন আর এস ও- তে যুক্ত হন। পরবর্তীতে এ বি এস এ-র সাথে আর এস ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পর সংগঠনের নাম হয় আর এস এ। সুদীপ্ত সেন আর এস এ-র প্রথম রাজ্য সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৯০-এর দশকে তিনি এপিডিআর-এর সঙ্গে যুক্ত হন এবং দক্ষিণ কলকাতায় এপিডিআর-এর শাখা গড়ে তোলার বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এপিডিআর-এর দক্ষিণ কলকাতা শাখার সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে, দীর্ঘ দিন তিনি এপিডিআর-এর সহ সম্পাদক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে তিনি এপিডিআর-এর সহ সভাপতি পদে কাজ করছিলেন। এপিডিআর-এর সংগঠক হিসেবে সুদীপ্তবাবু সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, লালগড়ের গণ আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। রিজওয়ানুর রহমান হত্যার ঘটনায়, কোরপান শাহ হত্যার ঘটনায় তিনি মানবাধিকার কর্মী হিসেবে দোষীদের শাস্তির দাবিতে বিশেষ ভাবে সোচ্চার হন। সাম্প্রতিক সময়ে পার্কস্ট্রিট গণধর্ষণ, কামদুনী গণধর্ষণ কান্ডে দোষীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর বিষয়ে তিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। নোনাডাঙ্গা উচ্ছেদ বিরোধী আন্দোলনে, ভাঙড়ের জমি রক্ষা আন্দোলনে, ভাবাদীঘীর জমি আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ যোগদান থেকেছে। লালগড় মঞ্চ, ভাঙড় আন্দোলন সংহতি মঞ্চে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি আন্দোলনে ২০০২ সাল থেকে লাগাতার যুক্ত থেকেছেন সুদীপ্ত সেন। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০০৮ সালের মে মাসে তিনি রানাঘাট আদালত চত্বরে গণ আন্দোলনের অন্য সাথীদের সঙ্গে পুলিশি আক্রমণের শিকার হন, তাদেরকে ব্যাপক মারধর করে জেলবন্দী করা হয়। সেই মামলা আজও চলছে। ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তির প্রশ্নে নতুন সরকারের ওপর আস্থা রাখা, নতুন সরকারকে সময় দেওয়া এবং সরকার গঠিত রিভিউ কমিটিতে অংশগ্রহণকে কেন্দ্র করে বন্দী মুক্তি আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি হলে, সুদীপ্ত সেন সঠিক অবস্থানের প্রশ্নে দৃঢ় থাকেন এবং গণ আন্দোলনের কর্মীদের সংগঠিত করে নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের দিন থেকেই রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে হবে, এই দাবীতে রাস্তার আন্দোলন গড়ে তোলেন। ক্ষমতায় আসার পর তৃণমূল সরকার নিজেদের পূর্ব প্রতিশ্রুতি অগ্রাহ্য করে রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে অস্বীকার করলে, তার বিরুদ্ধে গত ১০ বছর ধরে বন্দীদের মুক্তির দাবিতে যে আন্দোলন এবং আইনী লড়াই চলছে, সেই সংগ্রামে সুদীপ্ত সেন এর ভূমিকা অনস্বীকার্য। রাজনৈতিক বন্দীদের পরিবারগুলির পাশে দাঁড়ানো, তাদের বৃদ্ধ বাবা- মা র চিকিৎসার ব্যবস্থা করা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি বিষয়ে সবচেয়ে উদ্যোগী ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্দীদের চিকিৎসার জন্য তিনি ধারাবাহিক উদ্যোগ নিয়ে গেছেন। জেলের মধ্যে রাজনৈতিক বন্দীরা অসুস্থ হলে, তাদের চিকিৎসার জন্য আওয়াজ ওঠাতে সবার আগে এগিয়ে এসেছেন তিনিই। বন্দীদের ওপর প্রত্যেকটি অত্যাচারের বিরুদ্ধে, তাদের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে, তাদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন ও অনশনের সমর্থনে তিনি সোচ্চার থেকেছেন। বন্দীদের মামলা দেখভাল করা, নিয়মিত কোর্টে উপস্থিত থাকা, আইনজীবিদের সাথে যোগাযোগ করা, অর্থের ব্যবস্থা করা সমস্ত কিছুতেই তার ভূমিকা অগ্রগণ্য। পতিত পাবন হালদার থেকে শুরু