মুর্শিদাবাদের আম চর্চা চতুর্থ পর্ব

সুশান্ত বিশ্বাস :- একসময় জেলায় 200 বা তার বেশি সংখ্যক প্রজাতির আম পাওয়া যেত। এখন সেই আম 50 থেকে 52 প্রজাতিতে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রায় প্রতিবছরই হারিয়ে যাচ্ছে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের নাম, বিশেষজ্ঞরা তার কারণ ও চিহ্নিত করেছেন। তাদের বক্তব্য, মুর্শিদাবাদের নামি আমগাছ গুলি অধিকাংশই প্রাচীন , এবং সেই আম গাছগুলোতে আম ধরে কম, যার জন্য চাষীরা কম আগ্রহী হয়ে পড়েছে তাছাড়াও আমবাগান গুলিতে এখন সাবেকি আমের বদলে উচ্চ ফলনশীল আমের চাষে বেশি আগ্রহী হয়ে পড়েছে চাষিরা। যার জন্যই নবাবি আমলের নামি আংগুলের প্রজাতি ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে।
ভবানী : এ বৎসর বাহারিন আম উৎসবে পাড়ি দিয়েছে ভবানী। মুর্শিদাবাদে ‘ভবানী’খুব পরিচিত একটি আম। জৈষ্ঠ মাসের 15 থেকে 20 তারিখের দিকে পাকতে লাগে এই আম। লালবাগ ও জিয়াগঞ্জ এলাকাতে এখনও বেশ কিছু ভবানী আমের গাছ আছে, ধরে ও প্রচুর পরিমাণে। ভবানী আম মাঝারি সাইজের লম্বাগোল আকারের হয়। ভবানী আম দেখতে খুব সুন্দর, পাকলে গাঢ় হলদে রংয়ের হয়। খোসা খুব পাতলা, আস নেই, একটু মজিয়ে খেলে খুব মিষ্টি ও সুস্বাদু হয়, ভবানী আমের নিজস্ব একটা সুঘ্রান আছে।

(২০) হিমসাগর (সাদুল্লা) : নবাবী নাম সাদুল্লা, মুর্শিদাবাদের বাইরে সকলে এই আমকে হিমসাগর বলেই চেনে। মুর্শিদাবাদের মানুষ কিন্তু তাকে সাদুল্লা বলেই ডাকে। হাজার হলেও খাস নবাবদের দেওয়া নাম, মুর্শিদাবাদের মানুষকি ভুলতে পারে। আমার মনে হয় মুর্শিদাবাদে যত আম আছে সাদুল্লা আমের সঙ্গে আর কোন আমের তুলনা চলে না, অসাধারণ মন ভোলানো স্বাদের জন্যই সাদুল্লা আমের চাহিদা বেশি। মুর্শিদাবাদে সবচেয়ে বেশি আমের গাছ আছে সাদুল্লার (হিমসাগর) , ফলন ও হয় প্রচুর, সেই জন্য সমস্ত আমের মরশুম জুড়ে পাওয়া যায় সাদুল্লা আম। বাজারে অন্য আমের চেয়ে সাদুল্লা আমের দাম ও বেশি।
হিমসাগর আম পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতেই হয়, কিন্তু মুর্শিদাবাদের সাদুল্লা বা হিমসাগর আমের যেমন
স্বাদ অন্য জেলার হিমসাগর আমের স্বাদ অতটা নয়। একটা সময় জেলার বাইরে থেকে হিমসাগর এসে মুর্শিদাবাদের আমের বাজার দখল করে নেয়। মুর্শিদাবাদের হিমসাগর বলে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে, কিন্তু কেনার পর ক্রেতাদের ঠকতে হয়।

