আনন্দসাগরের খোঁজে কবি লিয়াকত আলি

তৈমুর খান :- প্রায় শ তিনেক গানের জনক, পদকর্তা হিসেবে বাউলদের কাছে আখ্যায়িত এবং সম্মানিত। যাঁর অসাধারণ গদ্যশৈলী। দেহবাদ বা দেহতত্ত্ব নিয়ে অসামান্য গদ্যও লিখেছেন ড. সুধীর চক্রবর্তীর সম্পাদিত গদ্য সংকলনে। যিনি কখনও বড়ো কাগজে লেখেননি অথচ বড়ো কাগজ তাঁকে নিয়েই লিখতে বাধ্য হয়েছে । সেই পরম সাধক উদাসীন আত্মভোলা লিয়াকত আলি নিজেকে নিজের মতোই চালিত করেছেন সারাজীবন। নিজেই হয়ে উঠেছেন একটি প্রতিষ্ঠান।
লিয়াকত আলি (১৯৫২ —২০১৭) কাঁকরতলা থানার বাতাসপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ছিলেন শওকত আলি, মাতা আমিনা বিবি। প্রথাগত শিক্ষাতেও তিনি তেমন অগ্রসর হননি। ১৯৮৫ সাল থেকেই লিয়াকত আলির লেখালেখির সূচনা। প্রথম কবিতা “তার চিঠি” এবং প্রথম গদ্য “বাউল ও বিদেশিনী” সাপ্তাহিক “চন্ডীদাসে” প্রকাশিত হয়। “অন্য এক” ও “অচিন পাখি” নামে দুটি পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে তিনি সম্পাদনা করেছেন। তবে দুটি করে সংখ্যা বেরিয়ে তা বন্ধ হয়ে যায়। বেশ কয়েকটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে : “ঘাম অশ্রু রক্ত”, “অচিন পাখি” , “ঝর্নাজল অশ্রুই তো” , “ধূলিকণা জোনাকি” এবং “কাব্যসমগ্র” । “পাখি আমার মর্ম পাখি” নামে গানের সংকলনের দুটি খণ্ড। বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে মূলত কবিতাই লিখেছেন কবি। পীর-ফকিরের সঙ্গে ও আউল-বাউল নিয়েই সময় কাটিয়েছেন । ইচ্ছে হলে কলম ধরেছেন। জীবনযাপনের মধ্যেও সুফিবাউলের প্রভাব স্পষ্ট। আত্মতত্ত্ব নিয়ে, কখনও দেহতত্ত্ব নিয়ে, কখনও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ভেবেছেন। সজীব রোদে পরাবাস্তবকে আলোকিত হতে দেখেছেন। যার মধ্যে সৃষ্টি রোদ ও জলের উপাদানে, আকাশ ও মাটির মর্মে গেঁথে আছে। চেতনার আদি স্তরে কবির অনুভূতি সেই প্রাগৈতিহাসিক কালকেই নির্ণয় করতে চায়। উদ্ভিদ, পাথর, মীন, পাখি, আকাশ ও সৃষ্টিসমূহের সকল বিস্ময়ে কবি নিজেকে বিস্তৃত হতে দেখেন। এ এক অসাধারণ বোধি, যেখানে পার্থিব আলোর বাইরেও এক অন্যতর আলো আছে, সভ্যতার ভেতরেও যে আরও মরমিয়া সভ্যতার ঠিকানা আছে, শব্দের বাচ্যার্থে সেসব ধরা যায় না। কবির কলমে উঠে আসে —
“আনন্দসাগরে নিয়ে চলো। শাস্ত্র ছুট চাঁদের
হে বিপ্লবিনী, মরমিয়া গান গাও।
প্রেমের মুখাবয়ব মুখে, মেঘে মেঘে চুল।
মর্ত্যনৃত্যে ভাবের ভূষণ।
বাঁশিব় উপলব্ধিতে, একান্তই বাঁশের ভারতীয় বাঁশি —
জগৎঠোঁটে বেজে ওঠে ।”
বিশ্বচৈতন্যের, সৃষ্টিচৈতন্যের অনন্তপরিধির ভেতর কবি নিয়ে যেতে চান। শব্দাবলিও নতুনভাবে উচ্চারিত হয়, যেমন — মরমিনী, সঙ্গমশব্দ, নিসর্গতট, পথতত্ত্ব, উপাসনাঅধর, পড়শিঘ্রাণ, আরশিফল প্রভৃতি । উচ্চারণে কোনও বাউল সাধককেই মনে পাড়ায়। অলীক আস্বাদ তখনই নেমে আসে। নিজেকে ফিরে পান কবি। রুমি আর মজনু শাহর মতো দেশাত্মবোধ থেকে জগৎবোধ, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিহীন ঐশীলোকে ।“আমি”ময় বিশ্ব তখনই “তুমি”ও আমি হয়ে যায় ।
কবিতার চিত্রকল্পগুলি অতি চেতনায় একটা নিজস্বতা অর্জন করে। কখনও পোস্টমডার্ন বলেও মনে হয়। আবার কখনও ছায়াবাদের নিরন্তর অভিক্ষেপ। মশারির কুয়াশার ভেতর পাখি ওড়া থেকে গানের মৈথুন অবধি, অথবা, কোমরে ঝোলানো কালপুরুষের ছুরি সবকিছুতেই মেটাফোরর প্রয়োগ ঘটেছে। আর একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন —
“পাখির বেদনাকে দেখি, আর দেখি
চাঁদের খালে উকুনের অন্ধকার ।”
পাখির বেদনাকে দেখা, চাঁদের খালে উকুনের অন্ধকার স্বাভাবিক ব্যবহার নয়। জীবনের বুদবুদকুঁড়ের ভেতর রূপান্ধ অশ্রুরস কবির অন্তঃস্থিত বোধেরই প্রকাশ। লোহার থাবায় পাথরের স্তন জড়িয়ে ধরাতেও সভ্যতার ছায়াবাদ প্রকট হয়ে ওঠে। সময় ও জীবনের ধ্বংস ও স্ল্যাং বারবার উঠে আসে তাঁর কবিতায়। মাটির রজে লাঙলের বীর্য ছড়ানো নয়, জোয়ালের ডিম ছড়ানোও সভ্যতা, কবির কথায় “চিরমূর্খ চাষা” । গিলবার্ট কে চেস্টারটন কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, “All slang is Metaphor, and all Metaphor is poetry.”এ কথারই সার্থক উদাহরণ হল লিয়াকত আলির কবিতা। সময়, আত্মদর্শন, শিল্প এবং পোস্টমডার্ন ভাবনা সবই মিশে গেছে। শব্দ ব্যবহারের আলাদা এক মাধুর্যও এনে দিতে পেরেছেন। তাঁর ভিন্নধারার কবিতা পাঠকের কাছে হয়তো ততটা সমাদৃত হবে না, কিন্তু বাংলা সাহিত্য এক নতুন দিশা পাবে।