করে মধুসূদন মন্ডল, শচীন ঘোষাল, রাধেশ্যাম দাস, অভিষেক মুখার্জী, সুনীল মন্ডল প্রমুখ রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্ত করার বিষয়ে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা থেকেছে। এছাড়াও বিগত ১২-১৪ বছরে যত জন রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি পেয়েছেন, প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাঁর কোনও না কোনও ভাবে অবদান রয়েছে। ২০১৫ সালে তৃণমূল সরকারের প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণে বিপ্লবী গণ আন্দোলনের কর্মী রাজা সরখেল, প্রসূন চ্যাটার্জী সহ ৬ জন রাজনৈতিক কর্মীকে মেদিনীপুর আদালত যাবজ্জীবন সাজা শোনালে, তাদের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা ও আইনি লড়াই পরিচালনার জন্য বিভিন্ন গণ সংগঠন ও অধিকার সংগঠনকে একত্রিত করে ‘রাজবন্দী মুক্তি যৌথ উদ্যোগ’ গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও সুদীপ্ত সেনের অন্যতম প্রধান ভূমিকা ছিল। নারায়ণ সান্যাল, হিমাদ্রি সেন রায়, গুপী দাস, পতিত পাবন হালদার-এর মত মুক্তিপ্রাপ্ত রাজনৈতিক বন্দীদের চিকিৎসার বিষয়েও তার অগ্রণী ভূমিকা থেকেছে। স্বপন দাশগুপ্ত থেকে শুরু করে সুদীপ চোংদার – যখনই কোনও রাজনৈতিক বন্দী অসুস্থ হয়েছেন, তাদের চিকিৎসার অব্যবস্থা নিয়ে তিনি সরাসরি প্রশাসনের সাথে সংঘাতে গেছেন। সুদীপ্ত সেনের মৃত্যুতে রাজনৈতিক বন্দী মুক্তি আন্দোলনের যে ক্ষতি হল, তা কোনদিনই পূরণ হবে না।
সুদীপ্ত সেন এর নিজস্ব একটা রাজনৈতিক মতামত ছিল, রাজনৈতিক বিশ্বাস, আদর্শের প্রতি আস্থা ছিল। কিন্তু অধিকার আন্দোলন, মানবাধিকার সংগঠনের কর্মী হিসেবে সেই রাজনৈতিক মত, বিশ্বাসের উর্দ্ধে উঠে, সমস্ত সংকীর্ণতাকে দূরে সরিয়ে ব্যাপক মানুষেরকাজ করার জন্য যে হৃদয়ের প্রসারতা প্রয়োজন, সেটা সুদীপ্ত সেনের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল। তাই যারা তাঁর রাজনৈতিক মতের সমালোচক বা বিরোধী, তাদের ওপর কোন রাষ্ট্রীয় আক্রমণ হলেও সেখানে ছুটে গিয়ে প্রতিবাদে সরব হতে কখনও দ্বিধা বোধ করেননি। নন্দীগ্রাম, লালগড় আন্দোলনের বন্দীদের জন্য যে আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা নিয়ে তিনি ছুটে যেতেন, সেই একই আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতা নিয়েই তিনি ভাঙড় আন্দোলনের বন্দীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন ধরনের মানুষের প্রতি সেবার মনোভাব নিয়ে তাদের বিপদে সহযোগিতা করেছেন। আমফান ঝড়ে লন্ডভন্ড সুন্দরবনের বিপর্যস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, কৃষি আইন, শ্রম কোড, এন আর সি- এন পি আর- সি এ এ বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া, কোভিড পরিস্থিতিতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে পথে নামা, হিন্দু ফ্যাসিবাদী শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সরব হওয়া, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আটক বুদ্ধিজীবীদের মুক্তির দাবিতে জনমত গড়ে তোলা সহ সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। প্রকৃতঅর্থে, মানুষকে ভালোবাসতে না পারলে, একজন সত্যিকারের মানব দরদী না হলে কোনও মানুষের পক্ষে সামাজিক ক্ষেত্রে এই ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়।
আজকে যখন এই উদারীকরণের বিশ্বে সবাই নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগীতায় মত্ত, মানবিকতা বোধটাই যেখানে একটা বিলুপ্তপ্রায় ধারণা হয়ে গেছে, সেখানে সুদীপ্ত সেনের মত মানব দরদী সমাজ কর্মী বিরলতম প্রজাতির মধ্যেই পড়ে। তাঁর না থাকাটা আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বড় প্রভাব ফেলবে।