(২১) জগন্নাথ ভোগ : এখন আর সেই নবাব নেই, তাদের নবাবীয়ানাও নেই। তবুও আম উৎপাদনে কমতি নেই মুর্শিদাবাদে। এখনো নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান করলে 50 থেকে 52 প্রজাতির আম পাওয়া যাবে।
জেলার লালগোলা, লালবাগ, জিয়াগঞ্জ, ভগবানগোলা, জঙ্গিপুর, ধুলিয়ান, নওদা, বেলডাঙ্গা প্রভৃতি এলাকায় এখনও প্রচুর সংখ্যক আম বাগান রয়েছে। যদিও মুর্শিদাবাদ শহর এলাকায় আম বাগানের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাওয়া যায় এই আমটি, 400থেকে 500 ওজনের হয়ে থাকে এই আম। বেশ মোটা ও গোলগাল হয় জগন্নাথভোগ আম। পাকলেও এই আমের গায়ে হালকা সবুজের আভা থাকে, আসহীন মোলায়েম শাঁসযুক্ত জগন্নাথ আম খেতে যেমন মিষ্টি তেমনি সুস্বাদু ও রসালো, পাকলে এই আমের ভিতরের শাঁস লাল রঙ ধরে।

(২২)কিষান ভোগ : কিষান ভোগ আম বেশ বড় ও গোলাকার গড়নের হয়, প্রায় 500 থেকে 600 গ্রাম ওজনের। একটু বেশি পাকিয়ে খেলে বেশ মিষ্টি ও রসালো, শাঁস খুব মোলায়েম মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। খোসা পাতলা, আটি পাতলা চ্যাপ্টা ও সরু , আঁশবিহীন এই আমের খুব সুন্দর ঘ্রাণ আছে। মুর্শিদাবাদের লালগোলা, জিয়াগঞ্জ, লালবাগে এই আমের গাছ আছে , অন্য অঞ্চলে এই আমের গাছ থাকলেও তার সংখ্যা খুব কম।

(২৩) লক্ষণভোগ :বেশ বড় সাইজের এই আম, 500 থেকে 600 গ্রাম এর মত হয়। লম্বা ও চ্যাপ্টা আকারের। একেবারে নিচের থেকে একটু উপরে মোটা নাকের মত অংশ লক্ষণভোগ আমাকে চিনিয়ে দেয়। পাকলে হালকা হলুদ রং ধরে। খোসা একটু মোটা , আঁট খুব পাতলা, একদম আঁশ নেই, শাঁস এর উপরের অংশ একটু মোটা নিচের অংশের শাঁস মোলায়েম। মাঝারি মিষ্টি স্বাদের এই আম খুব রসালো এবং আলাদা সুঘ্রান আছে। খোশবাগ, লালবাগ, গৌরীপুর, ভগীরথপুর এলাকায় এই আমের গাছ আছে।

(২৪) ক্ষীরশাপাতি : ক্ষীরশাপাতি আম দেখতে অনেকটা সাদুল্লা আমের মতো তবে কাঁচাতে এর গায়ের রঙ হালকা সবুজ হয়। মাঝারি সাইজের এই আমের গড়ন গোলাকার খেতে খুব মিষ্টি। আসহীন, খোসা পাতলা আঁটি ছোট, শাঁস মোলায়েম ও রসালো। আলাদা সুখ গ্রহন আছে (সাদুল্লার মত নয়।)। খিরসাপাতি আমের গাছ জঙ্গিপুর, রঘুনাথগঞ্জ, লালগোলা অঞ্চলে বেশি রয়েছে, বাজারে পাওয়া যায় বেশি দিন ধরে। তাছাড়াও নওদা থানার আমতলা, পাটকে বাড়ি, রায়পুর অঞ্চলেও বেশকিছু ক্ষীরশাপাতি গাছ আছে এখনো। তবে লালবাগ জিয়াগঞ্জ এর দিকে এ আমগাছ থাকলেও খুব কম সংখ্যক যার জন্য এসব এলাকার বাজারে খিরসাপাতি আম খুব কম পাওয়া যায়।
